বকা খাবে কিন্তু আশীষ বাবলু
আমার পাশের বাড়ীতে একজন বৃদ্ধা তা‘র নাতনিকে নিয়ে থাকেন। নাতনিটির বয়স বড়জোর কুড়ি একুশ হবে। তা‘র আবার একটা বাচ্চাও আছে। আমি মাঝে মধ্যেই দেখি একটা সবুজ গাড়ী থামে ওদের ড্র্ইাভওয়েতে। গাড়ী থেকে নাতনিটি তাড়াহুড়ো করে নামে। পেছনের সিট থেকে একটা ৩/৪ বছরের বাচ্চা ছেলেকে টেনে নামায়। বাচ্চাটি একটা আইপ্যাড বগলে নিয় মায়ের পেছন পেছন গুটি গুটি পায়ে বাড়ীর ভেতর চলে যায়।
এই দৃশ্যটি আমাকে প্রতি সপ্তাহে দুই তিন বার দেখতে হয়। মেয়েটি ভুলেও আমার দিকে তাকায় বলে মনে হয়না। এই ডোন্ট কেয়ার এ্যাটিচিউড আমার একদমই পছন্দ নয়। অথচ ওর ঠাকুমা যখন ড্রাইভওয়েতে পরে থাকা শুকনো পাতা ঝাড় দেন অথবা লেটার বক্সের জাঙ্কমেল পরিষ্কার করেন তখন আমার দিকে চোখ পড়লেই মিষ্টি হেসে হ্যালো হাউ আর ইউ বলবেনই। এতটুকু ভদ্রতা প্রতিবেশীর কাছে আশা করা যেতেই পারে। অথচ মেয়েটির হাবভাব এমন যে পৃথিবীতে আমি কিছু দেখতে আসিনি, দেখাতে এসেছি। তবে বলতে দ্বিধা নেই সে যখন গাড়ী থেকে নামে আমি আমার লনের আগাছা পরিষ্কারে যতই ব্যস্ত থাকিনা কেন একবার তা‘র দিকে চোখটা আমার চলেই যায়। বাদামী এলোমেলো চুল, টান টান শরীরে জিনস টি-শার্ট, তার উপরে বোনাস ভারী নিতম্ব। চোখের দোষ দিয়ে লাভ নেই !
যাই হোক এভাবেই দিন কাটছিল। একদিন সন্ধ্যা বেলা আমার দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি দরজা খুলে হতবাক। দেখি বাচ্চা ছেলেটিকে সাথে নিয়ে মেয়েটি দাঁড়িয়ে। এই প্রথম তা‘কে সোজাসুজি দেখলাম। দিনের শেষ সূর্যের আলো পরেছে মুখে। এতদিন লুকিয়ে মেয়েটিকে যা দেখেছি সে দেখতে তার চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী। শরীরে তেল তেলে লাবণ্য। মুখখানায় রোদ-লাগা লালচে আভা। অনন্তের ছোঁয়া লাগা নীল চোখ। আর আছে মুচকি হাসার রোগ। সব মিলিয়ে সোফিয়া লোরেন।
কোন ভণিতা না করে সোজাসুজি আমাকে বললো, হাই, আমার নাম ইসাবেলা। তুমি আমাকে দেখেছো। ক্যান ইউ ডু মি এ ফেবার? মেয়েটি যে এমন মোলায়েম সুরে কথা বলতে পারে সেই ধারনা আমার ছিলনা। ফেবারটা হচ্ছে তার ছেলে জ্যাককে ঘণ্টা দুয়েক বেবিসিটিং করা।
এমনিতেই সহজে ‘না’ আমি বলতে পারিনা। তার উপর এমন সুন্দরী একটি মেয়ে। সোফিয়া লোরেনকে ‘না’ বলার মতো বুকের পাটা কোন বাঙ্গালী পুরুষের আছে !
সেই থেকে শুরু। কিছুদিন পরপরই বাচ্চাটা মানে জ্যাককে আমার কাছে রেখে যেতো। ওর ঠাকুমা প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকে। আর জ্যাক খুবই দুরন্ত। ওকে সামলানো সুস্থ মানুষের পক্ষেও সহজ নয়। তবে আমার ভালই লাগতো। আমার চাইতেও ভাল লাগতো জ্যাকের। কেননা সে আমার এখানে বাধাহীন যা খুশি তাই করতো। তার ফেবারেট খেলা ছিল সোফার উপর লাফানো আর দেয়ালে লাথি মারা। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, তোমার এই দুষ্টুমি আমি সহ্য করবো তবে বিনিময়ে আমাকেও তোমার কিছু দিতে হবে। সেটা হলো বাংলা। আমি জ্যাকের সাথে শুধু বাংলায় কথা বলতাম। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও পরে দেখতাম ও আমার কথাবার্তা কিছুটা বোঝে তবে বলতে পারেনা।
জ্যাক ও ইসাবেলার সাথে আমার একটা সুন্দর সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। ও মাঝে মধ্যে আমার ঘরে আসে। কফি খেতে খেতে জীবনের সুখ দুঃখের গল্প বলে। ওর বাবা মা ওকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আশ্রয় নিয়েছে এই বৃদ্ধা গ্রান্ডমার কাছে। ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করে। পার্টটাইম একটা চাকুরী করছে এবং মানুষ করছে ছেলে জ্যাককে। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ছেলের বাবাকেতো কখনো দেখিনা, সে কোথায়? ইসাবেলা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, আমি জানিনা। আমি বললাম, তোমাদের বিয়ে হয়েছিল? ও মুখ নামিয়ে বললো, ‘না’। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, জ্যাকের বাবা কি সিডনিতে থাকে ? ও এবার কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো, থাকতেও পারে, মে বি। আমি আশ্চর্য হই, মানে ?
তারপর ইসাবেল আমাকে যা বললো তার সংক্ষেপ হচ্ছে, হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর বন্ধুরা দল মিলে ছুটি কাটাতে গিয়েছিল ব্রিজবেন, গোল্ড-কোস্ট। সেখানেই কনসিভ্ করেছিল জ্যাককে। সেখানে তিনজন বন্ধুর সাথে সম্পর্ক হয়। এই তিনজনের একজন জ্যাকের বাবা। সত্যিকার অর্থে কে বাবা সে বলতে পারবেনা। আমি বলি, তুমি কি কখনো জানার চেষ্টা করনি ? শূন্য কফির কাপটা নাড়াচাড়া করতে করতে ও বললো, কী লাভ হবে। হঠাৎ করে বাচ্চাটাকে ওদের কারো ঘাড়ে চাপানো কী ঠিক হবে ? ওদের তো কোন দোষ নেই। আমারই সাবধান হওয়া উচিত ছিল। একটা সমাধান ছিল এ্যাবরশন, কিন্তু সেটা আমি চাইনি।
জীবনের এমন একটা অন্ধকার অধ্যায়কে এমন সহজ করে বলতে পারে কেউ ? মেয়েটিকে কী ঘৃণা করবো? যে মানুষ ভুল করে প্রায়শ্চিত্ত করে তাকে কী ঘৃণা করা যায় ? আমার বরং ইসাবেলাকে আরো ভালো লাগতে শুরু করলো।
তারপর এলো সেই দিনটি, যেদিন ইসাবেলা আমার অফিসে ফোন করে জানাল ওর ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট বেড় হয়েছে। পাস করেছে, এবং আজকে সন্ধ্যায় ও ডিনার খাওয়াবে।
একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে আমরা হাজির হলাম। আমি, ইসাবেলা, জ্যাক ও গ্রান্ডমা লিলিয়ান। সবাই আমরা সেজেগুজে এসেছি। আজকে ইসাবেলা জিনস-টিশার্ট পরে আসেনি। টিউলিপ ছাপ একটা ড্রেস, আকাশী । খোলা চুল । একদম আসমানি পরী। সবচাইতে সেজে এসেছেন গ্রান্ডমা লিলিয়ান। লাল-টুকটুকে লিপস্টিক। হলুদ ড্রেসের গলা থেকে নেমে এসেছে ঝক্মকে পাথরের নেকলেস। এদেশে বয়স্ক মহিলাদের সাজগোজ দেখতে আমার খুব ভাললাগে। জীবনকে এত সহজে ফুরিয়ে যেতে দিতে এরা নারাজ।
ইসাবেলা গ্রান্ডমাকে জড়িয়ে ধরে থ্যাংকইউ বললো। তোমার আশ্রয় না পেলে আমার সব স্বপ্ন ভেস্তে যেতো। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে মাঝারি সাইজের একটা চুম্বন। থ্যাংকইউ। আমি যদিও ঘোড়ার ডিম তেমন কিছু করিনি। তবুও একটা লোভনীয় পুরস্কার পেলাম, মন্দকী ! তারপর হঠাৎ কথা বলতে বলতে ইসাবেলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ওর বুকের ভেতর এতবড় একটা চ্যালেঞ্জ জমে ছিল দীর্ঘদিন, আজ সেটা কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো। এ কান্না সহজে থামার কথা নয়। আমার ডান পাশে বসা ছোট্ট জ্যাক এবার মুখ খুললো। ‘ডোন্ট ক্রাই মম, বকা খাবে কিন্তু’।
ওরে বাবা ! জ্যাক দেখছি বাংলা বলছে!
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|