গাড়ি, কুকুর ও একটি মেয়ে আশীষ বাবলু
মেয়েটি দেখতে স্বপ্নে দেখা পরীর মত। প্রত্যেক শনিবার দুপুরে সে গাড়ি ধোয় ওদের ড্রাইভওয়েতে। ছোট্ট মিনি কুপার। আকাশ আকাশ রং। বড় একটা স্পঞ্জে প্রচুর সাবান দিয়ে পুরো গাড়িটা ফেনায় ভরিয়ে দেয়। মনে হয় নীল আকাশ সাদা মেঘে ছেয়ে গেছে। তারপর হৌস দিয়ে সন্তর্পণে পানি দেয়। মেঘ কেটে নীল আকাশ জেগে ওঠে। এরপর মেয়েটি পানির হৌসটি নিজের মাথার উপর ধরে থাকে মিনিট খানেক। সোনালী চুল আর সমস্ত শরীর বেয়ে পানি পড়তে থাকে ড্রাইভওয়ের খয়রী মেঝেতে। তখন তা’র চোখ বন্ধ থাকে। মনে হয় মেডিটেশন করছে।
একটু দূরে মেয়েটির ধবধবে সাদা মলটিজ টেরিয়ার ছোট্ট কুকুরটি বসে থাকে। শুধু বসে থাকে বললে ভুল হবে, পানি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে উপভোগ করে সেই দৃশ্য। শুধু কুকুরটি নয় সেই দৃশ্য আমিও দেখি আমাদের জানলার ফাঁক থেকে। লুকিয়েই বলা যায়। আমাদের বাড়িটা ঐ বাড়ির উল্টো দিকে।
মেয়েটি স্বর্ণকেশী, টগবগে যৌবনের অধিকারিণী। এবং যে সব জায়গায় যৌবন থাকে সে সব ঢেকে-ঢুকে রাখবার জন্য যতটুকু কাপড়ের দরকার তার চাইতে কমই সে ব্যাবহার করে। লুকিয়ে কোন কিছু দর্শন করা অন্যায়, তবে বলতে দ্বিধা নেই দৃশ্যটি দেখার পর আমার মনে একটা আনন্দ এবং হতাশা-বোধ জন্মায়। আমি এ পাড়ায় নতুন এসেছি। এই কিছুদিনের মধ্যে বহুবার মেয়েটিকে দেখেছি। কখনও জগিং করছে কখনো সাইকেল চালাচ্ছে, কখন গাছে জল দিচ্ছে। সব সময় কিছুনা কিছু নিয়ে ব্যস্ত। কুকুর ছাড়াও মেয়েটির ছেলে বন্ধু আছে এবং মেয়ে বন্ধুও। সব মিলিয়ে হাফ-ডজন। মাঝেমধ্যেই এরা আসে কখনো একা আবার দল বেঁধে। কল-কাকলিতে ভরে ওঠে আমাদের ছোট্ট রাস্তাটা। মেয়েটি মিনি স্কার্ট আর টাইট টী-শার্ট পরে পেন্সিল হিলে খট খট আওয়াজ তুলে বন্ধুদের সাথে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে যায়। ওদের উচ্ছল যৌবন দেখে ভাল লাগে। সেই গানটার মত, আমরা নতুন যৌবনেরই দূত। আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত .....আমরা বিদ্যুৎ। হিংসা হয়, আমাদের যৌবনে এত স্বাধীনতা ছিলনা। জীবনভর-তো শুধু উপদেশই শুনে এলাম। বাচ্চা বয়সে মার্বেল খেলতাম, ঘুড়ি উড়াতাম, বাবা বলতেন আগে লেখাপড়া তারপর এসব। যৌবনে এক মেয়ের চিঠি শার্টের পকেটে আবিষ্কার করেছিল মা, তারপর চর, থাপ্পড় কিছুই বাদ পড়েনি। লেখাপড়া শেষ হল, ঠিক করলাম এবার বন্ধুরা মিলে একটু কক্সবাজারে হপ্তা খানেক বেড়াতে যাব, আগে চাকুরী জোগাড় কর তারপর বেড়াতে যেও। চাকুরী পাবার পর, আগে বিয়ে কর তারপর বৌকে নিয়ে বেড়াতে যেও। বিবাহিত জীবনতো মারহাবা। একটু রাত পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা, একটু তেলে ভাজা, একটু হুইস্কি। স্ত্রীর হুঙ্কার, আমি বেঁচে থাকতে এসব হবেনা। এদিকে সময় যাচ্ছে জীবনের পাশ কাটিয়ে। এটা শুধু আমার একার জীবন নয়। আমাদের মধ্যবিত্ত প্রত্যেক পরিবারে ঐ একই চিত্র। আর মেয়েদের জীবন তো আরও হাজারো - এটা করোনা ওটা করোনাতে ভরা। সেদিন লাভলী ভাবী বলছিলেন, ইউনিভার্সিটি থেকে পিকনিকে যাবো কিছুতেই বাসা থেকে যেতে দিল না কারণ পিকনিকে মেয়েদের সাথে ছেলেরাও যাবে। সারারাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেঁদেছিলাম।
অস্ট্রেলিয়ার এসে একটা বড় জ্ঞান অর্জন করেছি যে - জীবন বড্ড ক্ষণস্থায়ী তাই প্রত্যেকটা মুহূর্ত উপভোগ কর। জীবন মানে মুহূর্তের গাঁথা মালা। যে সময় যায় তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায়না।
যাই হোক সেই মেয়েটির কথা লিখছিলাম। একদিন কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দেখি মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। দরজা আলো করে দাঁড়িয়ে মেঘবতী, অথচ খিল আটা সকল দ্বার! কারণটা খুবই সিম্পল। মেঘবতী তা’র আদরের কুকুর খুঁজে পাচ্ছেনা। আমি কি দেখেছি? আমি বললাম স্যরি, না দেখিনি। সে আনত মনে পাশের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। কুকুরের খোঁজে।
আমি কিছুক্ষণ পর আমাদের ব্যাক-ইয়ার্ডে এসে দেখি, সেই হাড়িয়ে যাওয়া বজ্জাত কুকুর আমাদের পাতি-লেবু গাছের নিচে বাদশাহি মেজাজে একখানা হাড় চিবাচ্ছেন। আমি ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে সেই সু-সংবাদ দিলাম। মেয়েটি আনন্দে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরল। এই সামান্য কাজের জন্য এত-বড় পুরস্কার! মনে মনে ভাবলাম রোজ তোমার কুকুর হারিয়ে যাক, আমি খুঁজে এনে দেবো।
মেয়েটির বয়স কুড়ি-একুশের বেশি হবেনা। এই কুকুর খুঁজে দেবার পুরস্কার হিসেবে সে এখন আমাকে দেখলেই হাই, হ্যালো বলে। আমি ওর কুকুরকে আদর করি। মেয়েটি ওর মায়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, দিস্ জেন্টলম্যান আমার কুকুর খুঁজে পেয়েছিল। মেয়েটির মা একটু মুটিয়ে গেলেও এককালে যে সুন্দরী ছিলেন তার মুচকি হাসিটি দেখলে বোঝা যায়। মহিলা সবসময় ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে থাকেন।
কিছুদিন হল আমার ভেতরে একটা পরিবর্তন হয়েছে। লুকিয়ে মেয়েটির গাড়ি ধোওয়া আর দেখতে পারি না। একটা অপরাধ-বোধ আমার ভেতরে কাজ করে। ও যখন গাড়ি ধোয় আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে আসি। ও আমার সাথে গাড়িতে সাবান মাখাতে মাখাতে কথা বলে। গতকাল প্যান্ডেলহিলস্এ একটা গাছের নিচে সে গাড়ি পার্ক করেছিল, গাড়ির ছাদে বার্ডস ড্রপিং-এ ভরে গেছে ইত্যাদি। মেয়েটির সহজ সরল কথাবার্তা আমি উপভোগ করি। ইদানীং আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলি ও কি পোশাক পরেছে বা পড়েনি সে সব এখন আর মাথায় আসেনা। একদিন-তো মেয়েটির গাড়ি ধুতে আমি সাহায্যও করলাম!
আজকে এ কাহিনী লেখার পেছনে একটা কারণ আছে । একদিন মেয়েটির জোরে জোরে কথা বলা শুনে আমি ঘর থেকে বাইরে গেলাম। দেখলাম মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে মাঝবয়সী একজন ভদ্রলোককে গালাগাল দিচ্ছে। আমাকে দেখে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। বললো এই লোকটা তাকে ডার্টি কথা বলেছে। লোকটাকে আমি চিনি। দুটো বাড়ির পর থাকে। আমাদের মতই ইমিগ্রেন্ট।
মেয়েটির পোশাক এবং চালচলন দেখে নিশ্চয় সে সহজলভ্য ভেবেছিল । এটা খুবই ভুল ধারনা। বদ্ধ সমাজে বসবাস করে এসব দেশে এসে এমন ভুল অনেকেই করে বসে। মানুষের চরিত্র আর পোশাক এ দুটি আলাদা বস্তু। ঘোমটার আড়ালেও খেমটা নাচা যায়। নদীতে অবগাহন না করলে নদীকে চেনা যায়না। লোকটার ভাগ্য খুব ভাল মেয়েটি পুলিশকে নালিশ করেনি।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|