আমার ট্রেনের সহযাত্রীরা আশীষ বাবলু
ইদানীং অফিস বদল হওয়ায় আমি ট্রেনেই যাতায়াত করি। গত দশ বছর কী তারও বেশি হবে গাড়ীই ছিল আমার একমাত্র বাহন। তবে ট্রেন যাতায়াতের একটা আলাদা মজা আছে। যদিও অফিসে যাওয়াটা খুব একটা আনন্দের ব্যাপার নয়, তবে ট্রেনের সময়টুকু বেশ আনন্দেই কাটে। আমি প্রতিদিন যে কামরায় উঠি তার অর্ধেক মানুষ আমার পরিচিত। বলছিলাম চেহারাগুলো আমার পরিচিত। কোন মহিলা কিছুদিন অন্তর নখের ডিজাইন বদলান, গত সপ্তাহে কোন মহিলা লম্বা চুল ছোট করেছেন, কোন ভদ্রলোক হঠাৎ করে গোঁফ উড়িয়ে দিয়েছেন, এমনকি গোলগাল বিড়াল বিড়াল দেখতে জালনার সিটে বসা ভদ্রলোক কবে চশমার ফ্রেম বদলেছেন আমি বলে দিতে পারি। সেন্টের গন্ধ শুকে আমি বলে দিতে পারি কোন মহিলা আমার আশে পাশে বসেছেন। প্রত্যেক ফুলের যেমন আলাদা আলাদা গন্ধ প্রত্যেক মেয়েরও তাই!
আমি যে লাইনের ট্রেনে উঠি সেই ট্রেনটি ম্যাকার্থার থেকে আসে। আশেপাশে প্রচুর বাংলাদেশী মানুষের বাস। আমার কামরায় দু‘একজন বাংলাদেশের মানুষ প্রতিদিনই থাকেন। ট্রেনে উঠেই তাদের অধিকাংশ টেলিফোনে কথা বলেন, উচ্চস্বরে। এদের কারও সাথে আমার বাক্যালাপ হয়নি তবে এদের ব্যক্তিগত অনেক খবরা খবর আমি রাখি। প্রতিদিন আমি চোখ বন্ধ করে মধুর বাংলা ভাষায় তেনাদের আলাপ-চারিতা শ্রবণ করি। যদিও আড়ি পেতে শোনা অন্যায়, কিন্তু কানে তুলা দিয়ে থাকাও সম্ভব হয়না, গুরুজনরা বলেছেন, রাস্তা ঘাটে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। হানিফ সংকেতের মত দেখতে যে ভদ্রলোক চেক-শার্ট পরেন, তা‘র দুটি কন্যা। একটিকে বাংলা স্কুলে দিয়েছেন, তবে ছোটটিকে তিনি বেঁচে থাকতে কখনোই দেবেন না। সে মায়ের কসম খেয়েছেন। কেন দেবেন না সে কারণ আমি জানি তবে আপনাদের বলা সম্ভব নয় কেননা তা বলতে গেলে আমাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস উনসত্তর সাল থেকে শুরু করে দুহাজার সতের সাল পর্যন্ত বলতে হবে!
আরেক ভদ্রলোক আছেন বেশ সিরিয়াস মুখ, চুলের মাঝখানে সিঁথি করেন। নিশ্চয় খেতে ভালবাসেন অথবা স্ত্রী প্রতি সপ্তাহে দুই দিন বিরিয়ানি রান্না করে। স্বাস্থ্য খুবই ভাল। তিনি সিটে বসার পর কারো সম্ভব হয়না পাশে বসার। জায়গা বাঁচলে তো বসবে! এই ভদ্রলোক সব সময় একটা সমস্যার মধ্যে থাকেন। তিনি নতুন বাড়ী বানাচ্ছেন। ড্রাইভওয়ে ঢালাই হয়েছে, সমস্যা হচ্ছে যেদিকে ড্রেন তার উল্টো দিকে পানি যায়! তা‘র আরেক সমস্যা শাশুড়িকে পছন্দ করেন না। নাম দিয়েছেন ‘চোত্রাপাতা’। স্ত্রীকে বলে-দিয়েছেন চোত্রাপাতা নতুন বাড়ীতে থাকতে পারবেন না। শশুর থাকেন আপত্তি নাই, উনি নামাজ রোজা নিয়ে থাকেন শাশুড়ির মত সব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।
চল্লিশ বছর বয়স হবে তৈলাক্ত ফর্সা মতন অন্য আরেক ভদ্রলোকের। আমিই তৈলাক্ত নামটা দিয়েছি। উনি মাথায় চপচপে তেল মাখেন। শুধু মাথায় কেন সারা শরীর তার তেলতেলে। আমার মনে হয় উনি তেল মাখা বন্ধ করে দিলে বাজারে তেলের দাম পড়ে যাবে। উনি একজন প্রেমিক মানুষ। উনি উচ্চস্বরে টেলিফোনে প্রেম করেন। - তোমারে দেখার জন্যইতো ইকবাল ভাইর বাড়ীতে গেলাম। তুমি আসলা, কিন্তু আমারে তেমন পাত্তাই দিলানা। রান্না ঘরে ভাবীর সাথে গুজুর গুজুর করলা সারা সন্ধ্যা। গত সপ্তাহে তোমারে একটা চাদর কিন্না দিলাম, হেই-ডা পর নাই কেন? এই ভদ্রলোকের মনটা খুব উদার। বেশ দেয়া-থোয়া করেন। গত সপ্তাহে জুতা কিনে দিয়েছিলেন প্রেমিকাকে। যদিও পায়ে ফিট হয়নাই, সাইজ ছোট ছিল। একটা ব্যাপার শুধু ভদ্রলোকের আমার একদম পছন্দ হয়না। উনি যখন টেলিফোনে কথা বলেন একটা আঙ্গুল সবসময় নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন। প্রেমিকার সাথে কথা বলার সময় নাক-খোটা অমার্জনীয় অপরাধ।
আর যে মহিলা মিষ্টিমেয়ে কবরীর মত চেহারা, ঠিক কত বয়স হবে বোঝা যায়না। তিনি বেশ গোছগাছ করে সিটে বসেন। খুব সন্তর্পণে ব্যাগ থেকে টেলিফোন বের করেন, নাম্বার টিপে যে কথাটা ফিসফিস করে বলেন সেটা হচ্ছে, গতকাল টেলিফোন দেও নাই ক্যান? ঐ প্রান্তে নিশ্চয়ই একটা কারণ বলেছেন, তারপর সেই কবরী মার্কা হাসি। ’ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আমিতো অপেক্ষায় থাকি’। একটু বিরতি। ঐ প্রান্তের কথা শুনে মহিলার চোখে মুখে আনন্দ চিকমিক করে। যেখানে ভালবাসা সেখানেই জীবন, সেখানেই আনন্দ। জানি ভদ্রমহিলার এই প্রেমটা ‘পরকীয়া’। তবে প্রেমের ক্ষেত্রে এই পরকীয়া শব্দটা আমার পছন্দ হয় না। ভালবাসাকে ভালবাসাই থাকতে দাও তাকে অন্য একটা নাম দেবার কোন অর্থ নেই।
ট্রেনে এইসব ব্যাপার গুলো আমাকে বড় কসরত করে দেখতে এবং শুনতে হয়। ঈশ্বরের উচিত ছিল মানুষকে দুটোর বেশি চোখ এবং কান দেওয়া, এইসব বিশেষ বিশেষ সময়ে ব্যাবহারের জন্য।
যাইহোক, যে মহিলাটি আমার পছন্দের, যে ট্রেনে উঠলে আমার মনের মধ্যে টুং টাং সেতার বেজে ওঠে, তা‘র সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। জানবো কী করে? উনি কখনো টেলিফোনে কথা বলেন না । তা‘র কখনো কোন ফোনও আসেনা। এমনও হতে পারে সিডনিতে বসবাসকারী একমাত্র মহিলা যার টেলিফোন নেই। তিনি ট্রেনে উঠে তা’র মেজেন্টা রঙের ব্যাগ থেকে একটি বাংলা পত্রিকা বের করেন। পত্রিকা পড়তে পড়তে মুচকি মুচকি হাসেন। ভদ্রমহিলা টান টান করে চুল বাধেন। তিনি কোনোকালে মেকআপ নেন বলে মনে হয়না। বিনা খরচে চেহারার সৌন্দর্য বাড়াতে হলে তোমাকে হাসতে হবে। কথাটা যে কতটা সত্য ভদ্রমহিলাকে দেখে বোঝাযায়। বলতে দ্বিধা নেই আমার এই বাংলা লেখালেখির পেছনে এটাও একটি কারণ। জীবনে কিছু করতে হলে ’প্রেরণার’ তো একটা প্রয়োজন আছে কী বলেন?
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|