bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












প্রাকটিক্যাল হলেও ওরা রোমান্টিক!
আশীষ বাবলু



স্বামী নব্বই পেড়িয়ে আর স্ত্রী নব্বই ছুঁই ছুঁই। দুজনে এখনো প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা হাসি খুশী। এমন একজোড়া দম্পতীর ৬০তম বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সৌভাগ্য বলছি এই জন্য যে প্রতিদিন গণ্ডায় গণ্ডায় বিয়ে হচ্ছে আর হচ্ছে বিবাহ বার্ষিকী। তবে ৬০তম বিবাহ বার্ষিকী কটা হয়? দুজনে মিলে ব্যাটিং শুরু করে ষাট পর্যন্ত টিকে থাকার ঘটনা খুবই কম ঘটে। আমরা সবাই ওয়াড্রোব পরিষ্কার করতে যেয়ে কখনো দু একটি দুঃখিনী মুজা খুঁজে পাই। ওদের পার্টনার নেই, হাড়িয়ে গেছে! এরা যখন একা হয়ে যায় বড় মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এমন ঘটনা-ইতো আমরা সচরাচর দেখে আসছি।

তবে আজকের এই দম্পতী এখনো ক্রিজে টিকে আছেন এবং সুন্দর ব্যাটিং করছেন। ছেলে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত। নাতী নাতনী, ওদের ছেলে মেয়ে সব মিলিয়ে এক চাঁদের হাট বসেছে সিডনির এক পাঁচটারা হোটেলে। আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, এতদিন একসাথে পথ চলার সিক্রেটটা কি আমাদের বলুন-তো? ভদ্রলোক হেসে বললেন, দুজনের পথ দুজনকেই তৈরি করতে হবে, তোমাদের পথ অন্য কেউ তৈরি করে দেবেনা। পাশে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা শাড়ি সামলাতে সামলাতে বললেন, ‘আমরা এমন একটা যুগে জন্মেছিলাম যখন কিছু ভেঙ্গে গেলে রিপেয়ার করে নিতাম। নট থ্রো ইট এ্যাওয়ে। মেরামত করে নিতাম । জোড়া লাগাবার চেষ্টা করতাম’।

ভদ্রমহিলা ঠিকই বলেছেন। ইদানীং বিয়ের খবর যত পাওয়া যায় ডিভোর্সের খবরও ঠিক ততটাই। পঞ্চাশ বছর বয়সে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে? ছেলে মেয়েদের এখন কি হবে? এমন সর্বনাশা খবর প্রায়ই কানে আসে! আমাদের ইস্ট-লেকের ইদ্রিস ভাই আর ভাবী যাদের প্রেম দেখলে ঈর্ষা হতো, যারা এক টুথব্রাশ দিয়ে দুজনে দাঁত মাজতেন, যাদের বাসায় দেখেছি একই ক্লথ লাইনে দুজনের অন্তর্বাস রোদে শুকাতো! তাদের ও শুনলাম ডিভোর্স হয়ে গেছে!

যাই হোক সেদিনের পার্টিতে যে টেবিলে আমি বসেছিলাম, আমার পাশে বসেছিল মিষ্টি একটি মেয়ে। বয়স একুশ বাইশ হবে। মেয়েটি সুন্দর বাংলা বলে যদিও এদেশেই জন্ম। রাজশাহীর বাবা মা। মেয়েটি শুধু দেখতেই মিষ্টি নয়, স্বভাবেও মিষ্টি। আমি অনট্রের কোন আইটেমটা নেইনি সে আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। ওর সাথেই একটু গল্প শুরু করলাম। আমার এমন বয়সের ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলতে সবসময়ই ভাল লাগে। নিজের এই বয়সটার কথাতো মনে আছে, তাই এদের চিন্তা ভাবনার সাথে সেগুলোর পার্থক্য আমাকে বড় আশ্চর্য করে। মেয়েটি গ্রাজুয়েশন করেছে। বয়-ফ্রেন্ডের সাথে গত বছর ইউরোপ বেড়াতে গিয়েছিল। এখন থাকে সারি হিলস। বয়ফ্রেন্ডেরই সাথে।

একটা দীর্ঘশ্বাস আমার বুক থেকে বেড়িয়ে এলো। ভাগ্যিস মেয়েটি লক্ষ করেনি। আমার ঐ বয়সে কত ইচ্ছে হতো পাড়ার যূথীকে নিয়ে তিন দিনের জন্য কক্সবাজার বেড়াতে যেতে! হায় জীবন! আমি এই যে মেয়েটির সাথে কথা বলছি এর জন্ম ১৯৯৫ এর পর। যাকে বলে ‘জেড’ জেনারেশন। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে এরা হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে ইন্টেলিজেন্ট মানব প্রজাতি। এরা বুদ্ধিতে ভরপুর। আঙ্গুলের ডগায় রয়েছে ইনফরমেশন। আমরা মুখ বুজে বড়দের উপদেশ শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু এরা ‘হোয়াই’ আর ‘হোয়াই নট’ সরাসরি জিজ্ঞেস করে। পৃথিবী চেঁছে সঠিক উত্তর খুঁজে বেড় করে। এদের বোকা বানানো সহজ নয়। হরিপদ স্যার বললেন আর ওরা বিশ্বাস করে নিল, এমনটি হবার নয়।

এদেশে বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের একসাথে থাকা এখন ব্যাপক ভাবে চালু হয়ে গেছে। আমাদের বাঙ্গালী পরিবারও এ থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম, বিয়ে কবে করছো? সে মাথার চুল ঠিক করতে করতে বললো, ইয়েস, নো, পারহ্যাপস্, না না ভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করলো। বুঝলাম শি ইজ নট শিওর। ও জানে না কবে বিয়ে করবে ! যতদিন ভালবাসা আছে একসাথে থাকবে যখন ভালবাসা থাকবেনা আলাদা হয়ে যাবে। নো ড্রামা!

এই যে আমাদের বিয়ে বার্ষিকী, কত কিছু মনে পড়ে। দুরু দুরু বুকে নতুন জীবনে প্রবেশ করা। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, দুই জোড়া মা বাবা, বিয়ের কার্ড, খাওয়া দাওয়া, ছবির এ্যালবাম, বিয়ের বেনারসি, বিউটি পার্লার, আমার বিয়ের পাঞ্জাবীতে এখনো আমাকে জোর করে খাওয়ানো রসগোল্লার রসের খরখরে একটা সাদা দাগ স্মৃতি হয়ে লেগে আছে। সেই উৎকণ্ঠা সেই উত্তেজনা এসবের কি কোন মূল্য নেই?

মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, যে দিন থেকে তোমরা একসাথে থাকা শুরু করেছো সে দিনটি কি মনে আছে? একটু চিন্তা করে সে বললো, ইয়েস, টু থাউজেন্ট সেভেন্টিজ, আমরা ইউরোপ থেকে বেড়িয়ে আসার পর। নভেম্বর মাসে। ইট ওয়াজ এ ফ্রাইডে। বুঝলাম ভাসা ভাসা মনে আছে। সেই তারিখটা তাদের জীবনে কোন উল্লেখযোগ্য তারিখ নয়। মনে মনে ভাবলাম বিয়ের তারিখ না হোক ‘মুভিং ইন’ তারিখটাও-তো ফ্যালনা নয়। মা বাবাকে ছেড়ে প্রথম দুজনে একসাথে থাকা। অস্ট্রেলিয়ার আইন সেদিন থেকে ওদের বলছে ‘কাপল’। দম্পতি। এমন একটা দিনের কোন মিনিং নেই? অনেকটা আমাদের মা-বাবাকে ছেড়ে প্রথম হোস্টেলের জীবন শুরু করা। একটা বিশেষ দিন অবশ্যই তবে সেটা মনে রাখলেও কি, না রাখলেও কি!

প্রশ্ন করলাম কি ভেবে তোমরা একসাথে থাকা শুরু করলে? ‘প্রথম কারণ, উই লাইক ইচ আদার। সবচাইতে বড় হলো প্রাইভেসি। নো ইন্টারফেয়ারেন্স ফ্রম প্যারেন্ট। বাবা মায়ের নাক গলানো থেকে দুরে থাকা। দুজনে মিলে থাকলে বাড়ী ভাড়া শেয়ার হলো, হাউজহোল্ড খরচাপাতি শেয়ার হলো। একটা জয়েন্ট ভেঞ্চার’। ভাবছিলাম, আমার মা-বাবার ব্যাঙ্কে কোন জয়েন্ট এ্যাকাউন্ট ছিলনা। বাবার হার্টের অসুখ ধরা পরার পর একটা করা হয়েছিল, তার কারণটা ভিন্ন।

বললাম আজকে এইযে আমরা ষাট বছরের বিবাহ বার্ষিকী সেলিব্রেট করতে এসেছি তোমার ইচ্ছে হচ্ছেনা তোমাদের জীবনেও ভালবাসার এমন ষাট বছরের সেলিব্রেশন হোক? মেয়েটি সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো, হলে খুব ভাল। তবে এতদিন একসাথে থাকা এটা ‘ভালবাসা’ নাকি ‘হ্যাবিট’ সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। আঙ্কল, একসাথে ‘লম্বা’ সময় কাটানোর চাইতে ‘ভাল’ সময় কাটানো বেশি ইম্পরট্যান্ট।

কথাটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুললো। আমি আগেই বলেছি এই ‘জেড’ জেনারেশন চিন্তা ভাবনায় আমাদের চাইতে এগিয়ে। ওরা প্রাক্টিকাল, ওরা সেন্সিবল। আমরা চিরদিন শুনে এসেছি জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে প্রচুর টাকা রোজগার করতে হবে। এরা বলে, প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে টাকা নয়, নতুন কিছু করতে হবে। সবচাইতে ভাল-লাগে এই প্রজন্মের মেয়েরা শক্ত করে ‘না’ বলতে শিখেছে। ‘না’ মানে ‘না’। একটা ব্যাপার ছেলেদের মধ্যে আমার চোখে পরে এরা ‘সেক্স’ বা ‘মেয়ে’ নিয়ে মাথা খুব কম ঘামায়। আমাদের ঐ বয়সে (মেয়েদের কথা সঠিক বলতে পারবো না) ছেলেদের প্রধাণ আলোচনার বিষয় ছিল ‘মেয়ে’। মেয়ে প্রসঙ্গ এলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পরতাম। সেটা ক্লাসের পপি হোক, পাড়ার বৌদি হোক, কিছু না হলে চিত্র নায়িকা ববিতা। আপনাদের একটা সুখবর দিচ্ছি, এই কিছুদিন আগে আমেরিকায় এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে যে এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মধ্যে সেক্স ঘটিত ক্রাইম প্রায় শূন্যের কোঠায়!

আমিই শুধু প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম, এবার মেয়েটি আমার দিকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, আন্টির সাথে আপনার পরিচয় কি করে হলো? বললাম, এক পার্টিতে পরিচয় হয়েছিল। তারপর টেলিফোনে কথা, কয়েকবার রেস্টুরেন্ট, শপিং সেন্টার, এর পর দুজনের মা-বাবাকে জানানো। তারপর দিন তারিখ ঠিক করে বিয়ে। মেয়েটি বললো, সিমিলার টু মাই মা-বাবা। হোয়াট এ্যা রিস্কি গেইম। কমিটমেন্ট ফর লাইফ। অথচ একসাথে শেয়ার করেননি, কিচেন, বাথরুম, বেড, টিভি! অনেকটা প্যারাসুট ছাড়া প্লেন থেকে লাফ দেওয়া! মেয়েটি খুব একটা ভুল বলেনি। মনে হতে পারে কিচেন, বাথরুম, টিভি শেয়ারের মধ্যে এমন কি সিক্রেট লুকিয়ে আছে? আছে। আমরা যখন কোনও বন্ধু-বান্ধবের সাথে লং উইকেন্ডে কোথাও দুই-তিনদিনের জন্য বেড়াতে যাই তখন বন্ধুটি সম্পর্কে অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয়। এতদিনের পরিচয়ের পরও জানা হয়নি বন্ধুটি বিরক্তিকর ভাবে ৪৫মিঃ আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়ায়, স্ত্রীকে খাবার নিয়ে গালাগাল করা অভ্যাস! নরমাল ব্যাপার!

একটা কথা আমরা সব সময় বলে থাকি যে, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে। প্রেমের বিয়েই হোক আর পাতানো বিয়েই হোক, আমরা জানিনা কোনটা কতদিন টিকবে! কোনটারই গ্যারান্টি নেই। তবে আত্মীয়-স্বজন দ্বারা জোড় করে চাপিয়ে দেয়া বিয়ে করে ঠকার চাইতে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে ঠকা অনেক ভাল। বিশ্বাস করে ঠকেছি। অবশ্য এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারনা।

মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের দুজনের স্পেশালডে কোনটি? মেয়েটি একটা স্বর্গীয় হাসি দিয়ে মুখ নামালো, বললো, অনেকগুলো। যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। যেদিন আমরা প্রথম কিস্ করেছিলাম। তবে আমাদের আরেকটা সুপার স্পেশাল দিন আছে। কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম, সেটা কি? মেয়েটি বললো, ও তখন ক্যানবেরাতে চাকুরী করে আমি সিডনিতে। যোগাযোগ ফোন আর ওয়াটস্আপ। ও উইক-এন্ডে নিয়ম মতো চলে আসতো সিডনি। একদিন মিডল অফ দা উইক ও আমাকে খুব মিস করছিল, তখন রাত আটটা হয়তো হবে। আমাকে দেখার জন্য ৩০০কিঃমিঃ ড্রাইভ করে মাঝরাতে আমার জানালায় নক্ করেছিল। আমার প্যারেন্টরা তখন গভীর ঘুমে। সে রাতেই আমরা ঠিক করে ছিলাম যে একসাথে থাকবো। সে দিনটি আমরা সেলিব্রেট করি প্রতিবছর। আমি বললাম, বাঃ দারুণ ব্যাপার!

খুব ভাল লাগলো। প্রাকটিকাল হলেও রোমান্টিক ব্যাপারগুলো ওদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি।




আশীষ বাবলু, সিডনি,
ashisbablu13@yahoo.com.au





Share on Facebook               Home Page             Published on: 12-Aug-2019

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot