রাজ্জাক ভাই : কিছু স্মৃতি কিছু কথা আশীষ বাবলু
খবরটা পেয়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। রাজ্জাক ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমাদের সিডনিতে অনেক বাঙ্গালির বসবাস এখন। সত্যি কথা বলতে মহৎ বা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ বড় দুর্লভ। মাঝারি নিম্ন মাঝারি অনেক আছেন তবে আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষের বড় অভাব। ল্যাকেম্বা মসজিদে কফিনে চির সজ্জায় রাজ্জাক ভাইকে দেখে মনে হলো ঘর সংসার পড়ে আছে, স্ত্রী সন্তান, আত্মীয় স্বজন আর সিডনির অগুনিত শুভানুধ্যায়ীদের ছেড়ে তিনি চলছেন অন্তিম যাত্রায়। মনে হচ্ছিল এখনই উঠে বসবেন। সুগন্ধি পান পরাগের ডিব্বা খুলতে খুলতে বলবেন, একটু দিবানিদ্রায় চলে গিয়েছিলাম। আপনারা কেমন আছেন?
রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হবার প্রথম দিনটি ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। শুধু আমার কেন সে দিন অনুষ্ঠানে যারা যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কারোই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। উজ্জ্বল দা’র নেতৃত্বে আমরা মাত্র ক‘জন বঙ্গবন্ধু পরিষদের যাত্রা সন্তর্পণে শুরু করেছি। আমি সন্তর্পণে কথাটা এইজন্য বললাম তখন সিডনির পরিবেশ আজকের মত ছিলনা। বঙ্গবন্ধুর কথা কোন বাঙ্গালী জলসায় নিম্ন কণ্ঠে ফিসফিস করে বলতে হতো। যাইহোক একটা সংগঠন শেষে দাড়া হলো। সেই অনুষ্ঠান ছিল রক্তাক্ত ১৫ই আগস্ট স্মরণে। মোঃ আলী ভাই রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি কালজয়ী কবিতা পড়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করে ফেললেন। তরুণ ভাই ঘোষণা করলেন একজন বঙ্গবন্ধু প্রেমিক আমাদের মাঝে আছেন, উনি কিছুদিন হলো সপরিবারে সিডনি এসেছেন এবং এই অনুষ্ঠানে কিছু বলবেন। সেই আমার রাজ্জাক ভাইকে প্রথম দর্শন। উনি মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। ঝকঝকে স্বাস্থ্য, চশমার ভেতরে উজ্জ্বল দুটি চোখ, কালো গোঁফ দুইদিকে নামানো। মঞ্চে দাঁড়াবার ভঙ্গিটি বেশ রহস্যময়। নিজের পরিচয় এবং আমেরিকা থেকে এখানে চলে আসার কারণ জানালেন। তার বক্তৃতা দেবার ভঙ্গিটি ছিল খুবই উপভোগ্য। তিনি বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে অনেক কথা বললেন। তারপরই বঙ্গবন্ধু হত্যারা পেছনে আওয়ামী লিগের কিছু নেতার ভূমিকা সবিস্তারে বলতে শুরু করলেন। কিছু ডাই-হার্ড আওয়ামী লিগের ছেলেপেলে ফুসতে শুরু করলো। গামা ভাই গলার স্বর নিচু করে তাদের উত্তেজিত না হবার অনুরোধ করতে লেগে গেলেন। অনুষ্ঠান প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম!
সেদিনই বুঝতে পেড়েছিলাম প্রথাসম্মত মানুষ রাজ্জাক ভাই নন। সবার সাথে খাপ খাওয়াবার মানুষও তিনি নন। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি যুক্তির খাতিরে আদর্শের খাতিরে সবার কাছে প্রিয় হবার দুর্বলতাকে ত্যাগ করতে পারেন। সোজা বাংলায়, যাহা সত্য তাহাই বলিব। শুরু থেকেই মানুষ তাকে সমীহ করতে অথবা ভয় করতে শুরু করেছিল।
এর পরের ঘটনা আমার জন্য আরও ভয়াবহ। আমি জীবনে প্রথম নাটকে অভিনয় করছি। এনাম ভাই, শাহিন শাহ-নেওয়াজ আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি করছেন। সকাল সন্ধ্যা ডায়লগ মুখস্থ করছি। সবসময় বুকে দুর দুর। নাটকের নাম ‘কঞ্জুস’। মনে আছে ফাইকা সাদিকের একটা চরিত্র করার কথা ছিল কিন্তু অনিবার্য কারণে শেষ মুহূর্তে তিনি করতে পারেননি। তার বদলে এলেন আমাদের রুনু ভাবী। রাজ্জাক ভাইয়ের স্ত্রী। নাটকের প্রথম দৃশ্য আমার আর রুনু ভাবির। পর্দা খুললো। গান বাজছে- পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া......। আমি হাঁটু গেড়ে হাঁতে ফুল নিয়ে রুনু ভাবিকে প্রেম নিবেদন করছি। ডায়লগ এখনো মনে আছে, ...একটা কিছু বল পেয়ারে লইলি...। এরপর দাঁড়িয়ে রুনু ভাবি, মানে লায়লীর হাত ধরে সেই গানের সাথে আমার নাচবার কথা। যেই ভাবির হাত ধরতে যাবো হঠাৎ আমার চোখ চলে গেল দর্শকদের দিকে। দেখি রাজ্জাক ভাই সামনের আসনে বসে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছেন। আমার হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেল। ভদ্রলোক যে ভাবে তাকাচ্ছেন, লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠে আমার কলার চেপে না ধরে, আমর স্ত্রীর সাথে প্রেম-পিরীত করছো! আমি ভয়ে রুনু ভাবির হাত ধরছিনা, ভাবি আমাকে নিচু গলায় ধমকের সুরে বললেন, আমার হাত ধরো! কাঁপা কাঁপা হাতে ভাবির হাত ধরলাম। দৃশ্যটা নাচের ছিল বলে ভয়ে আমার শরীরের কম্পন দর্শকরা টের পাননি!
তার পর রাজ্জাক ভাইর সংস্পর্শে আসা শুরু হলো। দুই তিন সিটিং এর পরই ভয় কেটে গেল। অনুভব করলাম শক্ত নারকেলের ভেতর যেমন নরম মিষ্টি জল থাকে, রাজ্জাক ভাই তেমনি। অদ্ভুত নরম একটা মন, খুব কাছে থেকে না দেখলে বোঝা যায়না। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তার আমলেই বৈশাখী মেলা বারউড স্কুল পেড়িয়ে অলিম্পিক পার্কে গিয়েছিল। সেই সময় এটা ছিল একটা বিশাল রিস্কি ডিসিশন। এতগুলো টাকা ভাড়া দেবার মত কমিটমেন্ট। এখনো মনে আছে সেই মেলার আগে আমাকে বলেছিলেন, যদি মেলা সাকসেসফুল না হয় তবে আমাকে জেলে নিতে পারবে না। খুব বেশি হলে আমার বাড়িটা যাবে। একেই বলে বুকের পাটা! কী আশ্চর্য ভাবে তিনি চলে গেলেন এবং অলিম্পিক পার্কে বৈশাখী মেলার পরিসমাপ্তি ঘটলো!
উনি ক্ষমতা থেকে সরে গেছেন অক্ষম হবার অনেক আগে। এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সিডনিতে কেন দেশেও খুব একটা নেই। রাজ্জাক ভাইর সাথে যখনই কথা বলেছি, তিনি বলতেন বাঙ্গালিদের জন্য এটা করা দরকার ওটা করা দরকার। আমি সবসময় ভাবতাম আমাদের নেতারা সাধারণত যা করেছি সেটা বাড়িয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে যা করতে পারেননি তা‘র উল্লেখও করেন না। অথচ উনি উল্টো। সব সময় এই কাজটা করা হয়নি, ঐ কাজটা করা উচিত ছিল। বড় আশ্চর্য মানুষ ছিলেন।
সেদিন ল্যাকেম্বা মসজিদে রাজ্জাক ভাইর জানাজার দিনে আমাদের সবার পরিচিত শেখ শামীমের সাথে কথা হচ্ছিল। শামীম ভাই বললেন, কিছুদিন আগেও যখন তিনি তাকে দেখতে গেছেন, রাজ্জাক ভাই তার জানলা দিয়ে একটা বড় জমি দেখিয়ে বলছিলেন, এই জমিটাতে বাঙ্গালীদের জন্য একটা কমিউনিটি সেন্টার বানাবার চিন্তা ভাবনা করছেন। হায়! স্বপ্ন দেখার সাধ আমার এখনো গেলনা!
রাজ্জাক ভাইর সাথে তা‘র স্ত্রী মানে আমাদের রুনু ভাবির সম্পর্ক ছিল বড় মধুর। সামনা সামনি তাদের ঝগড়া লেগেই থাকতো। কিন্তু একা রাজ্জাক ভাই সব সময় স্ত্রীর প্রশংসা করতেন। খুব ভাল বাসতেন রুনু ভাবিকে। শম্পা সবসময় বলতো রাজ্জাক ভাইকে দেখে স্ত্রীকে কি করে ভালবাসতে হয় শেখো। আমাদের বাসায় অনেক সারপ্রাইজ নিয়ে তিনি এসেছেন। তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন হৈমন্তী শুক্লাকে, হাসান ইমাম, নির্মলেন্দু গুণ, মুনতাসির মামুনকে। তিনি প্রচুর বই পড়তেন। তাই তার সাথে গল্প করলে মনের অন্ধকার দুর হয়ে যেতো। তাকে একটু উসকিয়ে দিলে তিনি অবলীলায় বলে যেতে পারতেন। বলার ধরনটি ছিল বড় সুন্দর। কান খুলে তার প্রতিটি শব্দ উপভোগ করতাম। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, একটা মানুষ চলে যাবার সাথে সাথে একটা গোটা পৃথিবী চলে যায়। তিনি চলে যাবার পর অনুভব করছি কতটা জায়গা জুড়ে তিনি ছিলেন আমাদের জীবনে।
জানি এখন আর কোথাও তার সাথে দেখা হবেনা। মুখে হাসি এনে জিজ্ঞেস করবেননা, কেমন আছেন? তবে তিনি যেখানেই আছেন আমি জানি তিনি ভালই আছেন এবং সেখানেও হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন। রাজ্জাক ভাইয়ের মত মানুষ শুধু নিজেই ভাল থাকেন না, অন্যকেও ভাল রাখেন।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|