যারে যাবি যদি যা আশীষ বাবলু
আমার কিছু পাখি আছে। সব মিলিয়ে পনের কুড়ি খানা হবে। এরা আমার বন্ধু পাখি। আমি ওদের প্রত্যেককে হয়তো চিনিনা কিন্তু ওরা আমাকে চেনে। পাঠক ভাববেননা ওরা খাঁচার পোষা পাখি। এরা সবাই মুক্ত বিহঙ্গ। এদের বিচরণ ক্ষেত্র হচ্ছে আমাদের বাড়ির ছাদ, কার্নিশ, ব্যাকইয়ার্ড অথবা লেবু আর বটলব্রাশ গাছের ডালে। এই পাখিগুলো আমাকে দেখলে খুশি হয়ে লেজ নাড়ে, ডাকাডাকি করে। কয়েকজন আবার এত খুশি হয়ে যায় যে পঞ্চাশ মাইল বেগে একটা চক্কর মারে আমাদের বাড়ির ছোট্ট আকাশে।
বাড়ির পেছনে আমি একটা বড় পাত্র রেখেছি। সেখানে পরিষ্কার জলের ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন সকাল আটটায় আমি ওদের খেতে দেই। খাদ্য হচ্ছে চাল। খুব ভালবাসে। আমার সাহচর্যে থেকে এরা ভেতো বাঙ্গালি-পাখি হয়ে গেছে। তবে পূজা, ঈদ, ইস্টার, কুইন্স বার্থডেতে একটু স্পেশাল খাবারের ব্যবস্থা রাখি। পাখি হলে কি হবে ওদেরও তো স্বাদ আহ্লাদ আছে। তখন খেতে দেওয়া হয় সানফ্লাওয়ার সিডস্। সানফ্লাওয়ারের বিচি এরা এত তৃপ্তি করে খায় মনে হয় যেন কাচ্চি বিরিয়ানি খাচ্ছে।
এই পাখির ঝাঁকে নানা রকমের পাখি আছে তবে অধিকাংশই ঘুঘু। দুটো শালিক, একজোড়া ‘উইলি ওয়াগটেল’, পেটটা সাদা বাকিটা কালো, ছোট্ট পাখি। কয়েকটা সুন্দরী ‘গালা’, পেটের দিকটা বেবি পিঙ্ক, বড্ড অহঙ্কারী। আর হঠাৎ কখনো হাজির হয় ‘লিটিল লোরেকিট’। শরীরটা সবুজ আর মাথাটা লাল, অনেকটা বাংলাদেশের পতাকা, ওনারা ভ্রাম্যমান অতিথি পাখি।
পাখিরা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে। প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখা ওদের নেশা। সাতসকালে লাইন ধরে সূর্যমুখী হয়ে বসে থাকে।
তবে সবাই ভদ্র স্বভাবের। দু‘একজন আছে মাতব্বর গোছের। ওকে ঠোকরায়, তাকে কামড়ায়। তবে অধিকাংশই ঠাণ্ডা প্রকৃতির। ঘুরে ঘুরে খায়, তারপর চুক চুক করে পাত্র থেকে জল খেয়ে ছাদে বসে আনন্দে রোদ পোহায়। পেটের জ্বালা মানুষ কিংবা পশুপাখি সবারই এক।
এই পাখিদের মধ্যে একজন আছে যার একটা পায়ের পাতা নেই। একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে। দুর্ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছিল জানিনা তবে যেদিন ঘটেছিল সেদিন বাগানের কোণায় মুখ নিচু করে বসেছিল সে, খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল নিশ্চয়ই। আমি ওকে দুহাতে তুলে ঘরে নিয়ে এসেছিলাম, বাঁধা দেয়নি। সম্ভবত উড়বার মত সামর্থ্য ছিলনা। তুলো দিয়ে ওর কাটা পায়ে ডেটল লাগিয়ে ছিলাম। এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে প্যানাডল খাইয়েছি। এত শুশ্রূষা, এত খাবার-দাবারের মধ্যে থেকেও তিন দিন পাখিটি মনমরা হয়ে শুয়ে রইল। ভেবেছিলাম এ যাত্রায় আর বাঁচবেনা। কিন্তু একদিন সকালে দরজা খোলা পেয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল। আমার মনে খুবই আনন্দ হলো। যারে যাবি যদি যা পিঞ্জিরা খুলে দিয়েছি, বশীর আহমেদের সেই বিখ্যাত গান মনে পড়লো। এই পাখিরাই হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষদের মনে প্রথম মুক্তির স্বাদ দিয়েছিল। স্বাধীনতার আনন্দ পাখিদের কাছেই মানুষ প্রথম শিখেছিল।
একটা সুফি গল্প বলি। পারস্য দেশে গল্পটি খুবই পরিচিত। আমি শুনেছিলাম এখানে এক ইরানী বন্ধুর কাছে। সেই দেশে একজন ধনী সওদাগর বাস করতেন। তা’র একটি গানের পাখি ছিল। তাকে রাখা হয়েছিল কারুকার্য খোচিত এক সোনার খাঁচায়। পাখিটিকে খাওয়ানো হতো দামি দামি সব মজাদার খাবার। বাড়ির মালকিন থেকে ছেলেমেয়ে, এবং ভৃত্যরা সবাই তাকে আদর করতো। যতবার অনুরোধ আসতো পাখিটি গান গাইতো। সে এতটুকু অসন্তুষ্ট বা বিরক্ত হতোনা। একদিন সওদাগর ঠিক করলেন বাণিজ্যে যাবেন। সে তা’র স্ত্রী পুত্র কন্যা সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন কার জন্য কি কি নিয়ে আসবেন। সবাই নামি দামি উপহারের লিস্ট তা’র হাতে তুলে দিল। সওদাগর এবার পাখিটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার প্রিয় গানের পাখি, বল তোমার জন্য কি আনবো?
পাখিটি বললো, আমার জন্য কিছুই আনতে হবেনা। আমিতো সোনার খাঁচায় এত খানাদানা, এত আদর যত্নে, আরাম আয়াসে আছি। আমার আর কি চাই? তবে আপনি যে দেশে যাচ্ছেন সে দেশের জঙ্গলেই আমার জন্ম হয়েছিল। যদি সম্ভব হয় আমার বাবা মায়ের সাথে একটু দেখা করে বলে আসবেন, আমি খুব সুখে আছি।
ছয়মাস পর সাত সমুদ্র পেড়িয়ে সওদাগর ঘরে ফিরে এলেন। সবার জন্য নিয়ে এসেছেন তাদের লিস্ট অনুযায়ী দামি দামি উপহার। প্রত্যেকে উপহার পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। এবার সওদাগর সোনার খাঁচার কাছে এসে বললেন, হে আমার প্রিয় পাখি, তোমার কথা অনুযায়ী আমি তোমার মা-বাবার সাথে দেখা করে এসেছি। তবে একটা দুঃখের খবর আছে। পাখি বললো, কেন কি হয়েছে?
সওদাগর বললেন, অনেক গহীন অরণ্যে গিয়ে আমি তোমার মা-বাবাকে খুঁজে পেলাম। তারপর তাদের বললাম তুমি সোনার খাঁচায় সুস্বাদু খাবার দাবার খেয়ে ভালই আছ। আমার কথা শোনার পরই ঘটলো সেই দুর্ঘটনা। তোমার মা.....
কি হলো মায়ের?
তোমার মা ডাল থেকে পড়ে মরে গেলেন।
সওদাগর দেখলেন তা’র কথা শেষ হবার পর পাখিটির চোখ উল্টে গেল, পাখা ঝাপটাতে শুরু করলো। তারপর খাঁচার এককোণে মাথা এলিয়ে ঢলে পড়লো। সওদাগর হায় হায় করে উঠলেন, কি হলো, এ কি হলো আমার গানের পাখির? সে সোনার খাঁচার দরজা খুলে ঢলে পড়া পাখিটির নিষ্প্রাণ তুলতুলে দেহটি হাতের তালুতে রাখলেন। হায় আমার প্রিয় গানের পাখি আর নেই।
সওদাগর হাতে করে পাখিটিকে নিয়ে এলেন প্রাসাদের বাইরে, ফুল-বাগানে। তখনই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। পাখিটি সওদাগরের হাত থেকে উড়ে চলে গেলো অন্তহীন নীল আকাশে।
পাখির মা আসলে তা’র সন্তানের মুক্তির উপায় বলে দিয়েছিলেন সওদাগরকে। সে বুঝতে পারেনি। তবে গানের পাখি ঠিক বুঝতে পেরেছিল।
আশীষ বাবলু, ashisbablu13@yahoo.com.au
|