আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল এবং একটি আবেদন আজাদ আলম
সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে নির্মানাধিন একমাত্র আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ক্যান্সার হাসপাতাল আহসানিয়া মিশন হাসপাতাল। এই অসাধারণ মানব-কল্যাণ মূলক গৌরবময় অধ্যায়ের যিনি সূচনাকারী এবং মুল পরিচালনা শক্তি তিনি আহসানিয়া মিশনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জনাব কাজী রফিকুল আলম। সিডনীতে এক ঘরোয়া পরিবেশে জনাব কাজী রফিকুল আলমের সাথে কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয় আমার। কথা প্রসঙ্গে আহসানিয়া মিশনের গোরার থেকে সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশে নির্মিয়মান ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট ক্যান্সার হাসপাতালের মত বিশাল প্রকল্পের যে সফল ক্রমবিকাশ তা শুনে অবাকই লাগল। সত্য সাধনা, নিরলস নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা, যোগ্য কাণ্ডারি এবং সর্বোপরি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্রস্টার উপর অগাধ বিশ্বাস যে সকল সাফল্যের মুল চাবি কাঠি তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ আহসানিয়া মিশন এবং তাদের সৃষ্টি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার এবং জেনারেল হাসপাতাল।
ঘরোয়া পরিবেশে নৈশ কালীন এক বৈঠকে তার এই সুদূর পরিক্রমার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল ব্রিটিশ শাসনামলে বঙ্গীয় মুসলিম সমাজের উন্নয়নের যিনি পথিকৃৎ খানবাহাদুর আহসান উল্লাহর একজন যোগ্য উত্তসুরীই বটে কাজী রফিকুল আলম।
প্রতিটি মহৎ কাজের পিছনে দরকার অগাধ প্রেরণা এবং উজ্জীবনী শক্তির উৎস যা সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। উপ মহাদেশের বিখ্যাত সুফি, সমাজ সেবক এবং সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, সাধক হজরত খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ (র:) ছিলেন কাজি রফিকুল আলমের সেই প্রচ্ছন্ন প্রেরণা এবং সঠিক পথ নির্দেশনার জ্যোতির্ময় আলোকবর্তিকা। যার মহান দর্শনকে পুঁজি করে সেই ছোট বেলা থেকেই তিনি আপন পরিধেয় বস্ত্রের মত নিজেকে জরিয়ে রেখেছেন ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সকল প্রকল্পের সাথে। নিজের চোখে দেখা সুফি সাধক আহসানউল্লাহ (র:) খান বাহাদুর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কাজী রফিকুল আলম সাহেবের গলার স্বর প্রায় জরিয়ে আসছিল। মহান মনিষী আহসান উল্লাহ ১৮৭৩ সালে সাতক্ষিরা জেলার নইতা গ্রামে এক সভ্রান্ত সচ্ছল পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। আরাম আয়েশ এবং অফুরন্ত ঐশ্বর্যের মধ্যে বেড়ে উঠলেও এই মহান মনিষীর জীবনের ব্রত ছিল পিছিয়ে পরা সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সমসাময়িক কালে বাঙ্গালি মুসলিমদের শিক্ষা দীক্ষায় পেছনে পরে থাকাটা তিনি মনে করতেন সমগ্র বাঙ্গালির পেছনে পরে থাকা। তাই সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রণাকে শিকেই তুলে রেখে এই মহান সমাজ সংস্কারক সমাজের যাবতীয় বৈষম্য বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিমদের যে অবাঞ্ছিত ব্যবধান তা দূর করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান।
ধর্মিয় গোঁড়ামি এবং তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের অবহেলার কারণে মুসলমানরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে ছিল এবং সে কারণে সামাজিক অবস্থান ছিল পেছনের সারিতে। তাঁর নিজের উচ্চ শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং চাকুরীর অবস্থানকে কাজে লাগাতে পেরেছেন মুসলমানদের শিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন জায়গায় স্কুল, কলেজ পাঠাগার গরে উঠেছিল তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় । পাশা পাশি তিনি ধর্মীয় শিক্ষার উপরেও সমান জোর দিয়েছিলেন। ধর্মের আধ্যাত্মিক আলোকে সঠিক ভাবে আলোকিত হয়ে প্রতিবেশী হিন্দুভাইদের সাথে অসাম্প্রদায়িক সহ অবস্থান করতে পারার মহান দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সাধক আহসান উল্লাহ (রঃ)।
ব্রিটিশ শাসকরা তৎকালীন অখণ্ড বঙ্গভূমিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করলেও খান বাহাদুর অতি বিচক্ষণতার সাথে তার মোকাবেলা করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি একটা উদাহরণ টানলেন যা তাঁর চাতুর্যতার পরিচয় দেয়। সে আমলে পরীক্ষার খাতায় নাম লেখা হত এবং যেহেতু বেশির ভাগ পরীক্ষক ছিলেন হিন্দু অথবা ব্রিটিশ, তারা মুসলমান নাম দেখলে বেশি নম্বর দিত না এবং এতে মুসলিম ছাত্রদের পাশে হার ছিল অনেক সীমিত। ফেল করা হতাশাগ্রস্ত ছাত্ররা পড়াশুনা ছেড়ে দিত এবং যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল পিছেয়ে পড়া। এই বিমাতা সুলভ আচরণের বিমোচন ঘটে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর বলিষ্ঠ পদক্ষেপে। তার প্রস্তাব ছিল পরীক্ষার খাতায় নামের বদলে রোল নম্বর থাকতে হবে এবং এটা হলে কোন পক্ষপাতিত্ব হবে না। তৎকালীন পরীক্ষকরা এর জোর বিরোধিতা করেন । তাদের যুক্তি খাতা হারিয়ে গেলে তা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে । তিনি তখন বিচক্ষণতার সাথে প্রস্তাব দেন তা হলে মাস্টার্স বা অনার্সে রোল নম্বর ব্যবহার প্রথা চালু হোক যেহেতু ছাত্র সংখ্যা কম , খাতা হারিয়ে গেলেও কার খাতা হারিয়েছে বের করা যাবে এবং সেই প্রথম রোল নম্বরের ব্যবস্থা চালু হল পরীক্ষার খাতায়। পরবর্তীতে সর্বস্তরে রোল নম্বরের ব্যবস্থা চালু হয় এবং মুসলমান ছাত্রদের পাশের হার অনেক বৃদ্ধি পায়।
অনেকেই তার সম্পর্কে সাম্প্রদায়িকতার ধোয়া তুলছিলেন সেই সময় যেহেতু পিছিয়ে পরা মুসলিম সমাজকে এক কাতারে আনার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল নির্ভেজাল নিরলস। তিনি কখনই দ্বিজাতি তত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। বাঙালি সমাজের উন্নতিই-ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। যেহেতু মুসলমানরা অনেক পিছে পড়ে ছিল নানান কারণে তাদেরকে শিক্ষা দীক্ষা সংস্কৃতি চাকুরী-বাকুরীতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে কাজী রফিকুল আলম উল্লেখ করেন হিন্দু মুসলিমরা সামাজিক অঙ্গনে নিজেদেরকে পৃথক না ভাবে তার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা ছিল এই সমাজ সংস্কারকের। যে কোন কারণেই হোক তৎকালীন সময় মুসলিম বঙ্গীয় ভাষা এবং হিন্দু বঙ্গীয় ভাষা নামে দুই ভাষার মেকি প্রচলন ছিল। মুসলমানরা পানি বললে হিন্দুরা জল বলত, হিন্দুরা স্বর্গ, বন্দনা বললে মুসলমানরা বেহেস্ত মোনাজাত ইত্যাদি নিয়ে গর্ব করত। অনেক বাংলা গ্রন্থের সফল প্রণেতা খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ এই শব্দ চয়নের রেষারেষির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি হিন্দু বঙ্গীয় ভাষা বা মুসলমান বঙ্গীয় ভাষার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সব ভাষাই বঙ্গীয় বলে প্রতিষ্ঠিত করার জোর চেষ্টা করে গেছেন।
বরাবরের মত এখনও খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর মাজারে হিন্দু মুসলমান সব ধরনের মুরিদ রাই শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। তাঁর আমলে এক হিন্দু পরিবার ইটের ভাটায় আগুন দেয়ার প্রাক্কালে আহসান উল্লাহ সাহেবের কাছে আসে দোয়ার জন্য যাতে করে ইট পোড়া ভাল হয় । সেই হিন্দু ভদ্রলোক একটা ইট নিয়ে আসেন। উনি দোয়া করে ইটটিতে ফু দেন। তার সেই ভাটার ইট প্রায় সবগুলোই ভালোমতো পোড়া হয়। সেই ইটটি এখন সেই পরিবার সযত্নে রেখে দিয়েছেন শ্রদ্ধা ও ভক্তির নমুনা হিসেবে।
আহসানিয়া মিশনের গোরার কথা জানতে চাইলে জনাব রফিকুল আলম বলেন, “ ১৯৩৫ সালে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ সাতক্ষিরায় তার নিজের এলাকায় আহসানিয়া মিশন নামে একটি সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। যার মুল লক্ষ্য ছিল আর্থ সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পরা মানুষদেরকে সামনের কাতারে নিয়া আসা । অনেকেই এর নামের পিছনে ইংরেজি শব্দ “মিশন” ব্যবহার করাতে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। আরবি, উর্দু বা বাংলা কোন শব্দের কথা মাথায় না এনে উদার মনের এই মহাপুরুষের মিশন/যাত্রা শুরু। আশে পাশের এলাকায় এর বেশ কয়েকটি শাখা প্রশাখায় ব্যাপক জনকল্যাণ মূলক সেবা কাজ চলে। ১৯৫৮ সালে ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সফল আত্মপ্রকাশ ঘটে মগবাজারে কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠার পর। জনাব কাজী রফিকুল আলম ১৯৭৮ সালে ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের পর এর কার্যক্রম সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরে ব্যাপকভাবে। তাদের সেবামূলক কাজের পুরষ্কার স্বরূপ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেতে থাকেন একের পর এক।
কখন তাঁর মাথায় ক্যান্সার হাসপাতালের মত বিশাল প্রজেক্ট হাতে নেয়ার কথা মাথায় আসল এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি তাঁর স্ত্রীর কথা স্মরণ করেন। তাঁর স্ত্রী ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে নিয়ে ইন্ডিয়া যেতে হয় এবং অনেক ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াও একটা মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয়। তখন তাঁর মাথায় আসে নিজের দেশে ক্যান্সার রোগীদের নিরাময়ের জন্য হাসপাতাল করতে পারলে দেশ যে কোটী কোটী টাকা বিদেশে চলে যাওয়া থেকে বেঁচে যাবে শুধু তাই নয়, সম্পূর্ণ বিনা মুলে অনেক গরীব ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা করা যেতে পারে। এর পর তিনি আর বসে থাকেন নি। ১৯৯৭ সালে রাজউক উত্তরায় জায়গা বরাদ্দ দিলে লটারির মাধ্যমে, বিভিন্ন প্রচার মিডিয়ায় আবেদনের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহে লেগে পড়েন। “দেশের মানুষের টাকায় দেশের মাটিতে হবে ক্যান্সার হাসপাতাল” এই স্লোগান সামনে রেখে তিনি ব্যাপক প্রচারণা চালান। এর জন্য আহসানিয়া মিশনের দেশব্যাপী বিশাল নেটওয়ার্ক কে কাজে লাগান। ২০০৪ সালে ৩ একর জমির উপরে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়া এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
৫০০ শয্যা বিশিষ্ট ১৫ তলার এই হাসপাতাল উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত। দেশের মানুষের টাকায় তৈরি এই হাসপাতালে থাকছে ৪০ টি পরিপূর্ণ ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড কন্সাল্টিং ইউনিট। নো লস নো প্রফিট এবং ৩০% রোগীর বিনা খরচে চিকিৎসার অঙ্গিকার নিয়ে আহসানিয়া মিশন হাসপাতালের কিছু ডিপার্টমেন্ট ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে। যেমন মেডিক্যাল ইমেজিং এবং প্যাথলজিকাল ইউনিট। গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে মাননীয়া প্রধান মন্ত্রী আহাসানিয়া মিশন ক্যান্সার এবং জেনারেল হাসপাতালের শুভ উদ্বোধন করেন।
৫০০ শত কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ এই হাসপাতাল পূর্ণ মাত্রায় চালু করতে আরও প্রায় ২০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। বাংলাদেশের আপামর জনতার সাহায্যের ফলে তিনি এই প্রজেক্ট প্রায় শেষের পথে নিয়ে এসেছেন। এই সাহায্যকারী জনতার কাতারে পেয়েছেন, কোন টানাপড়েন পরিবারের গিন্নিকে যিনি সংসারের টাকা বাঁচিয়ে সাহায্য করেছেন ৫০০ টাকা, পেয়েছে কোন রিকশাওয়ালার ঘামে ভেজা ৫০ টাকা। পেয়েছে কোন কোমল-মতি স্কুল ছাত্রীর টিফিনের টাকা থেকে বাঁচানো ২০ টাকা ।
হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আহসানিয়া মিশনের একনিষ্ঠ কর্মি জনাব কাজী রফিকুল আলম বিভিন্ন দেশে ঘুরছেন বাংলাদেশিদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহের জন্য। দেশী মানুষের টাকায় দেশের মাটিতে এই হাসপাতালের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিরা অবশ্যই সারা দিবে এ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। এই ডাকে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশিরা সাড়া দিয়েছেন । সিডনির একটি সংগঠন “বাংলাদেশি ফোরাম ফর কমুনিটি এংগেজমেন্ট” ২৫০,০০০ হাজার ডলার সংগ্রহের অঙ্গিকার করেছেন। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন “মা কেয়ার বাংলাদেশ” সহ আরও কিছু সেবা মূলক সংগঠন। ইতিমধ্যে এরা ১ লক্ষ্যের ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
এ মাস রমজান মাস। দান খয়রাতের জন্য উপযুক্ত মাস। আসুন আমরা সবাই যে যার সাধ্যমত আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরির কাজে শরিক হই। সদকায়ে জারিয়ায় অংশ নেই।
অস্ট্রেলিয়ান রোটারি ক্লাবের সহযোগিতায় সংগ্রহ কৃত এই অর্থ সম্পূর্ণ ট্যাক্স ডিডাক্টেবল। আপনার দান নিচের একাউন্টে সরাসরি জমা দিতে পারেনঃ
Account Name: Rotary Australia Overseas Aid Fund –Dhaka Hospital Cancer Unit BSB : 082-183 Account No.: 12 474 4765 National Australia Bank
বিস্তারিত জানার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ডঃ আব্দুল হক ০৪২৫২৬০২৩৯। email Abduhaq87@gmail.com
|