স্বপ্ন দিয়ে তৈরি আর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা আশিষ বাবলু
শেষ হলো ছুটির দিন। এখন মন খারাপের সময়। ডিসেম্বর আর জানুয়ারি এই দুটো মাস এখানে বড় আনন্দের। অফিস কাচারিতে কাজকর্ম ঢিলেঢালা। খৃষ্টমাস, নিউ-ইয়ার, সবাই মিলে আনন্দ করার মজাই আলাদা। আর একটু দীর্ঘ ছুটি পেলে যে কথাটা প্রথম মাথায় আসে সেটা হচ্ছে মন চল যাই ভ্রমণে। কোথায় যাচ্ছি কত দূর কতদিনের বেড়ানো এ সব বাজে, কাজের শুধু উঠন টুকু পেরোনো। পায়ের তলায় শেকড় গজাতে দেওয়া চলবে না। জীবনে গতি চাই। গতি যখনই থেমে যাবে বুঝতে হবে দরজায় কড়া নাড়ছে দুর্গতি। স্কুলে ভূগোলের ম্যাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। তখন আশ্চর্য হয়েছিলাম জেনে যে পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। এখন জগৎ দেখতে দেখতে বুঝেছি পৃথিবীর তিন ভাগ দুঃখ আর একভাগ সুখ। এই একভাগ সুখের সন্ধানে অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি নেবার কঠিন বাস্তবতা বাংলাদেশের মানুষের চাইতে বেশী কে জানে? পৃথিবীর কোন স্থান নেই যেখানে বঙ্গ-সন্তানের পায়ের স্পর্শ পড়েনি। পৃথিবীর কোন মাটি নেই যেখানে তাদের দু’এক ফেটা ঘামের চিহ্ন নেই, সাথে চোখের জল। এককালে সংসার বিরাগীরা নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করতেন সংসার থেকে পালাতে। কাঁধে থাকতো চিড়ে, বাতাসার ঝোলা আর মাথার উপর টেম্পোরারি চাঁদ, সূর্য। দিন বদলেছে। এখন সংসার থেকে পালাতে নয়, সংসার চালাতে হাজার হাজার মানুষ অনিশ্চয়তার সাগরে ঝাপ দিচ্ছে। অবশেষে কোন বন্দরে পায়ের তলায় মাটি। তাদের কাছে নাম্বার ওয়ান টুরিস্ট ডেসটিনেশন হলো বাংলাদেশ মাই হোম। আমাদের পাড়ার একটা আধপাগল লোক ছিল। স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, না আছে আত্মিয় স্বজন, ঘর বাড়ী। আবাস বলতে গাছের তলা। পাড়ার লোকদের ফুটফরমাশ খাঁটতো। ওকে বেশিদিন ধরে রাখা যেত না। বলতো বাড়ী যাবো? কার বাড়ী, কোথায় সে যাবে আমরা ভেবে হয়রান হতাম। এখন বুঝতে পারি যার কিছুই নেই তারও একটা বাড়ী আছে, তারও একটা দেশ আছে। বাড়ী ছাড়া, দেশ ছাড়া মানুষ হয় না। এ বাড়ী দালান কোঠার বাড়ী নয়, এ বাড়ী হচ্ছে আমাদের মনোভূমি। সেই মনোভূমি স্বপ্ন দিয়ে তৈরি আর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। এই দেশে যাবার প্রস্তুতি সেই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়। কতদিনের জন্য যাচ্ছেন? কোন এয়ার লাইন্সে? কতদিয়ে টিকিট করলেন? আশ্চর্য! আপনিতো ত্রিশ ডলার কমে করেছেন। লাগেজ কতটা নিতে পারবেন? বলেন কি? আমাকেতো বলা হয়েছে ২০ কিলোর একটুও বেশি নিতে পারবো না। এতদিন পর দেশে যাচ্ছি সুটকেস খোলার পর যদি দ্যাখে কিছুই নেই, তবে আত্মিয় স্বজন বড় দুঃখ পাবে। ভাববে সিডনীতে বড় অভাবের মধ্যে আছি। যেদিন গিয়ে পৌঁছবো সেদিন হরতাল! কোন চিন্তা নাই, দুলাভাই সাংবাদিক, তিনি প্রেসের গাড়ী নিয়ে আসবেন। আপনার কি হবে? আমার মামা আমাদের পিক করতে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসবেন। আমি একটু থতমত খাই। বাড়ীতে এ্যাম্বুলেন্স এর আগমন খুব একটা সুখের ব্যাপার নয়। অথচ কল্পনা করুন বাড়ীর সমানে এ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালো। সেই এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামলো শক্ত সমর্থ স্বামী, স্ত্রী এবং তাগড়া দুটো বাচ্চা উইথ লাগেজ। টিকিট, ভিসা, শপিং তো হলো, এখন এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেনে বসা অব্দি আরেক নাটক। প্লেন কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতার কারণে টিকিটের দাম কমিয়েছে। তবে দুই এক কিলো মাল বেশি হলে আর রক্ষা নেই। অনেক টাকা খেসারত দিতে হয়। ব্যাগে দুই কিলো বেশি, বের করুন। হাত ব্যাগে দশ কিলোর বেশি হচ্ছে, নামান। এরপর সিকিউরিটি চেক। হ্যান্ড ব্যাগে এত মিলিগ্রামের বেশি সেন্ট পারবেন না নিতে। দামি জিনিস তবু ফেলে দিতে হবে। হংকং এয়ারপোর্টে আমার হাতব্যাগে দুটো ৯০ গ্রামের টুনা ফিসের কৌটা নিতে দেবে না। আমি বললাম কেন ভাই, এটাতো মাছ। না ওটাতে লিকুইড আছে। আমি জানি এই কর্মকর্তাটি আজ বাসায় গিয়ে আমার এই জন ওয়েস্ট কোম্পানির টুনাফিস সপরিবারে খাবেন। আমি ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বললাম, একটু পেয়াজ ভেজে, টুনা মাছটা একটু নেড়ে নেবেন। খুব মজা হবে খেতে। এক্সরে মেশিন দিয়ে হাতে যা আছে তার পরীক্ষা। ব্যাগের মধ্যে দুটো গোল কিছু দেখা যাচ্ছে, এটা কি? ক্রিকেট বল? আমি বললাম “না”। এ্যাপেল? অরেঞ্জ? আমি বললাম “না”। তবে কি? চার-পাঁচজন সিকিউরিটির লোক জড়ো হয়ে গেল। ব্যাগটা কি আপনি গুছিয়েছেন? আমি বললাম “হ্যাঁ”। তবে ওই গোল দুটো কি? কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। একজন নার্ভাস টাইপের সিকিউরিটির লোক বলে ফেললো - ‘কল আওয়ার বোম্ব স্কোয়াড’। আমিতো লজ্জায় কাচুঁ মাচুঁ। ব্যাগটা একটানে খুলে ফেললাম। ভেতর থেকে বের হলো বড় দুটো গোল সাবান। কখন রেখেছিলাম মনেই ছিলনা। ওদিকে এক বছরের একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে এক ভদ্রলোক সিকিউরিটি চেকিং এর অফিসারটিকে অনুনয় করছে তার বাচ্চাটাকে একটু এক্সরে মেশিনের মধ্যদিয়ে পাস করাতে। হোয়াই ? ভদ্রলোক খুবই চিন্তিত মুখে বললেন -‘বাচ্চাটা মনে হচ্ছে একটা সেপ্টিপিন খেয়ে ফেলেছে..... আমি একটু কনফার্ম হতে চাই‘....। তবে সিডনী এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক দুটো ডাঁসা পেয়ারা বসে তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছিলেন। তাকে পেয়ারা নিয়ে ঢুকতে দেবে না। জানেন না গ্রিন নট এ্যালাউড? আমিতো ডিক্লেয়ার করছি। ও দুটো বিনে ফেলে দিন। সেটা সম্ভব নয়,জাস্ট গিভ মি ফাইভ মিনিটস। ভদ্রলোক আরাম করে বসে পেয়ারা দুটো খেয়ে তারপর বেরিয়েছিলেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে এসব ব্যাপারে আরো এক কদম এগিয়ে গেছে। হ্যান্ড-ব্যাগ চেকিং, শরীর তল্লাসি, ম্যাচ আছে? লাইটার? নেইল কাটার? শরীর তল্লাসির নামে বগলে সুড়সুড়ি। বিরক্ত হয়ে বললাম এমন অপদস্থ করছেন কেন? মোটা মতন অফিসারটি গম্ভীর হয়ে বললেন, খবর রাখেন না পৃথিবীতে কত প্লেন হাইজ্যাক হচ্ছে? আমি বললাম-আজ পর্যন্ত কোন বাঙ্গালী প্লেন হাইজ্যাক করেছে শুনেছেন? ভদ্রলোক আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন মনে হচ্ছিল আমি বুঝি প্রথম বাঙ্গালী প্লেন হাইজ্যাকার।
ashisbablu13@yahoo.com.au
|