তালাক দেয়না, কবর দেয়! আশীষ বাবলু
লিখে বেশ আনন্দ পাচ্ছি। আমার জন্য লেখার সবচাইতে সুখের ব্যাপার হচ্ছে পাঠকদের সাথে এখানে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। তাদের সাথে দুঃখ, আনন্দ, হাসি, কান্না ভাগ করে নেওয়া। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি।
কখনো ভাবতে বসি কয়েক হাজার বাংলা-সিডনির পাঠক আমার এই লেখা দেখে। তা’র মধ্যে এক হাজার না হোক, পাঁচশ’ না হোক, একশ মানুষ এই লেখা নিশ্চয়ই পড়বে। এই একশ মানুষকে যদি বাসায় ডেকে চা-বিস্কুট খেতে দেই তবে কোথায় বসাব? আমার ছোট্ট বাড়িতে কি জায়গা হবে? হবেনা কেন? কেউ বসবেন, কেউ না হয় দাঁড়িয়ে থাকবেন! প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলে বলবো, না না কোন জন্মদিন বা বিবাহ বার্ষিকীর পার্টি নয় এরা আমার প্রিয় মানুষ, আমার লেখা ভালবেসে পড়েন!
আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে আমার ট্রেনের সহযাত্রীদের নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। খুবই সাধারণ লেখা। প্রত্যেকদিন ট্রেনের একটি নির্দিষ্ট কামরায় যাতায়াতের কারণে কিছু চেনা মুখের সাথে পরিচয়। পরিচয়টা হচ্ছে ওনাদের মোবাইল ফোনে জোড়ে জোড়ে কথা বলার সুবাদে অনেক ব্যক্তিগত খবর আমি জানতে পারি, সেই বিষয়ে। এক মহিলার কথা লিখেছিলাম, তিনি ফিসফিস করে অথচ বেশ জোড়ে কথা বলেন এবং মনে হয় পরকীয়া প্রেম করছেন! এই ছিল আমার গল্প।
সেই লেখার মাস খানেক পর একদিন কি হল এক ভদ্রলোক হঠাৎ করে আমার বাসায় এসে হাজির। বললেন, আপনি আমাকে চিনবেন না, অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা জোগাড় করেছি। আপনার লেখা আমি পড়ি। আমি বললাম, আমার সৌভাগ্য! আমার মত সামান্য একজনের লেখা আপনি পড়েন। আমার দু-একটা লেখা সম্বন্ধে তিনি বললেন, বুঝলাম ভুল বলছেন না। ভদ্রলোকের জন্য তাড়াতাড়ি চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করলাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেককেই বলতে শুনি দাদা আপনার লেখা দেখলাম, লেখা পড়েছি খুব কম মানুষই বলেন!
তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আপনার ট্রেন যাত্রীর গল্পটা পড়েছি। সেই লেখার একটি প্রসঙ্গ নিয়েই আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। সিরিয়াস মুখ করে বললেন আপনি যে মহিলার কথা লিখেছেন, ঐ যে ফিশ ফিশ করে কথা বলে, আমার মনে হয় আপনি আমার স্ত্রীর কথা লিখেছেন! আমি এই কথা শুনে হতভম্ব! বলছেন কী ভদ্রলোক! নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম, না না ওটা বানানো গল্প, আপনি এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ভদ্রলোক আমার মুখ-থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ঐযে ছোট চুল লিখেছেন, লাল ব্যাগ থেকে ফোন বেড় করে! বললাম এমন ছোট চুল লাল ব্যাগ কত মেয়েরইতো আছে। ঐ যে হাসলে গালে টোল পড়ে লিখেছেন?
আমি অনেক করে বুঝিয়ে ভদ্রলোককে বিদায় করলাম। তবে মনে হয়না আমি বোঝাতে পেরেছি। ভদ্রলোক গম্ভীর এবং চিন্তিত মুখ নিয়েই বিদায় নিলেন।
ভেবেছিলাম ঘটনাটা এখানেই শেষ হবে। কিন্তু হলোনা। একদিন বাসায় কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দেখি সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। আমি বললাম আসুন ভেতরে। উনি বললেন, না আজকে আর বসবোনা দাদা, আমি ঐদিকটায় গাড়ী পার্ক করেছি আপনি একটু চলুন, আপনাকে কিছু দেখাবো।
গাড়ির পাশে গিয়ে দেখি একজন মহিলা বসে আছেন। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক বললেন- আমার স্ত্রী, আমি বললাম, আসুন না ভেতরে। ভদ্রমহিলা গালে টোল পড়া একটা হাসি দিয়ে বললেন, অন্য আরেক দিন।
বুঝতে বাকি রইল-না ভদ্রলোক তা’র স্ত্রীকে দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন। সন্দেহ যে মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। সংসারে সন্দেহ প্রবেশ করলে ভালবাসা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সন্দেহ বাতিক বলে একটা কথা এতদিন শুনে এসেছি, এই বাতিক মানুষের জীবনকে যে কী পরিমাণ দুর্বিষহ করে তুলতে পারে তার এক নমুনা এতদিনে দেখলাম। বিশ্বাস হারালেই জন্ম নেয় সন্দেহ, তাইনা?
যথারীতি ভদ্রলোক আমাকে ফোন করলেন। একটু চুপ করে ভাবছিলাম কি বলবো! ভদ্রলোকের স্ত্রীকে আমি এর আগে কোনদিনই দেখিনি। তবে মনে হচ্ছিল বলে দেই, হ্যাঁ, আপনার স্ত্রীকেই আমি ট্রেনে দেখেছিলাম। উনিই পরকীয়া প্রেম চালিয়ে যাচ্ছেন।
যদি এই কথা বলে দেই তার পরিণাম কী হবে? ওদের হয়তো ছাড়াছাড়ি হবে। ভালই হবে ঐ উন্মাদ লোকটা থেকে মহিলা রেহাই পাবে! কিন্তু বলতে পারলাম না। বললাম, বিশ্বাস করুন ট্রেনের ঐ মহিলা আপনার স্ত্রী ছিলনা। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। নতুন করে কোন খবর নেই। একদিন ফিস মার্কেটের সামনে সেই ভদ্রলোকের স্ত্রীর সাথে দেখা। উনি নিজেই এসে আলাপ করলেন। আপনাদের বাড়ির পাশে দেখা হয়েছিল মনে আছে? সেই গালে টোল খাওয়া হাসি দেখে চিনে ফেললাম। তা’র স্বামী ভদ্রলোকের খবর জিজ্ঞেস করলাম। বক বক করে স্বামী প্রসঙ্গে অনেক কথাই বললেন। তবে খারাপ কিছু নয়। স্বামীর প্রিয় রূপচান্দা কিনতেই ফিস মার্কেটে এসেছেন। ভদ্রমহিলা কথা বলতে ভালবাসেন। আমি বাঙ্গালী মেয়েদের যতটুকু দেখেছি সে বাইরে যতই পেখম ছড়াক, মনে মনে এখনো পর্দানশিন। যারা কিছুটা খোলস মুক্ত তারা হয় একটু বয়স বেশি না হয় কয়েক সন্তানের মা। তবে এই মহিলা একটু ব্যতিক্রম, বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে বলে মনে হলো না। তবে এই মহিলা বড্ড খোলামেলা।
ততক্ষণে ভদ্রমহিলা ঢাকার কোথায় থাকতেন, কোন স্কুল, তার বড় ভাই কানাডার মন্ট্রিয়ালে মেম সাহেব বিয়ে করেছেন, আমাকে বলে ফেলেছেন। কথার ফাঁকে সেই টোল খাওয়া হাসি। মহিলার সহজ সরল অভিব্যক্তি বেশ উপভোগ করছিলাম। বললেন, তা’র বড় বোনও এখানে থাকেন। তবে আপার সময়টা ভাল যাচ্ছেনা। দোয়া করবেন। সমস্যা হচ্ছে বিয়ে নিয়ে, এমনিতে স্বামীটা খারাপ না, তবে পোকার মেশিনের নেশা। উঠতে বসতে আপাকে বলে তালাক দিমু। আমি সেদিন বইলা দিছি, আমরা যে খান্দান থিকা আসছি, সেখানে তালাক দেয়না, কবর দেয়!
আমি না হেসে পারিনি। বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই সন্দেহ বাতিক মানুষটার কথা মনে পড়লো। এমন একজন স্ত্রীকে সন্দেহের চোখে দেখছেন? এমন নির্ভেজাল একজন মহিলার সোনায় বাধানো মনটা গাধাটার একটুকুও চোখে পড়েনি?
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|