তোমার ভাষা বোঝার আশা আশীষ বাবলু
এ্যাশফিল্ড পার্কের বই মেলা তখন জমজমাট। মঞ্চে একের পর এক অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি একটু ভিড় বাঁচিয়ে দূরে একটা বেঞ্চিতে বসে ছিলাম। সকালের সতেজ হাওয়া শরীরকে বেশ আরাম দিচ্ছিল। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে আমার বেঞ্চির পাশে পাতাভরা গাছটায় নিচে একটা চাদর বিছিয়ে বসলো। বয়স পঁচিশ তিরিশের বেশি হবেনা। মেয়েটির চেহারা মনে হলো চিন দেশীয় আর ছেলেটির নীল চোখ আর লাল চুল যাদের আমরা সাদা বলে থাকি। ওরা নব্য প্রেমিক প্রেমিকা, কেননা চাদর বিছাবার আগে ওরা একটা চুমু খেলো এবং চাদর বিছাবার পর আরেকটা চুমু খেল। বিবাহিত হলে এত ঘনঘন চুমু খেতনা। ওদিকে মঞ্চ থেকে ভেসে আসছে গান। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন আমার কান শুনছে গান আর আমার তেরছা চোখ দেখছে প্রেমিক প্রেমিকাদের নব প্রেমধারা। ওরা এখন জীবনের এমন একটা সময় কাটাচ্ছে যে চার-পাশে কী ঘটছে তা নিয়ে ওদের কিচ্ছু যায় আসেনা। আমার মত একটা বেশরম লোক যে ওদের পাশে বসে আছে তানিয়েও ওদের এতটুকু মাথাব্যথা নেই। হঠাৎ করে আমি একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলাম। আবিষ্কার করলাম এই ছেলে-মেয়ে দুইজনই বোবা!
মাতৃভাষার জন্য নিবেদিত ২১ শের অনুষ্ঠানে বসে চট করে যে প্রশ্নটা আমার মাথায় এলো সেটা হচ্ছে, আচ্ছা ওদের মাতৃভাষা কি? হ্যাঁ ওদের মায়েদের মুখে একটা ভাষা নিশ্চয়ই আছে, তাতে ওদের কি আসে যায়। ওরা যে ভাষায় কথা বলে সেটা কি কোন ভাষাবিদদের এক্তিয়ারে পরে? এইতো এখন ওরা যে ভাষায় কথা বলছে, এই চোখের ভাষা, এই হৃদয়ের ভাষা এসবের কী কোন মূল্য নেই! শুধু জীব ব্যাবহার করে বলতে পারাটাই কি সব? আমার ইউনিভার্সিটির জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ছেলে মেয়ে মিলিয়ে আমাদের ৬/৭ জনের একটা গ্রুপ ছিল। যে যাই বলুক ছেলে মেয়েদের মধ্যে স্রেফ বন্ধুত্ব খুব বেশি দিন থাকেনা, একটা প্রেম জাতিয় ব্যাপার চলে আসে। গ্রুপের একটি মেয়ের প্রতি আমার ভালোলাগা ক্রমে ক্রমে ভালবাসায় রূপান্তরিত হলো। মেয়েটিকে না না ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মেয়েটির হৃদপিণ্ড পাথর দিয়ে তৈরি। আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিল না। একদিন আমার মনোবেদনার কথা চিঠিতে লিখে ওর ব্যাগে গুজে দিলাম। কপাল আমার! সেই মেয়ে চিঠির উত্তরতো দূরে থাক চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার পর্যন্ত করল না। আব্দুল জব্বার আমার মাথায় তখন সকাল সন্ধ্যা হারমনিয়াম বাজিয়ে গান করা শুরু করলেন। রিক্ত হাতে যারে ফিরায়ে দিলে ওগো বন্ধু, বিনিময়ে তার তুমি কি বা পেলে .....। তারপর একদিন আমরা সবাই মিলে গুলিস্তানে সিনেমা দেখতে গিয়েছি। এক লাইনে বসেছি সাত জন। আমার সিট সেই মেয়েটির পাশে। আমি পর্দার দিকে চেয়ে আছি। কবরী সাত সখীকে নিয়ে নদী পার হবে। নৌকার মাঝি ফারুক দাম নিয়ে দামাদামি করছে। হঠাৎ সিটের হাতলের উপর রাখা আমার হাতের উপর আলতো করে মেয়েটি তার হাত রাখলো। খান আতা লিখেছিলেন, চোখের ভাষা বুঝতে হলে চোখের মত চোখ থাকা চাই। আমি ভাবছিলাম হাতের এই ভাষা বুঝতে হলে হাতের মত হাত থাকা চাই। ঐ হাতের চোয়া টুকু কতকিছুই না বুঝিয়ে দিল! পঞ্চাশ বার আই লাভ ইউ বললেও এতটা ইমপ্যাক্ট হতো না!
ভাষা নিয়ে যত রকম কথাই হোক, তবে বলতে বাধা নেই ভাষার আসল কাজ হচ্ছে কমুনিকেশন। আফ্রিকায় আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল, তখন একদলের সাথে অন্য দলের যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছিল বিচ্ছিন্ন। তখন প্রত্যেক দল সৃষ্টি করছিল একটি করে নতুন ভাষা।
পণ্ডিতরা বলেন আমাদের ভাষার বয়স দশ লক্ষ বছর। বর্তমানে ৬০০০টি ভাষা রয়েছে পৃথিবী জুড়ে। আগামী একশ বছরে ২০০০টি ভাষার মৃত্যু হবে। মাত্র দুইশত বছর আগে ইউরোপিয়ানরা যখন এই অস্ট্রেলিয়াতে এসেছিল তখন এখানকার মানুষ ২৫০টি ভাষায় কথা বলতো। এখন মাত্র ১৩টি ভাষা টিকে আছে!
এককালে পৃথিবীর লোক সংখ্যা ছিল অনেক কম অথচ ভাষার সংখ্যা ছিল আজকের চাইতে অনেক বেশি। যোগাযোগ ব্যবস্থার যত উন্নতি হবে ভাষা তত কমে আসবে। গত ২৫ বছরে কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের কল্যাণে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। আজ থেকে পাঁচশ বছর পর পৃথিবী বদলের সাথে সাথে এর শব্দও যাবে পাল্টে। আদম আর ইভ কোন ভাষায় কথা বলতেন তানিয়ে আমি তর্কে যাবনা, স্বর্গে কোন ভাষায় কথা বলা হয় সেটাও এখনো কেউ সঠিক বলতে পারছেনা। তবে বড় বড় ভাষা পণ্ডিতেরা বলছেন পৃথিবীতে আজ থেকে এক বা দেড় হাজার বছর পর মাত্র একটি ভাষা টিকে থাকবে! কি ভয়াবহ ব্যাপার ভেবে দেখুন। আমাদের বাংলা ভাষা থাকবেনা ভাবতেই বুকে কান্নায় ভরে যায়। তবে ইংরেজি থাকবে কিনা সেটাও ভাষা বিজ্ঞানীরা সঠিক বলতে পারছেন না। তবে যে ভাষা যত সিম্পল বা সরল হবে সে ভাষা তত বেশি দিন টিকবে। এই ব্যাপারে যদিও ইংরেজি একটু এগিয়ে। ইংল্যান্ডকে যখন ভাইকিং আক্রমণ করলো তখন শুরু হলো ব্রোকেন ইংরেজির যাত্রা। ওল্ড ইংলিশ বদলাতে শুরু করলো। এরপর আফ্রিকার ক্রীতদাসেরা যখন ইংল্যান্ডে এলো তখন সহজ করা হলো ইংরেজি গ্রামার। ক্রীতদাসেরা যাতে সহজে ভাষাটা শিখতে পারে। ভাষার ব্যাপারে ইংরেজরা বেশ উদার।
ইদানীং ফেসবুকের দিকে তাকিয়ে দেখুন। খবর পেলেন আপনার বন্ধুর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। আপনাকে লিখতে হবেনা, তোমার বিবাহ বিচ্ছেদের খবর পেয়ে খুবই দুঃখ পেলাম। তার বদলে চোখের জল ফেলছে এমন একটা ইমোজি টুক করে পাঠিয়ে দিন। আপনার অনুভূতির প্রকাশ হয়ে গেল। অশ্রু জল যদি না ফেলতে চান, একটা ভাঙ্গা হৃদয় পাঠিয়ে দিন, একই কাজ উদ্ধার হবে। শুনলে আশ্চর্য হবেন প্রতিদিন ৯০০মিলিয়ন ইমোজি ব্যাবহার হচ্ছে শুধু ফেসবুকে! এ পর্যন্ত ইমোজির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪২৩টি। ওয়ার্ল্ড ইমোজি এ্যাওয়ার্ড দেওয়া হচ্ছে প্রতি বছর। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যেমন রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে আন্তর্জাতিক ইমোজি দিবস। আপনি বলবেন ইমোজি দিয়ে-তো আর গল্প কবিতা লেখা যাবেনা! সেটাও হবে। ইমোজি দিয়ে সিনেমা হয়েছে। রাগি রাগি চেহারার ভিলেন হাসি হাসি মুখের নায়িকাকে তারা করছে, আর নায়িকা চোখের জল ফেলছে! ইমোজি দিয়ে সুন্দরী গায়িকা কেটি প্যারি গান ও গেয়েছে। গানের লিরিক্স ইমোজি দিয়ে লেখা। ইন্টারনেটে ROAR শুনে দেখতে পারেন।
আমদের ভাষা যে কোন দিকে যাচ্ছে আমরা জানিনা। এত সব ভাবতে আমি যখন চিন্তিত তখন যে গাছের নিচে ঔ ছেলে মেয়ে দুটি বসে ছিল সেই গাছটার পাতার ফাকে কয়েকটা পাখি কিচির মিচির করে ডেকে উঠলো। ওরাই বা কি কথা বলছে? সুখের কথা নাকি দুঃখের কথা?
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|