bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













অধরা
আতিক রহমান


আগের অংশ

আশ্বিনের ভরা বাদলে পুরো গ্রাম যখন পানিতে সয়লাব, খালবিল ডোবা নালা যখন কানায় কানায় পূর্ণ, গ্রামের পায়ে হাঁটা মেঠো পথখানা যখন গরুর গাড়ীর চাকায় জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়ে রীতিমত খালে রূপান্তরিত হয়েছে; এমনই বর্ষণমুখর এক পড়ন্ত বিকেলে মেঘলা আকাশ আর ঝড়ো হাওয়া মাথায় নিয়ে কে যেন একজন ক্র্যাচে ভড় করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওয়াজেদ শানার বাড়ীর দিকে আসছে। মুখ ভর্তি তার দাঁড়ি গোঁফ, পড়নে আলুথালু বেশ। দেখে চেনার কোন উপায় নেই কে সে? সে আর কেউ নয়; সে এই রসুলপুর গ্রামেরই ওয়াজেদ শানার নাতি এবং শেফালীর আদরের ধন আলাল! যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আলাল। সেদিনের সেই সুদর্শন ভার্সিটির মেধাবী সাহসী যুবক আলাল আজ পঙ্গু।

যুদ্ধ যখন প্রায় শেষ; আলাল সহযোদ্ধাদের নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের ভিতরে ঠুকে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়; এমনই এক যুদ্ধে পাকবাহিনীর পুতে রাখা মাইনে পা দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয় আলাল। উরু সমেত উড়ে যায় তার ডান পা এবং মাইনের স্প্লিনটার এসে আঘাত করে বুকে এবং মাথায়। সাথে সাথে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা ফিল্ড হাসপাতালে। সেখানে সে কয়েকদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। অবস্থার একটু উন্নতি হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তের ওপাড়ে বড় এক হাসপাতালে। এভাবেই প্রাণে বেঁচে যায় আলাল। আঘাত গুরুতর হওয়ায় চিকিৎসায় অনেকটা সময় লেগে যায়। হাসপাতালে বসে সে মাকে একটি চিঠি দিয়েছিল কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সে চিঠি শেফালী’র কাছে পৌঁছায়নি। অনেকটা সময় সে পড়ে ছিল সীমান্তের ওপাড়ের হাসপাতালে। তারপর ধীরে ধীরে আলাল সুস্থ হয় লাগানো হয় কৃত্রিম পা। এভাবেই তার বাড়ি ফেরা।

সে বাড়ী ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু এই বাড়ী আজ আর সেই বাড়ী নেই; বদলে গেছে চিরতরে। ছেলেকে পেয়ে মা শেফালি বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছে। ভিতর ঘরে ছোকানুর অচেতন হয়ে পড়েছিল সেদিন। বেলালও ভাইকে জড়িয়ে কেঁদেছে বহুক্ষণ। গ্রামের লোকজন আলালের বাড়ী ফেরার খবর শুনে দেখতে এসেছে। পুরো বাড়ী লোকে লোকারণ্য। সবাই চলে যাবার পর আলালের কাছে সব কিছু পরিষ্কার হলো। ছোকানুর তাদের বাড়ীতে কিন্তু সামনে আসছে না। সে জানতে পারলো তার প্রাণপ্রিয় ছোকানুর আজ আর তার নেই; সে আজ তারই ছোট ভাই বেলালের স্ত্রী। সব জেনে আলাল নিথর হয়ে বসেছিল সারাটা বিকেল; কিছুই মুখে তোলেনি সে। দিনের শেষে রাত এলো। বহু রাত অব্দি মা ছেলে শুয়ে বসে অনেক কথা হলো। এ কথা সে কথা অনেক কথা, যুদ্ধের কথা। কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না শেফালী ছেলেকে- কিভাবে বেলাল আর ছোকানুরের বিয়ে হলো। বার বার চেষ্টা করেও পারেনি। অবশেষে ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। এরি ফাঁকে সবার অগোচরে রাতের আঁধারে আলাল তার আশৈশবের লালিত আবাসভূমি রসুলপুর ছেড়ে চির দিনের জন্য চলে গেল। কেউ দেখেনি তার চিরপ্রস্থানের সেই দৃশ্য শুধু গুটিকতক নিশাচর পাখী ছাড়া। বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাল যুদ্ধ করে দেশ জয় করেছে ঠিকই, কিন্তু নিয়তির যুদ্ধে হেরে গেছে সে। প্রাণের প্রিয় ছোকানুরকে হারিয়ে সে আজ নিঃস্ব। গ্রাম থেকে চিরবিদায় নিয়ে অজানার পথে পাড়ি জমায় সে। কোথায় গেছে কেউ জানে না, কেউ আর কোনদিন দেখেনি আলালকে।

আলালের গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার কয়েক মাসের মাথায় শেফালীও চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে। আঁতুড় ঘরে মা হারা শেফালী মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বিধবা হয়ে একমাত্র সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে একাকী কাটিয়েছে বাকীটা জীবন - শুধু এতটুকু সুখের আশায়। সেই সুখ কোনদিনই ধরা দেয়নি শেফালীকে, সেই সুখ “অধরাই” রয়ে গেছে চির দুঃখিনী শেফালীর জীবনে।


(পরিবর্তিত আকারে)




Copyright © 2016; all rights reserved to
Atiq Rahman, Beaumont Hills, Sydney.



আগের অংশ









Share on Facebook               Home Page             Published on: 28-Mar-2016

Coming Events: