গুগল আর্থ আশীষ বাবলু (২য় অংশ) একটু হাঁটার পরই একটা চায়ের দোকান। আবছা মনে পড়ল এই দোকানটায় কয়েকদিন কাজ করেছিল গুড্ডু ভাইয়া। শারু এখন নিশ্চিত ও ঠিক জায়গায় চলে এসেছে। আর একটু এগোতেই দেখতে পেল প্রাচীর ঘেরা একটা ছোট্ট বাগান আর বাগানের মাঝখানে একটা ফোয়ারা। ফোয়ারাটা এত ছোট ? পাঁচ বছর বয়সে অনেক ছোট জিনিসও বড় দেখায়।
ফোয়ারার পাশে যে রাস্তাটা এই পথটা দিয়েই এগোতে হবে। আর কয়েক পা রাস্তা মাত্র বাকি। মনে হচ্ছিল হোবার্টের ব্লান্ডস্টোন এরিনা, স্কোরবোর্ডে নিরানব্বই রান। গ্যালারিতে উত্তেজিত দর্শক। শারু হাতে ব্যাট নিয়ে ক্রিজে দাড়িয়ে। যে কোন মুহূর্তে একটা হেস্ত নেস্ত হতে যাচ্ছে। ও একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে ও পা বাড়াল।
মিনিট দুই হাঁটার পরই ও এসে দাঁড়ায় একটা বাড়ির সামনে। লাল ইট পাতা উঠোন। পাশের নারকেল গাছ থেকে একটা পাখি ডানা ঝাপটিয়ে নিখিল শূন্যের দিকে উড়ে গেল শারুকে একলা ফেলে। শারুর সামনে ভাঙ্গা টালির ছাদ ওয়ালা একটা ঘর। ঘরে ঢোকার দরজাটা এত ছোট যে ওকে হাঁটু ভেঙ্গে ঢুকতে হবে। ও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ঘরের পাশে উঁচু জায়গাটা। ওর মা এখানে বসে রুটি বানাতো আর ওরা চার ভাই বোন গোল করে বসে থাকতো । গরমের সময় ঘুমাত এই উঠোনে। ওর মা আকাশের তারা দেখিয়ে ওদের গল্প শুনাতো।
হঠাৎ শারু লক্ষ করল দরজায় শেকল বাঁধা একটা তালা ঝুলছে। তবেকি ওরা এখানে নেই ? কোথা থেকে একজন মহিলা একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে সেখানে হাজির। শারু পকেট থেকে ওর একটা পাঁচ বছরের ছবি মহিলাকে দেখালো যা ওর অস্ট্রেলিয়ান মা বাবা তুলেছিলেন। ও ওর ভাই বোনদের নাম ওর মায়ের নাম ফাটিমা বেগম জানালো। ভদ্রমহিলা ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শারু চেষ্টা করছে মহিলার মনের কথা উদ্ধার করতে। কিছু কিছু চেহারা আছে ভাবলেশহীন। শারু ভদ্রমহিলার চেহারায় কোন উত্তর খুঁজে পেলনা। তবে কি ওর মাবাবা ভাই বোন কেউ বেঁচে নেই ?
ততক্ষণে শারুর আশে পাশে অনেক লোক জড় হয়ে গেছে। শারু ওর ছোট বেলার ছবিটা সবাইকে দেখিয়ে চিৎকার করে বলছিল - তোমরাকি চেন ? গুড্ডু, কুল্লা, শাকিলাকে ? আমি ওদের ভাই, আমার মায়ের নাম ফাটিমা।
সেই ভিড়ের থেকে একজন মাঝ বয়সী লোক এগিয়ে এলেন। শারুর হাত থেকে ছবিখানা ছোঁ করে তুলে নিয়ে বললেন, এক মিনিট , তারপর দ্রুত পায়ে অদৃশ্য হলেন।
শারুর জীবনের দীর্ঘতম সাত মিনিট কাটবার পর ভদ্রলোক ফিরে এলেন। শারুর হাত ধরে বললেন, চল আমার সাথে। ও অন্ধের মতে হাটতে লাগল ভদ্রলোকের পেছনে। শারুর পরনে জিনস,টি শার্ট আর ব্যাক-প্যাক। ওর পেছনে সমান তালে পা মিলাচ্ছে বারো থেকে বাহাত্তর বয়সের তিরিশ জন নর নারী। বেশ কিছু সময় একই গতিতে মার্চ করার পর দলটি একটি জায়গায় এসে থামল। ভদ্রলোক থামলেন, একটা কোনায় আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, ঐযে তোমার মা।
শারু তাকিয়ে দেখে যে তিনজন মহিলা দাড়িয়ে আছেন। তিন জনের মাঝখানের মহিলাকে হালকা ভাবে মনে হচ্ছিল মুখখানা পরিচিত। ভদ্রলোক মাঝখানের মহিলাকে ইশারা করে বললেন, উনি হচ্ছে তোমার মা।
শারুর মনে আছে ওর মায়ের বয়স তখন ছিল ত্রিশ বছরের মত । এখন প্রায় বৃদ্ধা। সমস্ত শরীরে জীবন যুদ্ধের রুক্ষ মাটি। সেই মাটির আড়ালে লুকিয়ে আছে নির্ভুল এক মমতাময়ী নারী।
হ্যাঁ মা, আমার মা।
শারু ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তার মাকে। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। উচ্ছ্বাসে আবেগে দুইজনই কাঁদছে আর কথা বলে যাচ্ছে। অথচ সময় বড় বিশ্বাসঘাতক। দুজনে কেউ কারো কথা বুঝতে পারছেনা। তবে কান্নার কোন অনুবাদের প্রয়োজন নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে খবর পৌঁছে গেল সমস্ত গ্রামে। ছুটে এলো একমাত্র বোন শাকিলা তার শিশু সন্তান নিয়ে। মোটর সাইকেলে ছুটতে ছুটতে এলো ভাই কাল্লু। আরেক জনের অপেক্ষা করছিল শারু। সে হচ্ছে ওর গুড্ডু ভাইয়া। গুড্ডু ভাইয়া কোথায় ? কারো মুখে কথা নেই। সবার মুখ থমথমে। কোথায় গুড্ডু ভাইয়া ? সে বেঁচে নেই, সে মারা গেছে ট্রেনে চাপা পড়ে। শারুকে হারাবার পর ও শুধু ট্রেনের লাইনে লাইনে খুঁজে বেড়াতো ছোট ভাইকে। *
(সারো ব্রায়ারলীর জীবন কাহিনী ‘লংগেষ্ট জার্নি হোম’ বই আকারে বের হবার অপেক্ষায়। গল্পের কপিরাই্ট অস্ট্রেলিয়া এন্ড ইউ কে প্রডাকশন কোম্পানি কিনে নিয়েছে সিনেমা বানাবার জন্য। এই কোম্পানিই বানিয়েছিল ‘দি কিংস্ স্পিচ্’। আমরা অচিরেই শারুকে রূপালী পর্দায় দেখতে পাব)।
< ১ম অংশে ফিরে যাবার জন্য এখানে ক্লিক করুন
|