রন্টুদা আশীষ বাবলু
ধানমন্ডির মেয়েরা বেশ সুন্দর করে চোখের ভ্রু আঁকে। ঠোটের লিপস্টিকে থাকে একটা চিক্ মিক্ আভা। নেলপলিশ মাখানো টুসটুসে আঙ্গুল দিয়ে কপালের উপর হঠাৎ উৎপাত করা চুল সুন্দর ভঙ্গিমায় মাঝে মাঝে সরিয়ে দেয়। বড় ভাললাগে দেখতে এই পুতুল পুতুল হাবভাব।
রন্টুদা যে কোথা থেকে ওদের বাসায় নিত্য নতুন পরী ধরে আনে ভাবতে অবাক লাগে !
এধরনের সময়ে যখনই আমি হাজির হয়েছি রন্টুদা একটা বিরক্তির ভাব এনে বলতেন, তুই আবার কোথা থেকে এলি ?
‘এই ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম। তোমাদের বাড়ির সামনে এত বড় একটা গাড়ী দাড়িয়ে আছে দেখে ভাবলাম একটা ঢু মেরে যাই।’
রন্টুদা মুখখানা আরো গম্ভীর করে বলতেন, ‘নেক্সট টাইম কোন গাড়ী দাড়িয়ে থাকলে একদম আসবিনা।’
এবারে পরী মুখ খোলে, ‘এভাবে বলছ কেন ? ওকে এক পিস্ কেক দাও।’
পরীরা সাধারণত পেস্ট্রি অথবা ইউসুফ বেকারির চানাচুর নিয়ে আসে। নিজ হাতে কেক তুলে দিতে দিতে টুকটাক প্রশ্ন করে, কি নাম ? কোন ক্লাস ? এই ধরনের।
একজন পরী একবার একটা হলুদ গাড়ী করে এসেছিল, রন্টুদা নিয়ম মতো আমার হঠাৎ অসময়ে আগমনের জন্য জোরে একটা শক্ত অভদ্র কথা বলে ফেলেছিলেন। তখন আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে সেই পরী আমাকে বুকে টেনে নেয়। বকা খাওয়ার এমন সুন্দর রিমেডি আরো কিছুক্ষণ ধরে রাখার জন্য আমি কান্নার মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
আমার কান্নাটা ছিল অভিনয়। এবং আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি রন্টুদার বকাটাও ছিল অভিনয় ! কেননা রন্টুদাই আমাকে বলে রেখেছিলেন আমাদের বাড়ীর নিচে গাড়ী দেখলেই চলে আসবি !
রন্টুদা তা’র মাকে নিয়ে আমাদের পাড়া অর্থাৎ পুরাণ ঢাকার লক্ষী বাজারে থাকতেন। মা মানে দীপা আন্টি যখনই যেতাম কিছুনা কিছু খেতে দিতেন। আন্টি একটা মেয়েদের স্কুলে পড়াতেন। রন্টুদার বাবা শুনেছি অনেক দিন হয়েছে মারা গেছেন। মা আর ছেলের ছোট্ট সংসার। সে বাড়ীর আর একটা আকর্ষণ ছিল এক আলমারি রূপকথার বই। এখনো মনে আছে ‘১০০ ভুতের কাণ্ড’ গোটা পাঁচ বার সেখান থেকে নিয়ে পড়েছিলাম। আর ছিল ঈশপের গল্পের মজার মজার বই। রন্টুদারা ছিলেন খ্রিষ্টান। পোশাকি নাম রোনাল্ড রোজারিও। আমি যে সময়ের কথা লিখছি সে সময় ধর্ম নিয়ে কেউই তেমন মাথা ঘামাতো না।
রন্টুদা ছিলেন ফুটবল প্লেয়ার। ওয়ারী না ওয়ান্ডার্সে খেলতেন আমি এ মুহূর্তে সঠিক মনে করতে পারছিনা। ছয়ফুট লম্বা ঝলমলে এথলেটিক স্বাস্থ্য । আর হাসিটা ছিল ভুবন ভোলানো। তবে হাল্কা হাসি নয়, প্রাণ খোলা, পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে মানুষ খবর পেয়ে যেতো যে রন্টুদা হাসছেন। তবে একা নয়, হাফ ডজন আমারই মত কিশোর বয়সের ছেলে পেলেদের সাথে।
এই কিশোর বয়সটায় একটা বড় সমস্যা হচ্ছে কেউ তেমন পাত্তা দিতে চায়না। আমাদের যে দুনিয়ার সব গোপন ব্যাপার গুলো জানা হয়ে গেছে সেটা কেউ বিশ্বাস করতে চায়না। তবে রন্টুদা আমাদের বুঝতেন। তাই আমাদের হিসেবে রন্টুদার আই-কিউ নিজেদের বাবা জ্যাঠাদের চাইতে বেশি ছিল। রন্টুদা ছিল আমাদের হিরো।
ঢাকার আউটডোর স্টেডিয়ামে যখন প্রাকটিস গেইম হতো রন্টুদা আমাদের মাঝে মধ্যে নিয়ে যেতেন। খেলার মাঝখানে প্লেয়ারদের কোকাকোলা খেতে দিত। আমরাও রন্টুদার গেস্ট হিসেবে একটি করে কোকের বোতল পেতাম। আর খেলা শেষে প্যাটিস। কখনো দেখতাম রন্টুদাকে ভক্তরা নানা প্রশ্ন করতো, কেউ অটোগ্রাফ চাইত । আমাদের খুব গর্ব হতো যে রন্টুদা আমাদের কাছের মানুষ।
পাড়ার ব্যাডমিন্টনের মাঠে হঠাৎ কখনো আবির্ভাব হতো রন্টুদার। কিছুক্ষণ আমাদের খেলা দেখে বলতেন, দে দেখি একটা র্যােকেট।
সে কি খেলা ! নওয়াব বাড়ীর যে ছেলেটি আমাদের মধ্যে সবচাইতে ভাল খেলতো ওর চোখে মুখেও শর্ষে ফুল। পাখিরে পালক লাগানো ফ্লাওয়ার রন্টুদার র্যা কেটের ছোঁওয়ায় প্রাণ ফিরে পেতো। স্কুলে ক্রিকেটের মাঠেও তেমনি। রন্টুদা ব্যাট ঘুরালেই ছয়। বল সোজা প্রাচীর পেড়িয়ে দারোগা বাড়ির বৈঠকখানায়। বল করলে এক ওভারে তিন উইকেট! আর ক্যারাম বোর্ডে এক স্ট্রাইকে কতগুলো গুটি পকেটে ফেলতেন সে কথা আর বলতে চাইনা।
যারা একটি গেইম ভাল খেলে, তারা অন্য গেইম গুলোও ভাল খেলতে পারে।
আরেকটা ঘটনা বলছি। একদিন আমারা কয়েকজন মিলে রন্টুদার সাথে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি দশ বারো জনের একটি জটলা। ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখি মাটিতে একজন বৃদ্ধ চিত হয়ে শুয়ে আছেন। চোখ উল্টানো । মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে। উনি একজন রিকশাওয়ালা। রিকসাটি পাশেই। রন্টুদা ঘপ্ করে বৃদ্ধকে তুলে বসিয়ে দিল রিকসায়। গামছা দিয়ে বেঁধে দিল সিটের সাথে। তারপর নিজে রিকসা চালিয়ে সোজা মিটফোর্ড হাসপাতালে। রন্টুদার সেই টুং টুং বেল বাজিয়ে ঢাকার রাস্তায় রিকসা চালানোর দৃশ্য এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই।
রন্টুদা তা’র সমবয়সী বন্ধুদের চাইতে আমাদের বয়সের ছেলেদের সাথেই বেশি মিশতেন। তবে পাড়ার চাচা, খালা, কাকা, কাকীমাদের সাথেও ছিল তার হৃদ্যতা। আর বেশ ক’জন আসমানি পরী যাদের কথা আমি শুরুতে লিখেছি। এসব পরীরা ছিল সব নতুন ঢাকার পরিপাটি স্বভাবের মেয়ে। দেশের যুব সম্প্রদায় যখন আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি জাতিয় প্রেম করে বেড়াচ্ছে তখন রন্টুদা পরী উড়িয়ে নিয়ে আসছেন একদম নিজের বাসায়। ভাবা যায়না ! এমন ক্ষমতাধর দাদার জন্য শ্রদ্ধায় মাথা নত না হয়ে উপায় আছে ?
আমরা সবাই রন্টুদা হবো, এত পরী কোথায় পাবো ?
দীপা আন্টি আর রন্টুদার সম্পর্কটা ছিল বড় মধুর। মা আর ছেলে নয়, যেন দুজনে বন্ধু। রন্টুদার মেয়ে বন্ধুরা যে বাসায় আসতো সেটা দীপা আন্টি জানতেন। স্কুলে যাবার আগে ঘি আর বাদামে ভরা সুজির হালুয়া বানিয়ে রেখে যেতেন। ঘর দোর ফিটফাট করে রাখতেন। পরীরা যখন আসতো, বাসায় কেউই থাকতো না। এখন বুঝতে পারি রন্টুদা সে সময় আমাদের কেন বাসায় আসতে বলতেন। তেমন কিছু যাতে না ঘটে।
মানুষের মন, উতলা হতে কতক্ষণ !
একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। আমি গ্রাম থেকে ঢাকা এলাম ২০ তারিখ। ঢাকার রাস্তায় তখন প্রচুর মানুষ । হঠাৎ হঠাৎ গুলীর শব্দ ভেসে আসে। মানুষ বিচলিত হয়না, কেননা শহরের অর্ধেক মানুষের হাতে বন্দুক। রিকশা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রচুর জিপ গাড়িতে বসে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশ লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
মনে আছে ২১শে ডিসেম্বর গিয়েছিলাম রন্টুদার বাসায়। দেখি তা’র মুখে এক গাল দাড়ি, এক মাথা চুল। ‘বেঁচে আছিস’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। দেয়ালের এককোণে একটা স্টেনগান। রন্টুদা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। আমার এ বাড়ির সবচাইতে প্রিয় জিনিস ছিল কাচ লাগানো কাঠের আলমারিটা। যেখানে রাখা থাকতো স্বপ্নের বইগুলো আর রন্টুদার বিভিন্ন সময় পাওয়া ট্রফি। আমি বোকার মত জিজ্ঞেস করলাম, বই গুলো কোথায় ?
রন্টুদা হাসতে হাসতে বললেন, ‘খান সেনারা বাংলা পড়তে জানেনা। আর রাজাকাররা তাদের ছেলেমেয়েদের রূপকথার বই পড়তে দেয়না। রাজকন্যা, রাজপুত্তুর, রাক্ষস, খোক্কসরা নিশ্চয়ই এখন ঠোঙ্গার রূপ ধারণ করেছে, বেঁচে আছে কিনা মাটিতে মিশে গেছে কেউ জানেনা।’
পাশের ঘর থেকে দীপা আন্টি বললেন, ‘বড়দিনের দিন এসো, কেক বানাচ্ছি’। আমাদের বিজয় দিবসের আট দিন পরেইতো খ্রীসমাস। আমি বললাম ‘আসবো আন্টি’।
তবে আমার যাওয়া হয়নি। দীপা আন্টি কেক বানিয়েছিল কিনা জানিনা। ২২ তারিখে রন্টুদা মোহম্মদপুর থেকে নিখোঁজ হলো। ২৩ তারিখ পর্যন্ত তিনি ফিরলেন না। ২৪ তারিখে তার মৃতদেহ পাওয়া গেল।
এরপর দু’এক বার দীপা আন্টিকে সূত্রাপুর বাজারে ব্যাগ হাতে ধীর পায়ে হেটে যেতে দেখেছি। কিন্তু কাছে গিয়ে কথা বলতে সাহস হয়নি। রন্টুদার বাড়ির দরজায় আর কখনো গাড়ী দাড়িয়ে থাকতে দেখিনি তাই সে বাড়িতে আমার আর কোন দিন যাওয়া হয়নি।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|