রহিম ব্যাপারী আশীষ বাবলু রহিম ব্যাপারীকে আমরা রহিম চাচা বলে ডাকতাম। থাকতেন ঢাকার শান্তিনগর। পদবীটা ব্যাপারী হলেও তা’কে কখনো ব্যবসা বাণিজ্য বা দোকানদারি করতে দেখিনি। বাড়ীতে তা’র বিভিন্ন রকমের গাছ-গাছালী ছিল। আম, পেয়ারা, জাম, কাঁঠাল, কামরাঙ্গা। যখনই তা’র বাসায় গেছি দেখেছি উনি খুরপি দিয়ে গাছের গোড়ার জঙ্গল পরিষ্কার করছেন।
রহিম চাচা যখন আমাদের বাসায় আসতেন তখন আমরা খুবই খুশী হতাম। কারণটা ছিল তা’র হাতে একটা চটের ব্যাগ থাকতো আর তাতে ভর্তি থাকতো বাগানের মৌসুমি ফল। চাচা বাসায় আসলে বাবাও খুশী হতেন। অসময়ে চা বাবা খেতেন না, কিন্তু চাচার আগমন উপলক্ষে দুজনে চা খেতে খেতে দেশের পলিটিক্স নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠতেন। অধিকাংশ সময়ই গভর্নর মুনায়েম খানের পিণ্ডি চটকানো হতো। খান সাহেবের জন্য ব্যবহৃত, হতচ্ছাড়া, বেয়াদব, ধুরন্ধর, গর্দভ এই শব্দগুলি চাচার মুখে শুনতে খুবই ভাল লাগতো। তিনি বলতেন, ঐ ফ.কা. চৌধুরীটা একটা বজ্জাত মেকুর। এই ‘মেকুর’ শব্দটা চাচার মুখে প্রথম শুনেছি যার অর্থ হলো ‘বেড়াল’।
আমাদের সাথে চাচার যখন কথা হতো তাতে একটা গল্প সব সময় বাঁধা থাকতো। সেটা হচ্ছে ভাষা আন্দোলন । বলতেন বুঝলে কিনা - আকাশে সূর্য তখন মধ্য গগনে। সে বছর কী পরিমাণ পলাশ ফুল ফুটেছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তা তোমাদের বোঝাতে পারব না। আমরা ছাত্ররা যাচ্ছি নুরুল আমিনের কাছে লিখিত প্রতিবাদ জানাতে। নুরুল আমিন তখন বসতেন এস, এম হলের পাশে। আমরা শ্লোগান দিচ্ছি ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। মেডিকেল কলেজের সামনে যখন এসে পৌঁছেছি তখন দুপুর তিনটের মত হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবেই মিছিল নিয়ে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ করে পুলিশের গুলি। আমার বা পাশে যে ছেলেটি ধপাত করে মাটিতে পরে গেল সে ছিল জব্বার। চোখের সামনে ছেলেটির সাদা শার্টের পকেট রক্তে লাল হয়ে গেল। গুলিটা লেগেছিল বুকে। আমি নুয়ে যখন জব্বারকে ধরতে যাব ঠিক তখন আমার হাত ছুঁয়ে বেড়িয়ে গেল আরেকটা গুলি। ছিন্ন ভিন্ন মিছিল। ধুলোয় ধোঁয়ায় একাকার। গুলির আওয়াজ তখনও থামেনি। মৃত্যু তালিকায় আমার নামও থাকার কথা ছিল। ভাগ্য খারাপ গুলিটা বুকে না লেগে হাতে লেগেছিল। এতটুকু বলার পর চাচা আরো একটা কথা যোগ করতেন, বলতেন - সেদিন আরো বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছে। তোমার মত দশ বছরের একটি ছেলেও গুলি খেয়েছিল। বেঁচে আছে কিনা আজঅব্দি কেউ জানেনা। সব ডেডবডি পুলিশেরা গুম করেছে।
এই গল্পটা রহিম চাচার মুখে শুনে শুনে আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবারই দশ বছরের ছেলেটার জন্য খুবই মন খারাপ হতো। তার বর্ণনায় জব্বারের শার্টের পকেট রক্তে লাল হবার দৃশ্যটা এতদিন পরেও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই।
এখানে বলে রাখা ভাল যে, রহিম ব্যাপারীকে চাচা বলে ডাকছি বলে আপনারা ভাববেন না তিনি একজন বয়স্ক বৃদ্ধ মানুষ। যে সময়ের কথা লিখছি তখন তা’র বয়স খুব বেশি হলে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ। আমার তখন এমন একটা বয়স, যে বয়সে ত্রিশ বছরের মানুষদেরই বয়স্ক বলে মনে হয়।
চাচার ড্রেস ছিল টেট্রনের কালো প্যান্টের উপর সাদা হাফ হাতা শার্ট। শীত গ্রীষ্ম সব সময় একই ড্রেস। শুধু শীতে শার্টের উপর একটা পুলওভার। ওটা যে কোন রঙের হতে পারতো। যখনই তিনি ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের কথা বলতেন তিনি শার্টের হাফহাতার নিচে হাতের গুলির দাগটা গর্ব করে দেখাতেন। যেমন করে মেয়েরা হিরের গহনা পরে নিজের অহংকার প্রকাশ করে।
তারপর যথারীতি দিন কেটেছে। ৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলো। সমস্ত দেশ জুড়ে উল্টাপাল্টা অনেক ঘটনা ঘটে গেল। চাচার শান্তিনগরের বাড়ীর পাশ দিয়ে যখনই যেতাম দেখতাম বাড়ীটা তেমনই আছে। বাইশ ইঞ্চি শক্ত গাঁথুনির প্রাচীর। গেটের সামনে শ্বেতপাথরের উপর খোদাই করা ‘শান্তি নীড়’ লেখা ফলক। তবে গাছগুলো অযত্নে ফলাফল শূন্যের দিকে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে রহিম চাচা হঠাৎ করে একদিন আমাদের বাসায় আবার এসে হাজির। হাতে সেই চটের ব্যাগ ভর্তি ফল। সুপুষ্ট আম এবং ঝকঝকে কলা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে ফলগুলো বাজার থেকে কেনা। চাচা বললেন, হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই ধরেছ এগুলো বাজার থেকে কেনা। তেমন সুস্বাদু হবেনা। তিনি সেদিন আমাদের বলতে এসেছিলেন যে তিনি বিদেশে যাচ্ছেন। ওয়েস্ট জার্মানি। সালটা ছিল ১৯৭৬। সেই সময়টায় জার্মানি যাবার একটা হুজুগ চলছিল তরুণ সমাজের মধ্যে। জার্মানি যেতে বাংলাদেশের মানুষদের ভিসা লাগতোনা।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। আমিও না না উত্থান পতনের দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে থিতু হয়েছি অস্ট্রেলিয়ায়। দেশে গেলে সেই শান্তিনগরে চাচার বাড়ীর সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখেছি তা’র বাগান আর বাগান নেই। গোটা তিনেক আট/নয় তলা ফ্লাট বাড়ী হয়েছে তার বাগানে। ফলের গাছ গুলো সব কাটা গেছে। দেখে মনটা খারাপ হতো। কিন্তু জীবনে মর্মাহত হবার এত কারণ আছে যে গাছপালা নিয়ে বেশি সময় মর্মাহত থাকা যায়না।
সেটা সম্ভবত ২০০৬ হবে। ঢাকায় গিয়েছি। দেশ এখন পাকাপোক্ত ভাবে বেড়াবার যায়গা। শান্তিনগর দিয়ে রিকসায় যাচ্ছি। দেখি একটা বাড়ির সামনে মানুষের জটলা। তখনই আমার চোখে পরল ‘শান্তি নীড়’ লেখা লালচে ধুলোয় মাখা শ্বেত পাথরের ফলকটি। এত দালান কোঠা উঠেছে তবে রাস্তার পাশের দেয়ালটি এখনো একই রকম রয়ে গেছে। রিকসা থেকে নেমে ভিড় কাটিয়ে উকি দিলাম। দেয়ালের পাশ দিয়ে গাড়ী ঢোকার নতুন সিমেন্টের রাস্তা। একটু ভেতরে বেদীর মত যায়গাটায় রাখা আছে একটা কফিন। পালিশ করা কাঠের, ঝকঝকে সোনালী হাতল, বিদেশে আমরা যে ধরনের দেখি।
একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কে ?
‘ব্যাপারী। রহিম ব্যাপারী’ । আমার বুকটা ধুক করে উঠল।
কোন ব্যাপারী ?
‘রহিম ব্যাপারী। জার্মানিতে থাকতেন’।
বুঝতে অসুবিধে হলোনা আমার ছোটবেলার ফলের ব্যাগ ওয়ালা রহিম চাচা জার্মানি থেকে ডেড বডি হয়ে এসেছেন। আর কোথা থেকে এই সময়টায় আমি এখানে এসে হাজির ! জীবন যে কত খেলাই দেখায়। আমি নিথর হয়ে দাড়িয়ে। স্মৃতির ঝাঁপি থেকে কত কথাই একে বেকে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মৃত্যুই কি জীবনের শেষ পৃষ্ঠা ? নাকি এর পরও কিছু লেখা বাকি থাকে ? হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একজন বিদেশী ভদ্রমহিলা দাড়িয়ে। পরনে সালোয়ার কামিজ, সোনালী চুল ভরা মাথায় ওড়না খানা তুলে রেখেছেন। নীল চোখের চারিদিকে বয়সের কালী জমেছে। এককালে যে সুন্দরী ছিলেন তার আভা এখনও প্রকাশ পাচ্ছে।
ভিড়ের মধ্যে কে একজন ফিসফিস করে বললেন-‘মেম সাহেব ব্যাপারীর স্ত্রী’। কি মনে হলো ভিড় ঠেলে মহিলার কাছে এগিয়ে গেলাম। ইংরেজিতে বললাম, স্যরি, তুমি আমাকে চিনবেনা, তবে ছোটবেলায় রহিম সাহেবের কাছে অনেক ভালবাসা পেয়েছি’। মেমসাহেব আমার ইংরেজির উত্তরে বাংলায় বললেন, ‘ধন্যবাদ, রহিম আমাদের ছেড়ে চলে গেছে চারদিন আগে মিউনিখে। ওর ইচ্ছা ছিল এখানে দাফন করা হোক। একটা জায়গাও কিনে রেখেছিল। ওর শেষ ইচ্ছাপূরণ করতে আমি এসেছি’। এই বলে ওড়না দিয়ে চোখের এক কোনে লেগে থাকা এক বিন্দু অশ্রু মুছলেন।
আমি হতবাক হয়ে শুনছিলাম চাচার স্ত্রীর বাংলায় কথা বলা। কী পরিষ্কার উচ্চারণ ! এত সুন্দর বাংলা একজন জার্মান ভদ্রমহিলার কণ্ঠে আরো সুন্দর লাগছিল। উনি ‘লাস্ট উইশ’এর বদলে বললেন ‘ইচ্ছাপূরণ’। মনে মনে ভাবলাম রহিম চাচা তা’র বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম জার্মানির মিউনিখেও একই ভাবে চালিয়ে গেছেন।
ভিড় থেকে বেড় হয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেয়ালে শ্বেত পাথরের ফলকটায় শান্তি নীড়ে'র ‘শান্তি’ শব্দটা প্রায় মুছে গেছে অথচ এখানে কী নিশ্চিত শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন রহিম চাচা। রিকসায় উঠতে উঠতে মনে হলো আরে এটাতো ফেব্রুয়ারি মাস! রিকশাওয়ালাকে বললাম রিকসা ঘুরাও, চল দেখে আসি ইউনিভার্সিটি চত্বরে পলাশ ফুটেছে কিনা।
ashisbablu13@yahoo.com.au
|