bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













জাতীয় সঙ্গীত
আশীষ বাবলু



হাজার খানেক গান জমা পরেছে তবে ভ্লাদিমির পুতিনের একটিও পছন্দ হচ্ছিল না। তিনি চাইছিলেন, যে সুরে সোভিয়েত রাশিয়ার জাতীয় সঙ্গীত এত বছর জনগণ গেয়েছেন সে সুরেই নতুন রাশিয়ার জাতীয় সঙ্গীত হোক। পুতিন খুব ধৈর্য ধরে একটি একটি করে জমা পড়া গানের কথাগুলো পড়ছিলেন, কিন্তু একটিও তার মনে ধরছিলো না। হতাশ হয়ে তিনি ডেকে পাঠালেন সার্জি মিখলভকে। সেই কবে ১৯৪৪ সালে সার্জি মিখলভ সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিয় সঙ্গীত লিখেছিলেন, এখন সে ৮৭ বছরের বৃদ্ধ। প্রেসিডেন্ট পুতিন বললেন, সার্জি তুমি আবার একটা জাতীয় সঙ্গীত লেখো, তবে মনে রেখো সেখানে কম্যুনিজম, লেনিন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এই শব্দ জেনো না থাকে।

কিছুদিন পর বৃদ্ধ সার্জি কাঁপা হাতে লিখে আনলেন এক পাতা গান। ভয়ে ভয়ে ভাবছেন পুতিনের কি পছন্দ হবে? পুতিন পড়ছেন, সার্জি তাকিয়ে আছেন তার কঠিন মুখের দিকে। পড়া শেষ করে ভ্লাদিমির পুতিন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন বৃদ্ধ সার্জিকে। বললেন, এমন একটি লেখাই আমি চাইছিলাম। সার্জি মিখলভ পৃথিবীর একমাত্র কবি যিনি একই দেশের জাতীয় সঙ্গীত দু‘বার লিখেছেন।

১৮৫৩ সালে ম্যাক্সিকোতে জাতীয় সঙ্গীত লেখার জন্য একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এক মেয়ে তার কবি প্রেমিকের কাছে বায়না ধরেন তাকে সেই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য। কবি প্রেমিকটি কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অনেক কান্নাকাটি, ঝগড়াঝাঁটির পরও যখন ছেলেকে রাজি করানো যাচ্ছিলোনা তখন মেয়েটি একটি ঘরে তার হাতে একটি খাতা কলম ধরিয়ে দিয়ে দিল দরজায় তালা! মেয়েটি ভেবেছিল, যে ছেলে এতো সুন্দর প্রেমপত্র লেখে সে জাতীয় সঙ্গীত লিখতে পারবেনা কেন?

প্রায় একদিন সেখানে আটকে রেখে ক্ষুধার্ত প্রেমিককে যখন ঘর থেকে বেড় করা হলো তখন দেখা গেল ৯/১০ লাইনের একটি কবিতা সে লিখেছে। এবং সেই কবিতাটিই প্রতিযোগিতায় সব চাইতে ভালো লেখা হিসেবে বিবেচিত হলো। কবি প্রেমিকের নাম ফ্রেন্সিসকো গনজালেস। প্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে বলবোনা, প্রেমে বাধ্য হয়ে লেখা গানটি আজও মেক্সিকোর জনগণের প্রাণপ্রিয় জাতীয় সঙ্গীত।

আমার জানা ছিলনা পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের জন্যেও একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সঙ্গীতের সুর তৈরি করা হয়েছিল অনেক আগে ১৯৪৯ সালে। স্বাধীনতার দুই বছরের মধ্যে। সুরটি বানিয়ে ছিলেন গোলাম আলী চাগলা। এর পর ১৯৫২ সালে অনেকের মধ্যে নির্বাচিত হয় কবি হাফিজ জালালাবাদীর লেখাটি। পাক সার জমিন সাদবাদ। কোন বাঙ্গালী কবি সেই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন কিনা জানা নেই। পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত প্রথম রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত হয় ১৯৫৪ সালের ১৩ই আগস্ট।

চিনের জাতীয় সঙ্গীতের পেছনেও একটি সিনেমাটিক গল্প আছে। চিন জাপানের যুদ্ধের সময় ১৯৩৫ সালে সরকারী ভাবে একটি জাতীয় সঙ্গীত গৃহীত হয়। এর কিছু বছর পর চিন সরকারই সেই জাতীয় সঙ্গীতটিকে অবৈধ ঘোষণা করে। কারণটা বেশ ইন্টারেস্টিং! তখন চিনে কালচারাল বিপ্লব চলছে। সেখানে গ্রেফতার হন একজন কবি। বিচারে সাব্যস্ত হয় তিনি দেশদ্রোহী। এই অপরাধী দেশদ্রোহী কবিই ছিলেন চিনের জাতিয় সঙ্গীতের লেখক টিয়ান হু। সরকার পরে মহা সমস্যায়। একজন দেশদ্রোহী কবির লেখা সঙ্গীত জাতীয় সঙ্গীত হয় কি করে? জাতীয় সঙ্গীতের ইজ্জত বাঁচাতে চিন সরকার টিয়ান হুর লেখা গানটিকে অবৈধ ঘোষণা করে। সরকার বুঝতে পারেনি জাতীয় সঙ্গীত রেকর্ডে বাজানো গান নয়। সেটা গ্রামোফোনে নয় মানুষের মনে বাজে। চিনের মানুষের মনের দাবিতে সেই গানকে আবার জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ইজ্জতের সাথে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়।

আমেরিকা ১৭৪৩ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল। সেই ১৭৪৩ থেকে ১৯৩১ সাল মানে প্রায় দুইশত বছর আমেরিকার কোন জাতীয় সঙ্গীত ছিল না। সে দেশের মানুষ ভাবেননি তাদেও একটা জাতীয় সঙ্গীতের প্রয়োজন আছে! ১৯৩১ সালে সরকারি ভাবে আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত গৃহীত হয়। ফ্রান্সিস কী এর লেখা দ্য স্টার স্প্যাংলেড ব্যানার। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে গানটির সুর ব্রিটেনের একটি গানের সুর থেকে নেয়া হয়। ভেবে দেখুন যে দেশের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছিল সে দেশের সুরেই জাতীয় সঙ্গীত!

মালয়েশিয়ার জাতীয় সঙ্গীতের পেছনেও একটা গল্প আছে। ১৮৮৮ সালে মালয়েশিয়ার সুলতান গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। তাকে স্বাগত জানাবার জন্য বিরাট আয়োজন। লন্ডন কর্তৃপক্ষ সুলতানের সহযোগীকে বললেন, আমরা মহামান্য সুলতানের বাকিংহাম প্যালেসে প্রবেশের সময় মালয়েশিয়ার জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে চাই। সহযোগী পরে যায় মহা সমস্যায়। তিনি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, ভাই আমাদের-তো কোন জাতীয় সঙ্গীত নেই! ইংল্যান্ড সফর থেকে ফিরে এসেই সুলতানের আদেশে তৈরি হয় মালয়েশিয়ার জাতীয় সঙ্গীত।

দেশ ভাগাভাগির ঘটনা আমাদের চাইতে কে বেশি জানবে? তবে জাতীয় সঙ্গীত ভাগাভাগি! ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙ্গে দুটো দেশ হয়ে যায়। সে দেশের হিসেবি মানুষেরা জাতীয় সঙ্গীতও ভাগ করে নেয়। প্রথম অংশ এক দেশ বাকি অংশ অন্য দেশ!

স্পেনের জাতীয় সঙ্গীতকে জাতীয় যন্ত্র-সঙ্গীত বলা হয়তো ঠিক হবে। সুর আছে বাজনা আছে তবে কোনো কথা নেই! এ নিয়ে ওদেশের মানুষের মনে কোন মাথাব্যথাও নেই!

ফিলিপিন্স একমাত্র দেশ যে দেশের জাতীয় সঙ্গীত তিনবার তিনটি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। সে দেশ যখন স্পেন রাজত্ব করতো তখন স্প্যানিশ ভাষায়। তারপর ব্রিটিশ রাজত্ব কালে সেই গানটিই ইংরেজি ভাষায় এবং অবশেষে ফিলিপিন্স যখন স্বাধীনতা পেল তখন আবার অনুদিত হলো ফিলিপিনো ভাষায়।

সব চাইতে বেশি জাতীয় সঙ্গীত বদল হয়েছে যে দেশটিতে সেটা হচ্ছে ইরাক। সেখানে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীতেরও পরিবর্তন হয়। শেষবার পরিবর্তন হয়েছে সাদ্দাম হোসেনের যাবার পর।

অস্ট্রিয়ার জাতীয় সঙ্গীতের সুর দিয়েছেন মোজার্ট, সবাই এটাই জানতো। এই কিছুদিন আগে জানা গেলো এটা মোজার্টের সুর নয়! তবে কার?

জাপানের জাতীয় সঙ্গীত কে লিখেছেন কেউ জানে না। এমনকি কবে লেখা হয়েছে তার সঠিক সময় কারো জানা নেই। তবে এটা জানা গেছে যে সঙ্গীতটি লেখা হয়েছে ১১৮৫ সালের আগে! আরও একটি রেকর্ড হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে ছোট জাপানের জাতীয় সঙ্গীত। এটি গাইতে লাগে মাত্র ৪৫ সেকেন্ড!

সবচাইতে বড় জাতীয় সঙ্গীতটি কার? এই রেকর্ড করেছে গ্রীস। লম্বায় ১৫৮ প্যারাগ্রাফ! ঐ জাতীয় সঙ্গীত শুরু হলে খুব সহজে একটা ঘুম দিয়ে আসা যায়। না ভয় পাবেন না, ২/৩ প্যারার বেশি বাজানো হয় না।

সাউথ আফ্রিকার জাতীয় সঙ্গীতে সে দেশে ব্যবহৃত পাঁচটি ভাষাই ব্যবহার করা হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ শাসকদের ইংরাজি ভাষাও বাদ যায়নি। পুরানো সঙ্গীতে ছিল, ‘গড সেভ সাউথ আফ্রিকা’। নেলসন ম্যান্ডেলার অনুরোধে লেখা হয়েছে ‘গড সেভ আফ্রিকা’। ‘সাউথ’ বাদ দেওয়া হয়েছে। বড় মানুষ হলে তার চিন্তা ভাবনা উদার হয়। তাই তিনি ম্যান্ডেলা!

একই কবির লেখা দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত ভারত বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে নেই, তবে একটি দেশের দুটি জাতীয় সঙ্গীত? হ্যাঁ সেটা আছে। নিউজিল্যান্ড আর ডেনমার্ক। একটা জাতীয় সঙ্গীত হলো রাজা/রানীর জন্য, অন্যটি আম জনতার।

এইতো সেদিন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সঙ্গীত কাটছাঁট করা হলো। ‘ফর উই আর ইয়াং এন্ড ফ্রি’ এই লাইনটা নিয়ে অনেক দিন ধরেই একটু আপত্তি ছিল। যে দেশে পৃথিবীর সবচাইতে পুরাতন আদিবাসীর বসবাস সে দেশ ‘ইয়াং’ হয় কি করে? মাত্র ১৭৭০ সালে ইংলিশম্যান ক্যাপটেন জেমস কুকের আগমনের পর থেকে একটা মহাদেশের ইতিহাস কী করে লেখা হয়? তাই ‘ইয়াং’ এর বদলে লেখা হলো ‘ওয়ান’। ‘ফর উই আর ওয়ান এন্ড ফ্রি’। পুরানো নতুন আমারা সবাই এক। পরিবর্তনটা সবাই নত মস্তকে গ্রহণ করেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় সঙ্গীতের পেছনে এমন অনেক মজার গল্প আছে।

আমি শেষ করছি সেন্ট হেলেনার জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে। সেন্ট হেলেনা সাউথ আটলান্টিকে একটি ছোট্ট দ্বীপ। এ দ্বীপটি ছোট হলেও খুবই পরিচিত। সেই ১৮১৫ সালে ওয়াটারলু যুদ্ধে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যখন হেরে যান তখন তাকে এই দ্বীপটিতেই কাটাতে হয়েছিল বাকি জীবন। যদিও ইংল্যান্ডের সাহায্য সহযোগিতায় দেশটি চলে, তবু দেশটির একটি জাতীয় সঙ্গীত রয়েছে। সেই সঙ্গীতটি লিখেছেন একজন আমেরিকান ভদ্রলোক, শুধু তাই নয় ভদ্রলোক কোনদিন সেন্ট হেলেনা দেশটিই দেখেন নি! দেশটির পোস্টকার্ডে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে লিখে ফেলেন সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত!




আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au







Share on Facebook               Home Page             Published on: 9-Apr-2025

Coming Events: