গল্প
মায়ের ভাষা আশীষ বাবলু
ডিসেম্বরে ক্যানবেরায় কনকনে শীত। তবু আমাকে যেতে হবে। নিজের কাজে নয়, অফিসের কাজে। সেখানে এক হপ্তা লাগবে- তা’র বেশিও লাগতে পারে।
শহরটা আমার খুব একটা পছন্দের নয়। শুধু আমার কেন, সেখানে স্থায়ী বসবাসকারীরা মুখে না বললেও খুব একটা পছন্দ করে বলে মনে হয়না। কী করা যাবে রুটি রুজির প্রশ্নে পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা একটু দূরেই রাখতে হয়। আমরা গাদা গাদা লোকের মাঝে বাঁচতে শিখেছি। ভাতের গন্ধের মত আমাদের প্রয়োজন মানুষের গন্ধ। কিন্তু ক্যানবেরা বড় ফাঁকা। ব্যর্থ প্রেমিকের বুকের মত হাহাকারে ভরা। তুমি নেই তুমি নেই...।
বন্ধু আরিফ বললো ক্যানবেরা যাচ্ছিস যখন আমার একটা উপকার করে দে। কি উপকার? আমার এক খালা ক্যানবেরায় আছেন তুই ফিরবার সময় খালাকে নিয়ে আসবি। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। সিডনিতে আমার এখানে কিছুদিন থাকবেন। আমি বললাম এটা কোন ব্যাপারই না। তিন ঘণ্টা একা একা ড্রাইভ না করে তোর খালার সাথে গল্প করতে করতে ফিরবো। ভালই হবে।
সৌভাগ্যক্রমে আমি ক্যানবেরায় যে হোটেলে উঠেছিলাম সেখান থেকে পাঁচ ছয় মিনিটের ড্রাইভ যেখানে খালাম্মা থাকেন। গিয়েই ফোন করেছিলাম। ফোন ধরেছিলেন আরিফের খালাতো ভাই ইমরান আহমেদ। বললেন, চলে আসুন, আপনার হোটেল থেকে আমাদের বাড়িত হাঁটা পথ।
সাবার্বটি পুরনো হলেও নতুন উদ্যমে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বড় বড় কমপ্লেক্স, সাথে প্রচুর গৃহস্থ বাড়ি। ওনাদের বাড়িটি একদম ব্রান্ড নিউ। নতুন বাড়ি আর নতুন গাড়ির একটা গন্ধ আছে। গন্ধটি বড়ই মধুর। আরিফের খালাতো ভাই ইমরান সাহেব কথাবার্তা কম বলেন। লেখাপড়া করেছেন আমেরিকার ওয়াশিংটনে। সাত বছর হয়েছে আছেন ক্যানবেরায়। ইমরান আহমেদের স্ত্রী ট্রেতে চা আর কিছু ভাজাভুঝী নিয়ে এলেন। হালকা হলুদ শাড়ির সাথে নীল ব্লাউজ। চুল খোলা রেখেছেন। তিনি জানেন চুল খোলা রাখলে তাকে ভাল দেখায়। সুন্দরী মহিলা, তবে একদম হাসেন না। না হেসে তিনি সৌন্দর্যের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।
খালাম্মা এলেন। সত্তুর পেরিয়েছেন। উনি একটা হাসি দিয়ে বসলেন সোফার এককোণে। বললেন,তুমি বুঝি আরিফের বন্ধু। ও আমার প্যাডের পোলা না তবে পাইল্লা বড় করছি আমি। ওদের পাঁচ বছরের ছেলেটি যেভাবে খালাম্মার গা ঘেঁসে বসলো মনে হচ্ছে দাদীকে খুবই পছন্দ। খালাম্মা আমাদের সাথে যোগ দেবার পর পরিবেশ গেল পাল্টে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপিটাল টেরিটোরি হয়ে গেল ‘মাধব-পাশা’ গ্রাম। যার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ‘কীর্তনখোলা’। খালাম্মা বললেন, এহেনের লেকটা বড় সুন্দর, মোগো ‘দুর্গা-সাগর’ দিঘির মত। তোমগো এহেনে সবজির বাজার বড় চ্যাতা (গরম)। কচুর লতি পাওয়া যায়না।
আমার সাতদিন ক্যানবেরা বাসের সময়টায় পাঁচদিন সে বাড়িতে গিয়েছি। খালাম্মা-তো একবার নিজেই আমাকে ফোন করেছেন। ‘শুটকির ভর্তা বানাইছি, মোগো সাথে এউক্কা ভাত খাইয়া যাইও’।
ইমরান আহমেদ ভাল মানুষ। ভদ্রলোক কর্মক্ষেত্র নিয়ে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে আছেন। বেশ গম্ভীর টাইপের। অফিসের বড়কর্তা হওয়া আর স্বামী বা পিতা হওয়া এ দুটি ব্যাপার তিনি ঘুলিয়ে ফেলেছেন। স্ত্রী মলি আহমেদ স্মার্ট, সুন্দরী। বাংলার চাইতে ইংরেজিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। দার্জিলিঙে বোর্ডিং স্কুলে তিনি লেখাপড়া করেছেন। ক্যানবেরার সোশাল সার্কেলের খবরাখবর রাখেন। হাউজ ওয়াইফ। তা‘র পিতার নাম শুনেই চিনতে পারলাম। মলি আহমেদ ঠিকই করেছেন। এত বড় ইন্ডাসট্রিয়ালিস্টের একমাত্র কন্যার নয়টা পাঁচটা চাকুরী করা একদমই মানায়না !
আহমেদ দম্পতী ইদানীং একটা ব্যাপার নিয়ে খুবই চিন্তিত। ইমরান সাহেব তা‘র পিতার মৃত্যুর পর তার মাকে অর্থাৎ খালাম্মাকে অস্ট্রেলিয়ায় পার্মানেন্ট-লি নিয়ে এসেছেন। এমনিতে কোন অসুবিধা নেই। তবে সমস্যা হচ্ছে তাদের সন্তানকে নিয়ে। সমস্যার কারণ খালাম্মার ভাষা। উনি বরিশালের ভাষায় কথা বলেন। তা’র ছেলেও এখন যাবা, খাবা, ঘুমাবা এই ভাষায় কথা বলছে !
হিসেব মিলাতে পারিনা। যে বরিশালের জসিমউদ্দিন, সুফিয়া কামাল, জীবনানন্দ দাশ, আব্দুল লতিফ, বাঙ্গালী জাতিকে বাংলা শেখালেন। যে বরিশালের আব্দুল গাফ্ফর চৌধুরীর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি - কণ্ঠে ধারণ করতে না পারলে নিজেকে বাঙ্গালী বলা যায়না। সেই বরিশালের খালাম্মা নাতির সাথে বাংলা বলতে পারবেন না। হিসেব কিছুতেই মেলেনা। সেদিনও নেহাল ভাই বলছিলেন,পদ্মা সেতুটা শেষ হইতে দ্যান দ্যাখবেন বরিশাল হইবে বাংলা দেশের রাজধানী।
মলি আহমেদকে যতটুকু দেখেছি ছেলের সাথে ইংরেজিতেই কথা বলেন। ইমরান সাহেব বরিশালী জবান চেপে শুদ্ধ বাংলা বলার চেষ্টা করেন। দুজনেই বলছিলেন, ছেলেটা এমনিতেই দেরিতে কথা বলতে শিখেছে, তাই আমরা ইংরেজিটাতেই জোড় দিচ্ছি। একটু আধটু বাংলা-তো বলতেই হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে মাকে নিয়ে। আম্মাকে আমদের বলাটা হয়তো ঠিক হবেনা,আপনাদের সিডনিতে যখন আম্মা যাবেন আপনারা যদি সমস্যার কথাটা একটু বুঝিয়ে বলেন তবে আমাদের খুবই উপকার হয়। আমি কোন কথা না বলে মাথা নাড়লাম। মনে মনে ভাবলাম বুকে এত-বড় একটা পাথর কোনদিনই বাঁধতে পারবোনা যে দাদীকে বলবো আপনি আপনার নাতির সঙ্গে কথা বলবেন না!
জীবনে অনেকবার ক্যানবেরা গাড়ি ড্রাইভ করে যাতায়াত করেছি তবে খালাম্মাকে সঙ্গে নিয়ে সিডনি ফিরে আসা এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। কথায় কথায় তিন ঘণ্টা যে কী ভাবে পার হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। খালাম্মার ঠাণ্ডা লেগে গলায় ব্যথা হয়েছিল। হয়তো টনসিল জাতিয় কিছু হবে। ঐ ব্যথা গলায়ই কত কথাইনা তিনি বলছিলেন। তা’র ১৫ বছর বয়সের বিয়ের গল্প। ভোলা থেকে পিরোজপুর। খাওন লইয়া বরযাত্রীদের কী কাইজ্যা কী কাইজ্যা!
অনেক কিছুই বদলাল কিন্তু আমাদের মা মাসীরা বদলালেন না। খালাম্মার শরীরে মনে হচ্ছিল আমার মায়ের গন্ধ। কষ্ট হয় ভাবলে, মায়েরা ধীরে ধীরে এখন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। খালাম্মাকে আরিফদের বাসায় ড্রপ করলাম। খালাম্মাকে পেয়ে আরিফ মহা-খুশি। মানুষের নিজের মুখ দেখতে আয়না লাগে। খালাম্মাকে পেয়ে আরিফ অনেকদিন পর দেখছিল নিজেকে। দেখছিল তা’র ধমনী জুড়ে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা!
বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। আমি আমার রুটিনে বাঁধা জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। একদিন অফিস থেকে ফিরেছি, হঠাৎ আরিফের ফোন। কিরে কী খবর? আরিফ গম্ভীর গলায় বললো, খালাম্মা হসপিটালে। কেন ? কি হয়েছে?
গলায় ব্যথা, তাই ডাক্তার দেখিয়ে ছিলাম। হ্যাঁ, আমাকেও তো বলছিলেন গলায় ব্যথা। বোধহয় টনসিল হয়েছে।
ডাক্তার প্রথম ভেবেছিল ল্যারিনজাইটিস। পরে দেখলো সিস্ট হয়েছে ভোকাল-কর্ডে। বেশ বড়। তাই অপারেশন করা হয়েছে। এখন কেমন আছেন ?
ভালই আছেন। তবে একটা সমস্যা হয়েছে তিনি কথা বলতে পারছেন না।
ক্যানবেরায় খবর দিয়েছিস?
হ্যাঁ।
খালাম্মা আর কথা বলতে পারবেন না। মাধব-পাশা, পিরোজপুর, দুর্গা-সাগর, ভোলা, চোখের সামনে ভেসে এলো ছবির মত। তবে নির্বাক। কীর্তনখোলার জল উথাল পাথাল করে মিশবে কীর্তিনাশার বুকে। কিন্তু নিশ্চুপ। কোন শব্দ আর কারো কানে পৌঁছাবে না।
ক্যানবেরার আহমেদ পরিবারের সমস্যাটা কী অদৃশ্য ইশারায় সমাধান হয়ে গেল। খালাম্মা এখন থেকে আর নাতির সাথে কথা বলবেন না।
ashisbablu13@yahoo.com.au
|