বই পরিচিতিঃ লিনু হকের লেখা ‘মেয়ে বিচ্ছু’ আশীষ বাবলু
মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বই বাজারে অনেক আছে তবে এই বইটির বিশেষত্ব হচ্ছে এমন সব কাহিনী এতে পড়লাম যা আমার ধারনার বাইরে। ঢাকার কিছু মেয়ে, কিশোরী বললে হয়তো ঠিক বলা হয় তা‘রা কি সব অবিশ্বাস্য দুঃসাহসী কাণ্ড ঘটিয়েছে যা অভাবনীয়।
বইয়ের শুরুতেই রয়েছে আজিমপুর তথা সত্তরের ঢাকার বর্ণনা যা আমার জীবনের অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে। আজিমপুর, কামরুন্নেসা, বাংলা বাজার গার্লস স্কুল, এই নাম গুলো পুরানো প্রেমিকার নামের মতো এত বছর পর বুকের মধ্যে হঠাৎ করে বেহাগের সুর তুলেছে। আজিমপুর বিদ্যালয়ের টিফিন তৈরির রান্নার বর্ণনা আমার স্কুল মানে পগোজ স্কুলের সাথে হুবহু মিল খুঁজে পেলাম। সিঙ্গারা, লুচি-তরকারী, নিমকি মিষ্টি, গজা, হালুয়া-লুচি আহা সেই সব দিন...
সাত সকালে জিঞ্জিরার সেই হঠাৎ পাকবাহিনীর আক্রমণ। মাথার উপর দিয়ে ছুটছে গোলাগুলি। হাজারো মানুষের সাথে সেদিন আমি আমার ছোট্ট পরিবারটির সঙ্গে ছুটেছিলাম, মা বোনদের খুঁজে পেয়েছিলাম, কিন্তু বাবাকে পাইনি। সে এক কঠিন সময়!
সেই একাত্তরের দিনগুলোতে ঢাকায় পাকিস্তান প্রেমীদের বাড়ি বাড়ি লুকিয়ে মেয়ে বিচ্ছুরা বিলি করেছে লাল চিঠি। চিঠিতে লেখা - তোমরা যা করছ সব মুক্তিবাহিনীর কাছে খবর চলে যাচ্ছে। সাবধান হয়ে যাও।
সাত সকালে উঠে শহরের দেয়ালে পোস্টার লাগানো, পাকিস্তান বাহিনী সারেন্ডার কর! বিচ্ছু মেয়েরা তাদের জামার নিচে লুকিয়ে নিয়ে যেতো সাইক্লোস্টাইল করে ছাপানো সে সব পোস্টার!
১৯৭১ এর ঈদ যাতে জাঁকজমক ভাবে পালন না করা হয়, সেই পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেয়া হলো আজিমপুর স্কুলের কিশোরী মলিকে। দেশের এই দুর্যোগে ঈদের আনন্দ করিবেন না। পাকিস্তানী পোশাক বর্জন করুন। সেই পোস্টারের লেখিকা বর্তমানে সিডনির টুঙ্গাবির বাসিন্দা। মলি আহমেদ। স্বামী আর্কিটেক্ট।
শুধু নতুন কাপড় পরতে নিষেধ করেই শেষ নয়, মেয়ে বিচ্ছুরা সিরিঞ্জে সালফিউরিক এসিড ভরে রাস্তায় বেড়িয়েছিল কাপড় ফুটো করতে!
ফতেহ লোহানীর দিকে গ্রেনেড ছোড়ার ঘটনাটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন থ্রিলার পড়ছি।
লেখিকা লিনু হক অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন, যাদের নাম কোনদিন হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লেখা হতোনা। অথচ কি সাহসের সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন তারা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স পঞ্চাশ পেড়িয়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়স হয়ে যাচ্ছে। অনেকে তো আমাদের ছেড়ে চলেও গেছেন। যার স্মৃতিতে যা আছে লিখে রাখা বড় প্রয়োজন। রাজা, বাদশাহ, সেনাপতি. উজির-নাজিরদের ইতিহাস লেখার মানুষ অনেক রয়েছেন। এইসব নাম গোত্রহীন মানুষের প্রাণ বাজী রাখা আত্মত্যাগ যেন হারিয়ে না যায়!
লিনু হককে বলছি, লেখাগুলো যে বলিষ্ঠ কলমে লেখা তার মধ্যে কোন ভুল নেই। নিজেকে নিয়ে বড় কথা নেই, বড় কথা বলার ভান বা চেষ্টাও নেই। ইতিহাস লেখার তার কোন উদ্দেশ্য ছিলনা, কিন্তু অজান্তে তিনি লিখে ফেলেছেন।
মাঝে মাঝে মনে হয়েছে তিনি যদি সে সময় ডায়রি লিখতেন, তবে আমরা আরেক খানা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পেতাম। যার অগ্রভাগে থাকতেন তিনি এবং তার মেয়ে বিচ্ছুরা।
শেষে একটা কথাই বলবো, এমন সব কাহিনী শুনতে আমরা কান পেতে থাকি।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|