রিকশাওয়ালার বৌ ও একটি চিঠি আশীষ বাবলু
রিকশাওয়ালা বলতে যে চেহারাটা আমাদের চোখের সামনে চলে আসে মুকুল দেখতে একদমই তেমনটি নয়। একমাথা কোঁকড়া চুল। ধবধবে গায়ের রং আর গ্রামের দিনগুলিতে কোদাল চালানো সুঠাম শরীর এখনো সার্টের তলায় উঁকি মারে। কথাবার্তা গোছানো। বাপের নাম জিজ্ঞেস করলে শুধু বাপের নামই বলে। কোন গ্রামের, কিভাবে রিকশা চালাতে শহরে এলো, লেখাপড়া কতদূর এসব জানতে হলে মুকুলকে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন করতে হয়। ও যে ক্লাস টেন অব্দি লেখাপড়া করেছে তা’ ওর কথাবার্তায়ই বোঝা যায়।
মিস্ ডেইজি তিনদিন ওর রিকশার সওয়ারী হয়েছিলেন এবং তৃতীয় দিনই ওকে এই চাকুরীর অফার দিয়েছেন। বিশাল কোন চাকুরী নয় তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পরে অপিসে যাওয়া, নিজের পার্সোনাল টেবিল চেয়ার, এটাতো মুকুল কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। বেতন রিকসার উপার্জনের চাইতে বেশি। এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট এর বড় ব্যবসা, সবমিলে ৩৫ জন কর্মচারী। তার চাইতে বড় কথা শনি-রবি ছুটি।
অবসর মানুষকে সৌখিন করে। একটা সিনেমা দেখা, কোন রেস্টুরেন্টে বসে চিনে মাটির কাপ-প্লেটে এক কাপ চা, সাথে মোগলাই পরটা, মনে হয় বেঁচে থাকাটা নেহাৎ মন্দ না! এমন সব অবসরে একটা মুখ হুট করে চোখের সামনে চলে আসে। সে হচ্ছে যুঁই। ওদের গ্রামের মা-বাপ মরা মেয়ে। চৌধুরীদের বাড়ীতেই মানুষ। মুকুল যখন চৌধুরীদের বাগান পরিষ্কার করতো যুঁই দূর থেকে তাকিয়ে থাকতো। একবার একটা ডাব কেটে মুকুলকে খেতে দিয়েছিল। মুকুল যেদিন গ্রাম ছেড়ে শহরে ভাগ্যের সন্ধানে যাত্রা করল, সেদিন গ্রামের সীমানা পেরোবার সময় শেষবার পেছনে তাকাতেই দেখেছিল যুঁই এর ফুল-ছাপ শাড়ির আচল। আকন্দ গাছের আড়ালে ওর ডাগর দুটি ছলছলে চোখ। কেন তাকিয়ে ছিল যুঁই? গ্রামের খোলা মাঠ দিয়ে মুকুল যখন হাটতো, মনে হতো আকাশ ওকে দেখছে। আকাশও কথা বলেনা, যুঁই ও কোন কথা বলেনি অথচ কি গভীর এই চেয়ে থাকা!
মিস্ ডেইজি একদিন বললেন, এক বছরতো হলো, চাকুরী কেমন লাগছে?
খুব ভাল ম্যাডাম, মুকুল মাথা নামিয়ে উত্তর দেয়।
গ্রামে যাওনা?
না, গ্রামেতো আমার কেউ নেই, বাড়ী ঘর ভিটে মাটি।
তোমার একটা সংসার স্টার্ট করা উচিত, একটা বিয়ে কর।
মিস্ ডেইজির কথা শুনে মুকুল হেসেছিল, তবে সেদিন থেকেই একটা বিয়ের পোঁকা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। তাইতো! একটা বিয়ে করলে জীবনটাকে দুজনে মিলে উপভোগ করা যাবে। একজন সাথী হলে মন্দ কী! এই বিয়ে প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে পরেছে যুঁই এর কথা।
দুই বছরের বেশী হতে চলেছে গ্রাম ছেড়েছে। যুঁই কোথায় কেমন আছে ও তো কিছুই জানে না। একবার গ্রামে গিয়ে দেখে এলে হয়, যুঁই তেমন সুন্দরী মেয়ে নয়, যা আছে একজোড়া সুন্দর চোখ। যে চোখের সামনে হাঁটু মুড়ে বসতে ইচ্ছে হয়।
বাপ-মা মরা মেয়েদের সহজে বিয়ে হয়না। গ্রামে যেদিন গিয়ে মুকুল পৌছাল সেদিনই নিজেই যুঁই এর মামাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। মামা মুকুলের বেশভূষা, শহরের চাকুরীর কথা শুনে রাজি হয়ে গেলেন। বিয়ের এক হপ্তার মধ্যে মুকুল বুঝতে পারলো যুঁই এর সুন্দর শুধু দুটি চোখ নয় তার চাইতে সুন্দর ওর মন।
শহরে যে বাসায় ও থাকত সে বাসাতেই উঠল নতুন বৌকে নিয়ে। জুঁই এর হাতের ছোঁয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই সব কিছু গেল পাল্টে। এতটুকু ঘরে যে এত সুন্দর করে সংসার গোছানো যায় মুকুল কোনদিন ভাবতেও পারেনি। যুঁইকে বিয়ে করে মুকুল খুবই খুশি। তবে একটা ব্যাপারে ও খুবই বিব্রত বোধ করে। যুঁই একদম লেখাপড়া জানেনা। আশ্চর্য হতে হয় যুঁই ওর নামটাও লিখতে পারেনা।
তোমার নামটা লেখাতো খুবই সোজা। মাত্র দুটি বর্ণ। য-য়ে রস্যুকার মাথায় একটা চন্দ্রবিন্দু আর -ই।
যুঁই ওর ডাগর চোখে মুকুলের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
থাক্ আমার আর লেখাপড়া শেখার দরকার নেই। তিন কাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে।
মুকুল ওর জন্য আদর্শলিপি কিনে আনে। যুঁই বইটা একটু নাড়াচাড়া করে মুকুলের গলা জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে মুখএনে ফিসফিস করে বলে আমার এসবের দরকার নেই, তারপর মুকুলের একটা হাত নিজের পেটের উপর রেখে হাসতে হাসতে বলে - যে আসছে তার জন্য বইটা তোলা থাক।
মুকুল মনে মনে ভাবে কিন্তু বলতে পারেনা, এই সন্তানের জন্যই তোমার লেখাপড়া শেখা দরকার। মনে আছে মুকুলের মা মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। বর্ণমালা ও ধারাপাত এই মা-ই ওকে শিখিয়েছেন। অভাবের সংসারেও ওকে পাঠশালায় পাঠিয়েছেন।
একদিন মুকুল যুঁই’র জন্য একটা রঙিন ছবি ভরা বাংলা সহজ পাঠ কিনে আনলো। বলতো যুঁই এটা কিসের ছবি?
আম।
এটা কিসের ছবি?
সাপ।
এটা শুধু সাপ নয় এটা অজগর!
যুঁই হাসতে হাসতে বলে, আমি গ্রামের মেয়ে আমাকে সাপ ব্যাঙ্গ শিখিওনা।
যুঁই বইখানা সোজা আলমারিতে তুলে রাখলো।
হায় যুঁই! মুকুল ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারেনা পড়তে লিখতে পারা জীবন চলার পথে খুবই প্রয়োজন। আর যুঁই ভাবে, সে ভাল স্বামী পেয়েছে, সংসার পেয়েছে, ঘর আলো করে সন্তান আসছে, তার লেখাপড়া করার প্রয়োজন কিসের! মুকুল হাল ছেড়ে দেয়, ভাবে আমার বউটি তবে মূর্খই থাকুক!
তারপর একদিন একটা ঘটনা ঘটল। কিছু কিছু ঘটনা আছে মানুষকে পাল্টে দেয়।
একদিন কলতলায় জামা কাপড় কাচতে বসেছে যুঁই। মুকুলকে রোজ পরিষ্কার কাপড় পরে অপিসে যেতে হয়। জলে ভেজাবার আগে পকেট গুলো ভালভাবে দেখে নেয় সে। প্রায় সময়ই পকেটে খুচরো পয়সা, কপাল ভাল থাকলে দুই একটা নোট পাওয়া যায়। সেদিন প্যান্টের বা- পকেটে হাত দিতেই একটা ভাজ করা কাগজ পায় সে। কাগজটার ভাজ খুলেই যুঁই বুঝতে পারে এটা একটা চিঠি। গোটা গোটা সুন্দর হাতের লেখা। তার চাইতে বড় কথা কাগজটার গায় সেন্ট মাখানো। মিষ্টি শিউলি ফুলের গন্ধ। এটা নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের চিঠি! কথাটা ভাবতেই যুঁইয়ের বুকটা ধরাস করে ওঠে। তবে কি মুকুল আমাকে ঠকাচ্ছে! আমাকে ফেলে অন্য কোন লেখাপড়া জানা মেয়ের সাথে চিঠি লেখালেখি করছে?
চিঠিটা চোখের সামনে তুলে ধরলো কিন্তু এক বর্ণও সে বুঝতে পারলো না।
কাকে দিয়ে পড়াবে স্বামীর কাছে লেখা অন্যকোন মেয়ের প্রেম পত্র! বড় অস্বস্তিকর ব্যাপার। বুক ফেটে যাচ্ছিল যুঁইয়ের। সে কলতলাতেই উদাস চোখে তাকিয়ে রইল ডাল ভাঙ্গা কামরাঙ্গা গাছটার দিকে। হ্যাঁ, ইদানীং মুকুল প্রায়ই দেরী করে অপিস থেকে ফেরে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে মুখে ক্রিম মাখে, গুন গুন করে হিন্দি গান গায়। এসব ভাবতেই বুকের ভেতর থেকে কান্নাটা এবার বাঁধভাঙ্গা বন্যার আকার নেয়, নিজেকে কোনরকমে সামলে কলতলা থেকে এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে বিছানার উপর মুখ গুজে কাঁদতে থাকে।
অনেকক্ষণ কেঁদেছিল যুঁই। কে বলে শুধু ভালবাসা মানুষকে কাছে টেনে রাখার জন্য যথেষ্ট! আচল দিয়ে চোখ মুছে মনে মনে ঠিক করল কিছুতেই মুকুলকে হারানো চলবে না এবং এই চিঠির কথা মুকুলকে জানাবে না।
পরদিন ড্রয়ার খুলে আদর্শলিপি বইখানি বের করল যুঁই। কে পড়াবে তাকে? নিচের তলায় বৃদ্ধ প্রেমেন কাকা প্রতিদিন চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়েন। তিনি স্কুল মাষ্টার ছিলেন।
‘কাকা আমাকে একটু পড়াবেন? আমার লেখাপড়া করার সাধ হয়েছে।’
প্রেমেন কাকা চশমা নাকের থেকে তুলতে তলতে হেসে বলেন, নিশ্চয়ই পড়াবো, কি পড়তে চাও তুমি?’
এরপর থেকে মুকুল অপিসে যাবার পরই যুঁই চলে যায় সোজা প্রেমেন কাকার কাছে। টানা এক ঘণ্টা অ আ ক খ। আনাজ কাটতে কাটতে, মাছ ভাজতে ভাজতে, পাশে রাখা বই থেকে পড়তে থাকে, গ ঘ ঙ চ ছ। কিছুদিন পর পরই ড্রয়ারে লুকানো চিঠিখানা খুলে দেখে সে। কিছু কিছু শব্দ সে চিনতে পারে, তবে কোন অর্থ উদ্ধার করতে পারেনা।
এরপর আকার, উকার, দীর্ঘিকার। তিন মাস কেটে গেল। এখন সে পড়ছে, জুলেখা বাদশার মেয়ে, তাহার খুব অহংকার। একদিন মুকুল যখন কাজে বেড় হলো ও ড্রয়ার খুলে চিঠিটা বেড় করলো। সেন্টের হাল্কা সুগন্ধ এখনো রয়েছে। খুবই সাবধানে চিঠিখানা খুললো যুঁই। ছাপানো আর হাতের লেখার পার্থক্য অনেক। তবে গোটা গোটা লেখা একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে তেমন অসুবিধা হচ্ছেনা।
ও যা ভেবেছিল তাই। চিঠিটা ওর স্বামীকে লেখা এবং একজন মহিলা লিখেছেন।
প্রিয় মুকুল
তোমার অবস্থার কথা ভেবে আমার খুবই কষ্ট হয়েছে। আমার এই চিঠি খানা তুমি প্যান্টের পকেটে রেখে দেবে। তোমার স্ত্রী যখন কাপড় ধোবে নিশ্চয়ই সে এই চিঠি দেখতে পাবে। হলুদ কাগজে সেন্ট মাখানো চিঠিটা দেখে ও সন্দেহ করবে এটা কোনো মেয়ের চিঠি। স্বামীকে লেখা অচেনা মেয়ের চিঠি পড়ার কৌতূহল কোন স্ত্রী দমন করতে পারবেনা। আর সে যদি তোমাকে ভালবেসে থাকে তবেতো কোন কথাই নেই! আশা করছি এই চিঠি তোমার বর্তমান সমস্যার সমাধান করতে পারবে। এদেশে বাংলা পড়তে লিখতে জানেনা এমন কোন মেয়ের মা হবার অধিকার থাকা উচিত নয়।
ভাল থেকো।
তোমার ডেইজি ম্যাডাম।
যুঁই দুইবার পড়লো চিঠিটা। রাগ হলো, অভিমান হলো, আবার একটা ভাললাগার অনুভূতিতে মনটা ভরে উঠলো।
মুকুল যখন অপিস থেকে বাসায় ফিরলো নিয়ম মত যুঁই এক কাপ চা ওর হাতে তুলে পাশে বসল। বুকের মধ্য থেকে সেই সুগন্ধি মাখা চিঠিখানা বেড় করে গড় গড় করে পড়তে লাগলো।
মুকুল হতবাক। মুকুলের চোখের তারায় এমন চিক চিক আলো, মুখে এমন আনন্দ যুঁই এর আগে কখনো দেখেনি। মুকুল দুই হাত বাড়িয়ে যুঁইকে বুকে চেপে ধরলো।
ভালবাসার জন্য মেয়েরা কি অসাধ্যই না সাধন করতে পারে!
আশীষ বাবলু, ashisbablu13@yahoo.com.au
|