খালি চোখে, অশ্রু চোখে আশীষ বাবলু
জনাব নুরুল আজাদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে
কিছু কিছু মানুষ হঠাৎ করে এসে কারো কারো জীবনের একটা নতুন দিক খুলে দেয়। জনাব নুরুল আজাদ আমার জীবনে তেমনই একজন মানুষ।
দিন তারিখ ঠিক মনে করতে পারছিনা তবে সালটা ১৯৯১-৯২ হয়তো হবে, সিডনির কোন এক অনুষ্ঠানে আজাদ ভাই ঘোষণা করলেন তিনি একটা নিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করবেন। ঘোষণাটা জোরালো এবং উত্তেজনাপূর্ণ হলেও আমি খুব উৎফুল্ল হইনি। ভেবেছিলাম এটা শুরু করা যত সহজ চালিয়ে যাওয়া তত সহজ হবেনা।
কাজী নজরুল ইসলাম একবার কোন এক পত্রিকার পাঁচ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমাদের দেশে নতুন পত্রিকার জন্ম শিশু জম্মের সমান নাহলেও, পত্রিকার মৃত্যুর হার শিশু মৃত্যুর চাইতে বেশি। আজাদ ভাইর এই ঘোষণার কিছু দিন আগে এমন একটি মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করেছি। আমারা ক‘জন বন্ধু মিলে ‘সাঁকো’ নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলাম। তবে গোটা দশেক সংখ্যা বের করার পর সাঁকো নড়বরে হলো এবং ভেঙ্গে পরলো। পত্রিকা প্রকাশ করতে প্রচুর খাটুনি এবং টাকা-পয়সার একটা ব্যাপারও আছে। শুরুর উৎসাহটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা সহজ হয়না। ‘শাপলা’ নামেও একটা পত্রিকা তখন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন বের করতো তবে সেটা বছরে একটি কি দুটি। আমাদের এই পত্রিকাগুলো ছিল হাতে লেখা এবং প্রিন্টিং মানে ফটোকপি। এখানে ছোট্ট একটা ইতিহাস যোগ করে দেই সেই সময় একজন ভদ্রলোক নামটা আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। গামা-ভাই হয়তো মনে করতে পারবেন। তা‘র স্ত্রী এখানে পড়ালেখা করতে এসেছিলেন, আমরা নাসরিন আপা বলে মনে আছে ডাকতাম। তিনি বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেস খাটা-খাটুনি করতেন। তা‘র স্বামী ভদ্রলোক এখানে একটা পত্রিকা বের করে ছিলেন। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘সাত সমুদ্দুর তের নদীর পাড়ে বাঙ্গালী’। সে পত্রিকাটি বাংলা টাইপ করে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন কম্পিউটারে বাংলা টাইপ করা এত সহজ ব্যাপার ছিলনা। বিজয় সফটওয়ার বাজারে আসেনি। তিনি কোথা থেকে বাংলা টাইপ করার একটা পোগ্রাম জোগাড় করেছিলেন। বাংলা টাইপ করার কষ্টকর অভিজ্ঞতা তিনি আমাকে একদিন বলেওছেন। সেই পত্রিকার দুটি সংখ্যা তিনি বের করতে পেরেছিলেন।
যাইহোক, জনাব নুরুল আজাদের সেই ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হলো ‘স্বদেশ বার্তা’। সুন্দর ঝকঝকে ছাপা। প্রফেশনাল। হাতে নিলে মনে হতো বাংলাদেশ হাতের মুঠোয়। পরবাসে এর চাইতে বেশি কে চায়! একটা অভিনন্দন পত্র পাঠিয়ে দিলাম।
এর কিছুদিন পরই আবার কোন এক অনুষ্ঠানে আজাদ ভাইর সাথে দেখা হলো। সেখানে আমাকে বললেন, ‘আশীষদা আমাদের পত্রিকার জন্য একটা নিয়মিত কলাম আপনি লিখুন’। আমি বললাম, কলাম লিখবো! কখনো সিরিয়াসলি লিখিনি’। আজাদ ভাই বললেন ‘আপনাকে লিখতেই হবে। আগামী সংখ্যায় লেখা চাই’। আমি হেসে কথাটা উড়িয়ে দিলাম।
পরদিন বাসায় আজাদ ভাইর টেলিফোন। ‘আশীষদা, লেখা কতদূর?’ আমি বললাম, ‘আমাকে দিয়ে হবেনা ভাই’। তিনি বললেন, ‘একটা কাজ করুন, আপনার কলামের নাম কি হবে আমাকে জানান, আমরা প্রচার শুরু করে দেবো।’ আমি বললাম ‘বলেন কী? আমি কোন হরিদাশ পাল যে আমার নাম প্রচার করা শুরু করতে হবে!
তারপর যা হয় তাই হল, এসব ব্যাপার একবার মাথায় ঢুকিয়ে দিলে প্রত্যেক বাঙ্গালীর ভেতর থেকে রবীন্দ্রনাথ জেগে ওঠে। ঢাকায় সাপ্তাহিক বিচিত্রা অপিসে ধর্না দিয়ে বহু কষ্টে একটা কবিতা ছাপা হয়েছিল, তাও কবি ফজল সাহাবুদ্দিন কবিতাটা কেটেছেটে ঠিক করে দিয়েছিলেন। কি আনন্দ হয়েছিল নিজের লেখা ছাপা অক্ষরে দেখে। আজ এমন একটা অনুরোধ স্বয়ং পত্রিকার মালিকের কাছ থেকে! রাতে ঘুমাই কী করে বলুন?
শেষ পর্যন্ত কয়েকটা কলামের নাম লিখে পাঠালাম। তিনি বেছে নিলেন ‘খালি চোখে চশমা চোখে’। শুরু হলো আমার সিরিয়াস লেখক জীবনে পদার্পণ। পি,এস, চুন্নুর ফোন আসতো, দাদা লেখা ফ্যাক্স করুন। লুৎফর রহমান শাওনের ফোন আসতো, ‘লেখা কোথায় ? আজ বুধবার’। সেই এক উৎসবের সময় আমার জীবনে। সব সময় মাথার মধ্যে বিভিন্ন টপিক ঘুরপাক খাচ্ছে। লিখে গেছি ‘খালি চোখে চশমা চোখে’ যতদিন স্বদেশ বার্তা বেড়িয়েছে। দশ বছর কিংবা তারও বেশি। মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি অকুণ্ঠ ভালবাসা। আজাদ ভাইর টেলিফোন পেতাম, আশীষদা আপনার এবারের লেখাটা পড়ে খুব হেসেছি’।
তখন আজাদ ভাইর ‘স্বদেশ বার্ত’ ছিল সিডনির সবচাইতে আলোচিত প্রসঙ্গ। প্রথম দিকে পি,এস চুন্নু এবং পরে লুৎফর রহমান শাওনের হাত ধরে এর জয়যাত্রা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার এই গানের তরী ভাসিয়ে ছিলেম নয়ন জলে, সহসা কে এল গো এ তরী বাইবে বলে’। এটাই জীবন। শুরু করতে হয়, তারপর কোথা থেকে সহযাত্রী পাওয়া যায়। সহযোগিতা পাওয়া যায়।
এই শুরুটা সবাই করতে পারেনা। এর জন্য চাই একটু হিম্মত। আজাদ ভাই ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা খুব ভাল বুঝতেন। একটা সময় ১৪খানা চেইন অব রেস্টুরেন্টে তা‘র ছিল। কিন্তু তা‘র মত দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী খুবই কম চোখে পরে। তিনি দেশপ্রেমের সাথে ব্যবসা কখনও মেশান নি। তা‘র বুকে ছিল এক নদী আবেগ, আর চোখে ছিল এক আকাশ স্বপ্ন। দেশের টানে এখানকার ব্যবসা ফেলে চলে গেলেন বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসের জন্য। এটা একটা সহজ ঘটনা নয়। আগেই বলেছি, হিম্মত লাগে।
এমন একটা মানুষ এত অল্প বয়সে চলে গেলেন। পৃথিবীতে নুরুল আজাদরা আসেন, বড় নিঃশব্দে। কত প্রেরণার উৎস হয়ে থাকেন। সংসারে তাদের তেমন কোনো নাম থাকেনা তবে তাদের মত কিছু মানুষ আছে বলেই এতকিছুর মধ্যেও পৃথিবীটা নিয়মমতো পাক খাচ্ছে। আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং প্রণাম আজাদ ভাইকে।
কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস.........
আশীষ বাবলু, সিডনি
|