একজন পিরোজপুরের ভাবী আশীষ বাবলু
তখন ডালউইচ্ হিলে থাকি। পাশের সাবার্ব ম্যারিকভিল। দুটো সাবার্বের চেহারা ঠিক একই রকম। এখনকার মতো ব্যস্ত সমস্ত হৈ-হুল্লোড়ে ভরা ছিলনা। ঢিলে ঢালা হেলে-দুলে চলতো সেখানকার জীবন। তখন ম্যারিকভিল ছিল গ্রীক সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রায় সময়ই দেখা যেতো এরিস্টটল, সক্রেটিস, হোমার রোদে পিঠ দিয়ে বসে কফিশপে কফি খাচ্ছেন। সেখানে একের পর এক ছিল গ্রীক মালিকানাধীন দোকান। ভিক্টোরিয়া রোড আর ম্যারিকভিল রোডের মোড়ে ছিল একটা সুবলাকির (ডোনার কাবাব জাতীয়) দোকান। এখনও হয়তো আছে। সেই দোকানেই পরিচয় হয়েছিল মামুন ভাইর সাথে। এক হাতে সুবলাকি আর অন্য হাতে চার বছরের মেয়ে লাকি। যখন ভাবছিলাম ওরা কোন দেশের ঠিক তখনই ভদ্রলোক মেয়েকে বললেন, মনু তুমি কি আর কিছু খাবা? বুঝতে বাকি রইল-না যে ওরা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বরিশালের। আমি যে সময়কার কথা লিখছি তখন রাস্তাঘাটে এখনকার মত পাশ ফিরলেই বাঙ্গালী ভাইবোনদের দেখা মিলতো না। কালেভদ্রে হঠাৎ কারো সাথে দেখা হলেই দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে যেত। ভাই, শনিবার বাসায় চলে আসেন!
ঠিক শনিবারেই হাজির হয়েছিলাম মামুন ভাইর বাসায়। স্বামী স্ত্রী আর চার বছরের মেয়ে লাকিকে নিয়ে ছোট্ট সুখী সংসার। মামুন ভাইর স্ত্রী ছিলেন পিরোজপুরের মেয়ে। তার মুখের হাসি দেখলেই বোঝা যেতো তিনি বাংলার গ্রামের একজন সহজ সরল মেয়ে। অসাধারণ রান্না করতেন।
আমরা তখন তিন চার জন বন্ধু মিলে একটি বাড়িতে থাকি। কারোরই বিয়ের ফুল ফোটেনি। তখন খাওয়া দাওয়া বলতে চিকেন কারি আর ভাত। কখনো স্পেশাল আণ্ডা কারি আর ডাল। এই ভাবীর সাথে পরিচয় হবার পরই আমাদের খাদ্যাভ্যাসে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এলো। পালংশাক, পুইশাক, কচুর লতি এইসব অসম্ভব সুন্দর আইটেম আমরা খাবার সুযোগ পেলাম। এই সব বস্তুগুলো যে ভিয়েতনামী দোকানে পাওয়া যায় সেই সন্ধান মামুন ভাই দিয়েছিলেন। ভাবী রান্না করতে ভালবাসতেন আর আমরা খেতে ভালবাসতাম। একদম সোনায় সোহাগা। প্রতি সপ্তাহেই আমাদের দেখা হতো, হয় আমাদের বাসায় ওরা আসতেন অথবা আমরা ওনাদের ওখানে সদলবলে চলে যেতাম। সুস্বাদু খাবারের সাথে আড্ডা। বাঙ্গালীর বেষ্ট এন্টারটেইনমেন্ট!
কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সিনেমা, নাটক, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্কে বিতর্কে দুশ্চিন্তায় কত মাঝ-রাত আমরা পাড় করে দিয়েছি। সংসারে না থেকেও আমাদের একটা সংসার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ওদের ছোট্ট মেয়েটি যখন দুখানা ছোট্ট হাত তুলে চাচু বলে ঝাঁপিয়ে পড়তো তখন আত্মীয় স্ব-জনহীন এই পরবাসে বেঁচে থাকার একটা মানে খুঁজে পেতাম। ভাবী ছিলেন ভাবীদের মতন। স্বামী সন্তান আর ছোট্ট ফ্লাটটা ছিল তার জীবন। পিরোজপুরের মাঠ, পুকুর, গাছপালা, ফল, ফুলের গল্প করতেন ভাবী। মমতাজ আর শাহজাহানের ছেলে শাহ্ সুজা। আর শাহ্ সুজার ছেলে ফিরোজ শাহ্ এই অঞ্চলে মারা গিয়েছিলেন। এই ফিরোজের নামেই পিরোজপুর। গাছে চড়ে, পুকুরে গামছা দিয়ে মাছ ধরে, মাঠে প্রজাপতির সাথে ছুটে যার শৈশব-কৈশোর কেটেছে সে হাসি মুখে দুই বেডরুমের ছোট্ট ফ্লাট বাড়ীতে সংসার করছেন। কোন অভিযোগ নেই।
মামুন ভাই এখানে পি,এইচ,ডি করছিলেন। মাঝে মধ্যেই তাকে যেতে হতো বাংলাদেশে। দুই এক সপ্তাহের জন্য যেতেন, আবার ফিরে আসতেন। একদিন মামুন ভাইর বাসায় হাজির হলাম ভাবী বললেন উনি নেই, দেশে গেছেন। কিছু মানুষ আছেন যারা কিছুই লুকাতে পারেনা। সংসারে এতটুকু ছন্দপতন হলেই চোখে মুখে ধরা পড়ে যায়। ভাবীর মন ছিল পদ্ম পুকুর, যার টলটলে জলে মনের গভীরতা পরিষ্কার দেখা যেতো। জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? সব কিছু ঠিক আছেতো? বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবী বললেন, না ভাইয়া ঠিক নাই। আপনাদের মামুন ভাই আরেকটা বিয়ে করেছে, বাংলাদেশে।
কেউ যদি আমাকে বলতো যে পৃথিবী তার কক্ষপথ বদল করে উল্টোদিকে পাক খাচ্ছে তবেও এতটা আশ্চর্য হতাম না। মানুষ বড় বিচিত্র স্বভাবের। মামুন ভাইর আরেকটা বিয়ের দরকার কেন হলো? গ্রামের মেয়েদের বুঝি শর্ট টাইম ভাল লাগলেও বেশি দিন ভাল লাগেনা! ভাবীর করুন মুখখানা দেখে আমার মনে হচ্ছিল সংসারের জন্য এমন ভাবে জীবন উৎসর্গ করলে মানুষ স্বাভাবিক কারণে কিছু আশাও করে। এই আশা করাটা অন্যায় নয়। তারপর আপন মানুষটি যখন এমন ভাবে সবকিছু তছনছ করে দেবার ক্ষমতা দেখায় তখন একটা প্রশ্ন জাগে এই সংসার সংসার করে, এই মিথ্যে পুতুল খেলে লাভ কি?
মামুন ভাই বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করেননি। আমরাও সাহস করে ঐ বাড়িতে পা রাখিনি। তবে শুনেছিলাম ভাবী ব্যাপারটা সহজ ভাবে নেননি। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। একদিন এক সুপার মার্কেটের কাউন্টারে ভাবীকে কাজ করতে দেখেছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন আছেন? তিনি শুধু চোখ তুলে হেসেছিলেন। ভাবীকে দেখে কষ্ট হয়েছিল, তবে তার জন্য শ্রদ্ধা জেগেছিল অনেক বেশি। একটা মিথ্যে সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলতে সাহস লাগে। জীবন কি সত্যি এত অবহেলার জিনিস? একদিন সবার সামনে বিয়ে করেছিল বলে, কিংবা বলা যায় একদিন সমস্ত হৃদয় দিয়ে একজনকে ভালবেসেছিল বলে তার সব অন্যায় মুখ-বুজে সহ্য করতে হবে এটা-তো ঠিক নয়।
মাঝে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে। একটা দুটো নয় পঁচিশ বছর! কিছুদিন আগে আমার এক অস্ট্রেলিয়ান অফিস কলিগের বিয়ের রিসেপশনে গিয়েছিলাম। সেখানে এক চেনা চেনা ভদ্রমহিলাকে দেখে আবিষ্কার করলাম ইনিই সেই পিরোজপুরের ভাবী। আমাকে চিনেছিলেন। বয়সের রেখা পড়েছে মুখে, তবে বড় সন্তর্পণে। সুন্দর করে ছাটা চুলে কয়েক গাছ সাদা চুল জানান দিচ্ছে বয়সের নয়, অভিজ্ঞতার। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এক ভদ্রলোকের সাথে। আমার হ্যাজবেন্ড, জন। ভদ্রলোক আমার সাথে হৈ চৈ করে হাত মেলালেন। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কোন লুকোচুরি নেই, এরা এক মুহূর্তের মধ্যে তার সমস্ত জীবনের গল্প বলে দেয়। জন এর মুখেই জানলাম, ভাবীর সাথে তার পরিচয় হয়েছিল একটি রেস্টুরেন্টে। দুজনেই কিচেনহ্যান্ড হিসেবে কাজ করতেন। তারপর ওরা সেই রেস্টুরেন্ট কিনে নেয়। এখন সিডনি শহরে ওদের তিনখানা রেস্টুরেন্ট। ভাবীকে দেখিয়ে বললেন, অল ক্রেডিট গোস টু হার! এই হচ্ছে আমাদের পিরোজপুরের ভাবী যে গাছে উঠে পেয়ারা পারতেন। পুকুরে গামছা দিয়ে ইচা মাছ ধরতেন। হার মানেননি জীবন যুদ্ধে। লড়েছেন। তার চার বছরের সেই ছোট্ট লাকি কত বড় হয়েছে, সে এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে না পড়ায়। আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই চাচা তোমাকে কত চকোলেট, আইসক্রিম খাইয়েছেন। সাথে আরেকটি মেয়ে, ভাবী বললেন, এটা হচ্ছে আমার ছোট মেয়ে। সোনালী চুল হাল্কা নীল চোখ হলেও মায়ের মুখের মিষ্টি হাসিটি সে পেয়েছে।
সেদিন পার্টি থেকে বাসায় ফেরার সময় একটা ভাল লাগার আনন্দ হচ্ছিল। ভাবী দেখিয়ে দিলেন কারো জন্য হাহাকার করে জীবন কাটানো ঠিক নয়। কেউ অন্য কারো দয়ার উপর নির্ভর করে বাঁচতে পারেনা। সুস্থ সুখী মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের জন্মগত নয়। সে অধিকার আমাদের তৈরি করে নিতে হয়।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|