ফেয়ার এন্ড লাভলী আশীষ বাবলু
আগে সুচিত্রা সেন উত্তম কুমার স্টার ছিলেন। এখনতো এমন দিন কাল পড়েছে যে আমরা সবাই স্টার। চুলে বেশি করে জেল লাগিয়ে, লাল রঙ্গের টাই পরে, হাতে একটা সবুজ তরমুজ নিয়ে একটা ছবি তুলুন। এবার ছবিটা ফেসবুকে দিয়ে দিন। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে একশ লাইক আপনি পেয়ে যাবেন। আমাদের ফরিদপুরের সুলেমান যে সব সময় কুচকি চুলকাত গত হপ্তায় তার ফেসবুকে দুহাতে দুটো লাউ নিয়ে ছবি দিয়েছে তাতে এক হাজার লাইক আর শ‘খানেক কমেন্ট। কত রকম প্রশ্ন! একজন প্রশ্ন করেছেন লাউটা বুড়ো না কচি? বিচি আছে কিনা?
মানুষতো দেখেই শেখে। আমার গাছে দুটো নাদুস নুদুস কড়লা হয়েছিল। আমারও সুলেমানের মত একটা ইচ্ছা জাগলো। আজকাল-তো দারুণ ব্যাপার। ছবি তুলতে ক্যামেরা লাগেনা, ক্যামেরাম্যানও লাগেনা। মোবাইল থাকলেই হলো। কড়লা সহ একটা সেল্ফি তুলে দিলাম ফেসবুকে পোস্ট করে। একটু পরেই স্ত্রী ছুটে এলো, করেছ কি? কি করেছি? মাংকি ক্যাপ পরে ছবি পোস্ট করেছ! বললাম তাতে কি হয়েছে? সাবজেক্টতো আমি নই, কড়লা! আরে ঐ মাংকি ক্যাপ পরে তোমাকে যে আরো বুড়ো লাগে!
বুঝলেন-তো। বাজারের পালিশ করা বেগুনের মত নিজেকে মসৃণ চকচকে রাখতে হবে। ভেতরটা পোকায় খাওয়া হোক, বিচিতে ভরা হোক তাতে অসুবিধা নেই, ঝকঝকে হতে হবে। ফেসবুকের জগতে তা‘নাহলে স্টার থাকা যাবেনা।
আয়নায় দাড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কোন পুরুষ নিজেকে দেখে বলে আমার মনে হয়না। হ্যাঁ সেটা দেখেছি তের-চৌদ্দ বছর বয়সে। গোঁফের রেখাটা কতটা কালো হল! সেটাতো অনেক অনেক বছর আগের কথা। কিন্তু মেয়েরা কপালে টিপ পরছে অথচ দেখছে চোখের আই-লাইনার ঠিক আছে কিনা। ঠোটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে অথচ দেখছে নাকের পাটায় পাউডার লেগে আছে কিনা। বেশ কয়েক বছর আগে এক পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছিল মহিলাদের সবচাইতে প্রিয় বস্তু হচ্ছে ভ্যানেটি ব্যাগের আয়না। ব্যাপারটা লুফে নিলো টেলিফোন কোম্পানি। তারা ফোনের সামনে জুড়ে দিল আরেকটি ক্যামেরা য়ে বস্তুটা দিয়ে আমরা এখন সেল্ফি তুলি এবং নিজেকে দেখতে পারি। জানলে আশ্চর্য হবেন এর পর থেকে মেয়ে মহলে পৃথিবী জুড়ে টেলিফোন বিক্রি তিন গুন বেড়ে গেছে।
চোখ ঈশ্বর পুরুষদেরও দিয়েছেন, মেয়েদেরও। আমরা পুরুষেরা চোখকে অর্ধেকও কাজে লাগাইনা। ঈশ্বরের দেয়া চোখের পয়সা উসুল করছে মেয়েরা। প্রশ্ন করবেন কি ভাবে? ধরুন আপনারা দুজনে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন। ফেরার পথে গাড়িতে বসে স্ত্রী যে কথাটা প্রথম বলবে সেটা হচ্ছে, এই দেখেছো? আপনি বলবেন, কি? আপনার স্ত্রী বলবে, ওরা নতুন সোফা কিনেছে। আপনি কিন্তু লক্ষ্য করেননি। স্ত্রীর ভৎসনা খাবার ভয়ে বলবেন, দেখেছি। এরপর স্ত্রী বলবে ওদের ডাইনিং টেবিলে ফুলদানী টা খুব সুন্দর তাইনা? ডাইনিং টেবিলে বসে কোন আহাম্মক খাবারের আইটেম না দেখে ফুলদানী দেখে! তবু আপনাকে বলতে হবে, হ্যাঁ আমি দেখেছি।
মোটকথা বেড়াতে গিয়ে আপনার স্ত্রী যা যা দেখেছেন আপনি তার অর্ধেক দেখেন নি। অথচ আপনাদের দুজনেরই দুটো করে চোখ!
সেই যে আয়নায় দাড়িয়ে নিজেকে দেখার কথা বলেছিলাম। মহিলারা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের শরীরের কোন ক্ষুত বেড় করবেই। নাকের ফুটো বড় তো কানের লতি ছোট। এইখানে মাংস বেশি তো ঐ খানে চর্বি বেশী। আর আয়নার থেকে চোখ সরিয়ে যে কথাটা বলবে সেটা হলো,- আগামী সপ্তাহ থেকে জিমে জয়েন করবো। সেই আগামী সপ্তাহ আগামী মাস হয়ে আগামী বছর কি আগামী মিলেনিয়াম ও হতে পারে! তবে এইটুকু গ্যারান্টি আমি দিতে পারি আপনার এই জনমে নিজের বাড়িতে কেরিনা কাপুর দেখার সৌভাগ্য হবেনা।
এইযে জিম, রূপচর্চা এসবের পেছনে একটাই কারণ সেটা হচ্ছে নিজেকে ইয়াং রাখা, নিজেকে বৃদ্ধ হতে না দেওয়া। আরে ভাই বৃদ্ধ কি শরীর দিয়ে হয়, এটা-তো মনের ব্যাপার। আমার বাবার বড় বোনকে আমি নিজের চোখে দেখেছি ভিক্ষুক ভিক্ষা নিয়ে তাকে বলতো, বেচে থাকো খুকুমণি! তখন তার ছেলে কলেজে পড়ে!
তবে বয়স বাড়লে একটু আলাদা ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায়। সমাজের মাথা আর সমাজের পাছার তো আর এক রকম ইজ্জত হতে পারেনা! সিনিয়র সিটিজেন বলে কথা! দেশে দেখেছি আমাদের প্রতিবেশী হরিপদ বাবু মাথার পাকা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলতেন, ‘বয়স আমার তোমাদের চাইতে একদিন হলেও বেশি, তাই আমার কথাটা শোন’। উনি বোঝাতে চাইছেন যেহেতু চুলে পাক ধরেছে তাই তার বুদ্ধিও পাকা। তিনি অভিজ্ঞ।
আমার মনে হয় বয়স আমাদের অভিজ্ঞতা দেয়না, দেয় অভ্যাস। আর সেই অভ্যাস বদ-অভ্যাসও হতে পারে। বোকা লোকদের বয়স বাড়লে চালাক হয়ে যায়না। বাচ্চা বয়সে আপনি যদি গোবর্ধন হন বয়স হলে আপনি মধুসূদন হবেন না। গোবর্ধনই থাকবেন।
তবে সত্যি কথাটা হচ্ছে এ্যাটম বোমা থেকে নিজেকে রক্ষা করা গেলেও বয়সের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। বৃদ্ধ বয়স কতটা জ্বালিয়ে মারে জানিনা, তবে যেটা ভীষণ ভাবে কষ্ট দেয় সেটা হচ্ছে ‘একাকীত্ব’। আমি একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার ভদ্রলোককে জানি। তার বাসায় যেয়ে লক্ষ করেছি তিনি রান্না ঘরের আশে পাশে ঘুরঘুর করেন আর স্ত্রীকে বলেন আমি কি আলুটা ছুলে দেবো? কারণটা আর কিছুই নয়, নিজেকে প্রয়োজনীয় রাখতে চান। যে ভদ্রলোক জীবনে এক গেলাস জল ভরে খাননি আজ তার আলুর চোকলা ছোলার জন্য কি আকুতি!
আমাদের বয়স বাড়ে অথচ অনেকেই স্বীকার করতে চাইনা বা বুঝতে পারিনা। আমি শুধু ষাট পার করেছেন এমন লোকদের কথা বলছিনা, মাত্র চল্লিশ পার করেছেন এমন বৃদ্ধও আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন। যারা বৃদ্ধ হয়েছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না, তাদের জন্য আমি একটা চেক লিস্ট তৈরি করেছি, কি করে বুঝবেন আপনার বয়স বাড়ছে?
আপনি সুযোগ পেলেই জ্ঞান বিতরণ করবেন। একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ধরুন আপনি পাচুগোপালকে কি ভাবে চিঠির খামে স্ট্যাম্প লাগাতে হয় তা বোঝাচ্ছেন। এনভেলপটা টেবিলের উপর রাখ, স্ট্যাম্পের উল্টো দিকে থুতু লাগাও, এবার ওটাকে ইনভেলপের ডানদিকে লাগাও, এবার স্ট্যাম্প শুদ্ধি ইনভেলপটাকে জোরে জোরে ঠাসো....।
কেউ আপনাকে বলছে যে খ্রীস্টমাসের ছুটিতে দেশে যাবো। আপনি জিজ্ঞেস করবেন কোন মাসে দেশে যাবে?
আপনি যখন হাত দিয়ে সিঙ্গারা খান তখন টুপ টুপ করে আলুর টুকরো মাটিতে পড়ে।
রাস্তা দিয়ে চলতে-আপনি ভাববেন দৌড়চ্ছেন, আসলে আপনি কিন্তু হাঁটছেন।
আশে পাশে যেখানেই আপনি যান না কেন প্রথমেই ভাববেন ছাতাটা সাথে করে নেব কিনা।
রান্না ঘর থেকে বাথরুমে এসে ভুলে যাবেন বাথরুমে কেন এসেছেন।
আপনাকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বিভিন্ন সময়ে উপহার হিসেবে দেবে - মোজা, মাফলার, ফটো-ফ্রেম, লাঠি, ছাতা। ওরা ভাবছে এ বয়সে এসবই আপনার একমাত্র প্রয়োজন।
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন সেদিন, যেদিন আপনি শপিং সেন্টারে যেখানে গাড়ি পার্ক করেছিলেন সেটা খুঁজে পাবেন।
রাত আটটায় আপনাকে কেউ ফোন করে বলবে, আপনাকে কি ঘুম থেকে জাগালাম? যখন ট্রাফিক পুলিশের বদলে ডাক্তার আপনাকে বলবে, স্লো-ডাউন।
আপনি স্যান্ডেলের সাথে মুজা পরা শুরু করেছেন।
আপনি কারো পায়ে পাড়া দিলে যার পায়ে পাড়া দিয়েছেন সেই লোকই আপনাকে ‘সরি’ বলবে।
এই চেক লিস্টের তিনটি ব্যাপারেও যদি আপনার মিল থেকে থাকে তবে “দিনতো গেল সন্ধ্যা হলো পার কর আমারে” - এই গান গাইবার সময় এসে গেছে। আমি এই লিস্টিটা আমার স্ত্রীকে দেখিয়ে ছিলাম। স্ত্রী মারমুখো হয়ে বললো, এই লিস্টি ফিস্টি আমার দরকার নেই। কতটা বুড়ো-ধারী হয়েছো না ভেবে আমি যা করছি তাই কর। হ্যাঁ আমি তাই করছি, দুপুরে মুখে আলু আর শসা ঘষছি। রাতে দুধের সর। আর বাইরে বেরোবার সময় ফেয়ার এন্ড লাভলী!
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|