হুমায়ুন ফরীদির সাথে কয়েক ঘণ্টা আড্ডার স্মৃতি
আশীষ বাবলু
এখন চলছে হাওয়া পরে এসে আগে চলে যাওয়া।
(পুরানো লেখা খুঁজতে গিয়ে এই লেখাটি আবিষ্কার করেছি। হুমায়ুন ফরীদির সাথে কেটে যাও কয়েক ঘণ্টার স্মৃতি এই লেখাটি। লেখাটি এর আগে ছাপা হয়নি। হুমায়ুন ফরীদি বেশ কয়েক বছর আগে সিডনি এসেছিলেন সাথে সুবর্ণা মোস্তাফা, ওরা উঠেছিলেন মঞ্জুভাই, রেহানা ভাবির বাসায়। লেখাটি যে সময় লিখেছিলাম তখন হুমায়ুন ফরীদি আমাদের ছেড়ে চলে যাননি। নতুন করে লিখে সেই শোকের প্রসঙ্গ আর টেনে আনলাম না। সেই সময়কার উজ্জ্বল অনুভূতি যাতে অটুট থাকে সেই কারণে কোন কাটা ছেড়া না করে লেখাটি পাঠকদের কাছে হুবহু তুলে ধরলাম।) হুমায়ুন ফরীদির সাথে মুখোমুখি বসেছিলাম মঞ্জুভাই, রেহানা ভাবির ম্যাকুয়ারি ফিল্ডের বাসায়। সময়টা সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত। পরিষ্কার আকাশে বড় সাইজের একটা চাঁদ। চাঁদনী রাত বলা চলে। আমি, ফরীদি, এবং আমার স্ত্রী শম্পা বসে আছি ঘরের বাইরে একটা বেঞ্চিতে। সুবর্না আমাদের সাথে পাকাপাকি ভাবে বসছেন না। একটু পায়চারি, একটু দাড়িয়ে, মাঝে মাঝে সুচিত্রা সেনের মত ঘাড় বাঁকিয়ে টুকটাক কথা বলছেন। মঞ্জুভাই কাবাব বানাচ্ছেন। জানলা দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে, তিনি ঘামছেন। ভাল কাবাব বানাতে হলে ঘামতে হয়। কারণ কাবাব হতে হবে নরম তুলতুলে, মাংস কাঁচা থাকা চলবেনা, আবার পুড়ে গেলেও বিপদ। তাই আগুনের দিকে চোখ রাখা জরুরি। রেহানা ভাবি আমাদের পাশে কাঠের টেবিলে রাখা প্লেটে টুপ টাপ করে সদ্য ফোটা ফুলের মত কাবাব রেখে যাচ্ছেন। হুমায়ুন ফরীদি এবং আমার হাতে গেলাস। গেলাসে হুইস্কি। তা‘র হাবভাব গম্ভীর। মেপে মেপে কথা বলছেন । ‘হ্যাঁ, সিনেমা করছি পয়সার জন্য। মঞ্চ আর টিভির নাটকের টাকায় তো সংসার চলে না’। জিজ্ঞেস করলাম, সারাদিন কি করলেন? ফরীদি বললেন, ‘মোস্তাফা ভাই একটু সিডনি ঘুড়িয়ে দেখালেন, সমুদ্র দেখলাম। কারো বাসায় যাবার কথা ছিল, মুড হলনা, তাই সোজা চলে এলাম এখানে’। এবার সুবর্ণা মুখ খুললেন, ‘তুমি ব্যাপারটা ঠিক করনি, তোমার ভদ্রলোকের বাসায় যাওয়া উচিত ছিল। তুমি বড় অসামাজিক’। এবার ফরীদি সুবর্ণার দিকে কঠিন মুখ করে তাকালেন, বললেন,‘আমি শুধু অসামাজিক নই, আমি সমাজ বিরোধী’। এই বলে ফরীদি হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলেন। সুবর্না কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নামালেন। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের ব্যক্তিত্ব সব সময় চোখে পড়ে। কি অসাধারণ দৃঢ়তার সাথে এরা মাথা নামায়। এরা যখন মাথা তোলে তখন অবধারিত প্রলয়। সুবর্না মোস্তফা তাদের একজন। হুইস্কির মজা হচ্ছে এটা পেটে পড়লে মানুষ বেশী সময় রাগ অথবা মিথ্যা গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারেনা। স্টার হুমায়ুন ফরীদি থেকে মানুষ হুমায়ুন ফরীদি দুই প্যাগের পর বেড়িয়ে এলেন। হঠাৎ করে শম্পাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ওয়াইফ সুবর্ণার অভিনয় আপনার কেমন লাগে ? শম্পার জবাব তৈরি ছিল মনে হলো, বললো, ‘সুচিত্রা সেনের চাইতে ভাল’। তখনই শব্দ করে ফরীদির প্রাণ খোলা হাসি। দু‘টো কাকাতুয়া সেই হাসির শব্দে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। ফরীদি বললেন,‘এত জোরে হাসা যাবেনা। পাখিদেরও ঘুমের দরকার’। রেহানা ভাবির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাদের বারান্দাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে’। রেহানা ভাবি বললেন, ‘এটা বারান্দা নয় ব্যাকইয়ার্ড’। ‘ওই একই কথা। প্রত্যেক দাম্পত্য জীবনে একটা বারান্দা থাকা খুবই দরকার। ঠিক বললাম না?’ ফরীদি এবার সুবর্ণার দিকে তাকালেন। সুবর্না বললেন, ‘কথাটা মন্দ বলনি, এই দাম্পত্য, বিবাহ প্রসঙ্গে আমার মায়ের একটা কথা খুব মনে আছে। বড় আপার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে, আপার কোন ছেলেই পছন্দ হচ্ছেনা। একদিন খাবার টেবিলে মা আপাকে বললেন, এই বিয়েটা আমাদের পছন্দে কর, পরের বিয়েটা নিজের পছন্দে করো’। আমরা সবাই হো হো করে হেসে ফেললাম। সুবর্ণাও আমাদের সাথে যোগ দিলেন। সেই ভুবন ভুলানো গালে টোল পড়া হাসি। আমি তখন সম্পূর্ণ ভাবে ফ্ল্যাশব্যাকে চলেগেছি। এই সেই সুবর্না মুস্তাফা, যার প্রেমে পাগল হয়ে আমি একদিন আমাদের টিভিটাকে চুমু খেয়েছিলাম। আজ সে এত কাছে। ভাগ্যের কি পরিহাস, আমার স্ত্রী পাশে বসে আছে। আমারতো হাত-পা বাঁধা। হায়! আমারতো শক্তি নাহি উড়িবার! ওগো চাঁদ, যদিনা মেটাবে সাধ, তবে কেন উঠোন ভাসালে? হুমায়ুন ফরীদি তখন দ্বিতীয় প্যাগ শেষ করে তিন নাম্বার ঢালছে। এখন তার অন্য রূপ। আমাকে বললেন, ‘বুঝলে আশীষ, বন্ধু হয় অনেক রকমের। একসাথে কাঁদবার বন্ধু, একসাথে হাটবার বন্ধু, একসাথে পালাবার বন্ধু, একসাথে মাল খাবার বন্ধু, এই মাল খাওয়া বন্ধু গুলোই আমার মনের কথা সবচাইতে বেশী জানে। তবে কিছু হারামি কিসিমের বন্ধুও আমার আছে। গত রাতে এমন একটাকে জুতাপেটা করেছি’। আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কখন ? কোথায় ? ‘ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নে’। আমরা সবাই আবার হেসে ফেললাম। ফরীদি বললেন, ‘আমার একজন প্রিয় অভিনেতা আছেন তোমাদের অস্ট্রেলিয়ায়’। ‘কে’ ? ‘রাসেল ক্রো, ‘বিউটিফুল মাইন্ড’ ছবিটিতে তা‘র অভিনয় ভোলা যায়না। কতবার যে দেখেছি, একে বলে অভিনয়’। ‘আপনিও কিন্তু একজন বড় মাপের অভিনেতা’। ‘তবে ইচ্ছা করে মন প্রাণ দিয়ে এমন অভিনয় করি। বছরে একটা ছবি। এতটাকা দেবে কে ? একটা ছবি করেতো আর সংসার চলবেনা’। ‘আপনার মত অভিনেতা বাংলায় খুব একটা বেশি আসেনি’। ‘মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। অভিনয় করা আর সময় কাটিয়ে যাওয়া এক কথা নয়। শুধু সময় কাটাচ্ছি। আমরা দেশে শুধু কোয়ান্টিটি বানিয়ে গেলাম, কোয়ালিটি কিছু করলাম না। আর মন খারাপ করিনা’। ‘মন খারাপ হলে আপনি কি করেন’ ? ‘মন খারাপ হলে সাধারণত মানুষ গান শোনে, আমি কিন্তু শুনিনা। আমি বই পড়ি’। ‘মন খারাপ হলে মানুষের বই পড়ার কথা আমি কিন্তু এর আগে শুনিনি’! ‘হ্যাঁ, এটা প্রাকটিস করে দেখবেন। মন খারাপ হলে আমি পড়ি রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। আমি গল্পের একেকটা চরিত্র ভাবতে থাকি এবং ধীরে ধীরে মন ভাল হয়ে যায়’। এবার গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক। ‘জীবনের প্রথম চুম্বন আর সেকেন্ড গ্লাস অফ হুইস্কির চাইতে মধুর আর কিছুই নেই’। তিনি সিগারেট ধরালেন। রেহানা ভাবি আরো কিছু কাবাব টেবিলে রাখলেন, বললেন, ‘এইসব ছাইভস্ম খাওয়া এখন বন্ধ করেন’। সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে ফরীদি বললেন, ‘জিনিসটাকে খুব খারাপ বলবে না, বদমাইশি না করে একটু মদ্যপান করা ভাল’। রেহানা ভাবি বললেন, ফরীদি ভাই আর একটু কাবাব খান। খালিপেটে এসব খাওয়া ঠিক না । কাঁচা মরিচ দেবো ? হুমায়ুন ফরীদি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এইযে কথাটা রেহানা বললো, এরমধ্যে লুকিয়ে আছে একটা কঠিন রহস্য। যাকে বলে ভালবাসা। এই জিনিসটাকে আমি বড় ভয় পাই। বেশি আকাঙ্ক্ষা, বেশি স্নেহ ভালবাসা পৃথিবীতে না পাওয়াই ভাল। শুধু শুধু কষ্ট দেয়। ভালবেসে সুখ মিটিল না এ জীবনে। জীবন এত ছোট কেনে?’ সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সুবর্না হাত ধরো, চলো তোমাকে আকাশ দেখাই’। সুবর্না লজ্জা পায়। আমি প্রসঙ্গ বদলাই। ‘সিডনি থেকে কিছু কিনেছেন ?’ ‘হ্যাঁ, একটা চেয়ার কিনেছি’। ‘সিডনি থেকে ঢাকায় চেয়ার নিয়ে যাবেন?’ ‘পছন্দ হলো, না কিনে পারলাম না’। পাশে দাঁড়ানো সুবর্না এবার মুখ খুলল, ‘ বাসায় পৌঁছাবার আগেই ট্রানস্পোর্টে ঐ চেয়ার ভাঙ্গবে। ওর অদ্ভুত সব বাজে খরচ ’ আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই বাজে খরচ দিয়েই একটা মানুষকে যথার্থ চেনা যায়। মানুষ ব্যয় করে বাঁধা নিয়মে, অপব্যয় করে নিজের খেয়ালে। ‘আর কিছু কিনেছেন ?’ ‘না, ভালবাসা ছাড়া আর কোনো লাগেজ রাখিনি সঙ্গে।’ ফরীদি খুবই সুন্দর মুডে চলে এসেছেন। কথা বলছেন না কবিতা পড়ছেন বোঝা যাচ্ছেনা। এই হচ্ছে বাংলাদেশের সবার প্রিয়, আশ্চর্য ক্ষমতা সম্পন্ন অভিনেতা, যে যেকোনো চরিত্রে মানুষকে মাতিয়ে তোলেন। নিজে না মাতলে কি অন্যকে মাতানো যায় ? এবার তার কথায় একটু আধ্যাত্মিকতা। ‘কি আছে জীবনে? সময়ের ব্যবধানে একে একে কবর খোঁড়া হবে। সাক্ষী মহাকাল লিখবে জীবনের কাহিনী’। আমরা সবাই চুপ। এমন সব ভাবগম্ভীর কথাবার্তা শোনার মুডে এই মুহূর্তে কেউ নেই। ফরীদি বুঝতে পেরেছেন। পরিবেশটা হাল্কা করার জন্য বললেন, ‘বেহেস্তে গিয়েও এমন একটা আড্ডা বসাবো। আমার অনেক বন্ধুরা যারা অনেক আগে চলে গেছে, শুনেছি তা‘রা সেখানে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে’। আমি বললাম ‘আমার জন্য একটা জায়গা রাখবেন।’ আবার হো হো করে ফরীদির দম ফাটানো হাসি। বললেন, ‘জায়গা রাখতে পারি তবে সেখানে আপনার আসা হবেনা’। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কেন’ ? ‘আমি যাবো বেহেশত, আর আপনি যাবেন স্বর্গে। স্বর্গ থেকে বেহেশত যাবেন কি করে?’ আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘সেখানে কি পাসপোর্ট ভিসার ব্যবস্থা আছে ?’ ফরীদি বললেন, ‘চলুন একটা কাজ করি। একটা ইস্যু পাওয়া গেছে। ভিসা-হীন বিশ্ব নামে একটা আন্দোলন ইদানীং চলছে। চলুন আমরা ভিসা-হীন বেহেশত নিয়ে একটা আন্দোলন করি।’ আমরা সবাই হেসে উঠলাম। সুবর্না বললেন, ‘ফরীদি তোমার মাথা খারাপ’। এই মানুষটি রাইফেল কাঁধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, বেলি ফুলের মালা পরিয়ে মিনুকে বিয়ে করে ছিলেন। মানুষটার মাথাতো সত্যি খারাপ !
ashisbablu13@yahoo.com.au
|