তুমি রবে নিরবে আশীষ বাবলু
দূর থেকে ভেসে আসছিল বেলা-শেষের গান। পাহাড় থেকে নেচে নেচে ঝরনার পানি আমাদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। বেগমজান তার ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে আমাকে একটা পান বেড় করে দিলেন। পানের উপর রূপালী ঝিলমিল। কবি আসাদ চৌধুরীর ভাষায় একেই বলে “তবক দেয়া পান”। এমন সুস্বাদু পান আমি জীবনেও খাই নাই। এরপর বেগম তার ব্লাউজের ভেতর হাত দিয়ে তুলে আনলেন একটি ছোট্ট নকশী কৌটা। তাতে ভরা ছিল বাবা জর্দা। মেহেন্দি মাখানো আঙ্গুল দিয়ে জর্দা তুলে সে তার পান খাওয়া টুকটুকে লাল ঠোঁটের ফাঁকে কয়েক দানা পুড়ে দিলেন। আমার দিকে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বললেন, জর্দা খাবেন? আমার মাথা ঘুরে গেল, পা ফসকে পরে যাচ্ছিলাম পাহাড়ের খাদে, বেগম দুই হাতে ধরে ফেললেন আমাকে। মেহেন্দি রাঙ্গা হাতে যে এত শক্তি থাকতে পারে সেটা বুঝে ওঠার আগেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল! এরপর বাকী রাত কী আর ঘুম হয় তুমিই বল?
আমি বসে বসে সাজ্জাদ ভাইর গত রাতে দেখা স্বপ্ন উপভোগ করছিলাম। আমি বললাম, সৈয়দ মুজতবা আলী ‘দেশে বিদেশে‘ বইতে লিখেছেন, স্বপ্নেই যদি পোলাও রাঁধবেন তবে ঘি ঢালতে কঞ্জুসি করছেন কেন? ব্যক্তিগত জীবনে আপনি ভদ্রলোক, তাই বলে স্বপ্নেও ভদ্রলোক থাকতে হবে? স্বপ্নের জগতে কোন বিচার ব্যবস্থা নাই। আপনি যা খুশি করতে পারেন। মধুরকে দেখুন মাধুর্যের ওড়না সরিয়ে! সাজ্জাদ ভাই মাথা নামিয়ে বললেন, সেটা তুমি ঠিকই বলেছ তবে কেমন জানি হাত-পা অবশ হয়ে যায়। অভদ্র হতে চাইলেও পারিনা!
সাজ্জাদ ভাইর বয়স এখন পঁয়ষট্টি পেড়িয়ে সত্তরের দিকে যাচ্ছে। তার স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। ভদ্রমহিলা অনেক রোগে ভুগেছেন। অষ্টপ্রহর সাজ্জাদ ভাই স্ত্রীর সেবা-যত্ন করেছেন। ওনাদের একটা ছেলে এখন বিয়ে করে আলাদা বাসায় থাকে। মাঝেমধ্যেই ছেলে, বৌ, নাতিকে নিয়ে সাজ্জাদ ভাইয়ের ওয়াটালগ্রোভের বাসায় আসে। সাজ্জাদ ভাই যান ওদের ইঙ্গেলবার্নের বাসায়। বড় একটা চাকুরী করতেন সাজ্জাদ ভাই, এখন রিটায়ার করেছেন। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। নিজের মত করে জীবন কাটাচ্ছেন। কবিতা, গান, মর্নিং ওয়াক আর কখনো কয়েকজন বন্ধুদের সাথে আড্ডা। মনে আছে ভাবী চলে যাবার পর আমাকে বলেছিলেন, “বুঝলে আশীষ পৃথিবীতে সবচাইতে মূল্যবান মানুষের জীবন। আর বাকি সবই মূল্যহীন”। আমি কবিতা-প্রেমী সাজ্জাদ ভাইকে মজা করে বলেছিলাম, জীবন কাকে বলে? বেঁচে থাকাই কী জীবন? সাজ্জাদ ভাই বলেছিলেন, যেখানে ভালবাসা আছে সেখানেই আছে জীবন। ভাবী চলে যাবার কিছুদিন পর একদিন তাকে দেখে ছিলাম ওয়াটাল গ্রোভের লেকের ধারে বসে আছেন ছল ছল চোখে। আমাকে বলেছিলেন, তোমার ভাবী নেই বুকের অনেক নিচে কি যে কষ্ট হয় তোমাকে বোঝাতে পারবোনা!
আমার সাথে সাজ্জাদ ভাইর পরিচয় ১৫ বছর-তো হবেই। বড় আধুনিক খোলা মনের মানুষ। অনেক বই পড়েন। নতুন একটা ইন্টারেস্টিং কিছু পড়লেই সে ফোনে অথবা বাসায় এসে আমাকে শুনিয়ে যান। একদিন কোন এক দাওয়াতে এক ভদ্রলোক সাজ্জাদ ভাইকে অপমান করার চেষ্টা করেছিলেন। সাজ্জাদ ভাই কিছুই বলেননি। আমি পরদিন ফোন করে বললাম, আপনার কাছেতো শক্ত জবাব ছিল কেন শুনিয়ে দিলেন না? আমাকে বলেছিলেন, জীবন এত ছোট যে মানুষকে কাছে করার সময় কম। সব মানুষই মানুষ। এই সত্যটুকু উপলব্ধি করতে মানুষের আরও অনেক শতাব্দী লেগে যাবে। সাজ্জাদ ভাইকে যত দেখি তত ভাল লাগে। ওনার সাথে কথা বললে মনের মেঘ কেটে যায়। সাজ্জাদ ভাইকে দেখলে বোঝা যায়, কবিতা- গান মানুষের জীবনে ভালবাসা বোধ প্রবাহিত করে। জিজ্ঞেস করলাম বেগমজানের ব্যাপারটা তো স্বপ্নের। গত সপ্তাহে কোল্স-এর ক্যাশ কাউন্টারের যে স্বর্ণকেশী মেয়েটির প্রেমে পরেছিলেন তার কী হলো? ও তুমি সোফিয়ার কথা বলছ! ও অস্ট্রেলিয়ান নয়। ইটালিয়ান। স্প্যাগেটি পার্টি। সব কিছুতেই টমেটো সস। বলে দিলাম, “ফুড হ্যাবিট বদলাও তার পর ভেবে দেখবো”। আমি হলাম গিয়ে ভাত পার্টি। ধুয়া ওঠা গরম ভাতের গন্ধ সংসারে না থাকলে তাকে কী আর সংসার বলে! এই কথার পর আমার না হেসে উপায় ছিলনা। বললাম ভালই করেছেন । মেয়েটির বয়স খুবই কম ছিল। সাজ্জাদ ভাই আমার দিকে একটু শক্ত চোখে তাকালেন, বললেন- ভালবাসার অধিকার কেবল মাত্র যুবক যুবতীদের এমন কথা তোমাকে কে বললো! মানুষের বয়স যত বাড়ে ভালবাসার প্রয়োজন তত বেশি!
কিছুদিন আগে সাজ্জাদ ভাইর বাসায় গিয়েছিলাম। বেশ ফিটফাট ঘরদোর। সেই ভাবী বেঁচে থাকতে যেমন ছিল ঠিক তেমনি আছে। পরিবর্তনের মধ্যে একটা বড় ফ্রেমে বাধানো ভাবির একটা ছবি। ছবিটি এতই জীবন্ত যে জ্বল জ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছিল ফ্রেম থেকে এখনই বেড় হয়ে আমাকে বলবেন, তোমার প্রিয় শুঁটকী ভর্তা বানিয়েছি, আজ কিন্তু ভাত খেয়েই যেতে হবে। আমার খুব রাগ হচ্ছিল ভাবীর উপর। সাজ্জাদ ভাইকে এমন ভাবে একা ফেলে যাওয়া মোটেই ঠিক হয়নি। বললেন, কেমন দেখছো তোমার ভাবীকে? ঠিকঠাক রেখেছি কিনা? দেখলাম ছবির নিচে কতগুলো ফুল। ঐযে বাড়ির পেছনে ফুল গাছগুলো দেখছো সেগুলো সব তোমার ভাবীর হাতে লাগানো। এখনো সমানে ফুল ফুটে যাচ্ছে। আমার কাজ হলো সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ছবির ফ্রেমটা পরিষ্কার করে বাগান থেকে তাজা ফুল তুলে ঐখানে রাখা। তারপর চা খেয়ে তোমার ভাবীকে গান গেয়ে শোনানো। জিজ্ঞেস করলাম কি গান? তোমার ভাবীর প্রিয় গান রবীন্দ্র সঙ্গীত। সাজ্জাদ ভাই চোখ বুজে গান ধরল...কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয়না/ মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাইনা। সাজ্জাদ ভাইর গলায় খুবই দরদ। চোখের জল ধরে রাখতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। ভাবী ঢাকায় ছায়ানটে গান শিখতেন।
তোমার ভাবীর অসংখ্য মধুর স্মৃতি আর রবীন্দ্রনাথ আমাকে বড় শক্তি দেয়। তুমি-তো জানো এমন কোন বিয়োগ বেদনা নেই যা রবীন্দ্রনাথ পাননি। আমার জন্মের পর পরই মা মারা গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও মায়ের স্নেহ কাকে বলে জানতেন না। প্রথম জীবনে বৌদির মৃত্যু তারপর স্ত্রীর মৃত্যু। সন্তানরা তখন সবাই ছোট। তারপর মেয়ের মৃত্যু, নাতির মৃত্যু। তারপর পুত্রের মৃত্যু। কি ভয়াবহ সেই শোক। এই দুঃখী মানুষটি কি করে লিখলেন, আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। কি করে গেয়েছেন, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধুহে আমার....। আমি বললাম, এসব-তো রইলই আপনি আমার একটা কথা রাখুন, একটা বিয়ে করুন। হাসতে হাসতে সাজ্জাদ ভাই বললেন, তুমি জান, যখন রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মারা যায় তখন তার বয়স কত ছিল? মাত্র চল্লিশ বছর। কবি অনায়াসে বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু করেন নি। আর আমার বয়স পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে। তোমার ভাবীর স্মৃতির উপর আরেকটা স্মৃতির বোঝা চাপিয়ে কি লাভ? আর আমিতো বসে নেই। প্রতিদিন প্রেমে পড়ছি আর তোমার ভাবীকে এসে আমার প্রেমের গল্প শোনাই। সে রাগ করেনা, শুধু মিটি মিটি হাসে। তোমার ভাবীর প্রিয় গান ছিল - এই বলে সাজ্জদ ভাই গাইতে শুরু করলেন, জাগিবে একাকী তব করুন আঁখি, তব অঞ্চল ছায়ায় মোরে রহিবে ঢাকি, মম দুঃখ বেদন মম সফল স্বপন, তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী সম, তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|