bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












একজন সাংবাদিকের গল্প
আশীষ বাবলু



পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সরকারী খরচায় এসেছিলেন আটজন সাংবাদিক। সেটা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের কথা। বিশ্ব শ্রেষ্ঠ পাঞ্জাবী সেনা বাহিনী পরিস্থিতি আয়ত্তে এনে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তির যে ঝিলাম নদী বইয়ে দিয়েছে তা স্ব-চক্ষে দেখার জন্য। উদ্দেশ্য তা‘রা সারা পৃথিবীর মানুষদের পরিবেশন করবেন পূর্ব পাকিস্তানের যে শান্তির বাতাবরণ বইছে তার গল্প।

তা‘দের রাখা হয়েছিল ঢাকার আর্মি অফিসারদের মেসে। খানা-পিনার ঢালাও ব্যবস্থা ছিল। কোপ্তা কোর্মা থেকে শুরু করে বাঙ্গালদের ইলিশ ভাজা উইথ ইমপোর্টেড বিয়ার। মোট কথা জামাই আদার। দশদিনের প্যাকেজ টুরে আসা সাংবাদিকদের ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছিল ঢাকা শহর এবং আশে পাশের গ্রাম। টুর শেষে সবাইকে তুলে দেয়া হয়েছিল প্লেনে। বলা হয়েছিল এবার পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে যে যার খবরের কাগজে শান্তিপ্রিয় পাকিস্তানী সৈন্যদের বীর-গাঁথা রচনা করুন। লিখুন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মনের আনন্দে ডুগডুগি বাজিয়ে পাক সার জমিন সাদ বাদ-গাইছে!

সাংবাদিকরা তাই করেছিলেন। পাকিস্তান রক্ষাকর্তা সেনাবাহিনীর অসীম সাহসিকতার বর্ণনা তা‘রা লিখেছিলেন পাতার পর পাতা। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক ছিলেন যে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে রাতে ঘুমাতে পারতেন না। যখনই একটু চোখ লেগে আসতো তখনই দেখতেন দুঃস্বপ্ন। তিনি দেখতেন ইকবাল হলের ছাদে চারজন ছাত্রের গলাকাটা মাথা পরে আছে। তিনি দেখতেন পুরানো ঢাকার একটি ঘর যার দেয়াল বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে আছে। মেঝেতে রক্তের দাগ। স্থানীয় এক বৃদ্ধ তাড় কানে কানে বলছেন ‘আপনারা আসার আগে ২৩ জন নারী ও শিশুর মৃতদেহ সরিয়ে নেয়া হয়েছে।’ বুড়িগঙ্গার পাড়ে স্তূপ হয়ে থাকা মৃতদেহের মধ্যে এক মৃত মা তার এক বছরের মৃত সন্তানকে বুকে চেপে আকরে ধরে আছে। এসব দৃশ্য বারবার ঐ সাংবাদিকের চোখে দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসছে আর তিনি বিছানায় বসে দরদর করে ঘামছেন। স্ত্রী জেগে উঠে তা‘র পিঠে হাত রাখেন। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। এত-বড় একটা মানুষ এমন ভাবে শিশুর মত কাঁদতে দেখে স্ত্রী ইভন ভেবে পায়না কি করবে! স্ত্রীর হাত ধরে বলেন, যে করেই হোক আমাকে সত্য ঘটনা লিখতে হবে। যে সাংবাদিকের কথা আমি লিখছি তা‘র নাম হচ্ছে এ্যান্থনি মাসকারেনহাস।

১৮ই মে এ্যান্থনি হাজির হন লন্ডনের টাইমস পত্রিকার দফতরে। তিনি বললেন পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা নিজের চোখে দেখে এসে তিনি একটা প্রতিবেদন লিখেছেন। প্রতিবেদনটি পড়ে কর্তৃপক্ষ বলে হ্যাঁ আমরা ছাপাবো তবে এই লেখা ছাপা হবার পর পাকিস্তানে তোমার স্ত্রী সন্তানদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পরবে। তার কি হবে?
এ্যান্থনি ভাবলো এই মূহুর্তে স্ত্রী সন্তানেরা লন্ডনের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করবে। ঠিক হলো এ্যান্থনি ফিরে যাবে পাকিস্তান। ফেরার আগে সে একটা টেলিগ্রাম করলো স্ত্রী ইভানকে, এ্যানিস অপারেশন ওয়াজ সাকসেসফুল।

এ্যান্থনি পাকিস্তানে ফিরে যাবার পর স্ত্রী ইভান পাঁচ সন্তান নিয়ে রওয়ানা হলো লন্ডনের উদ্দেশ্যে। সাথে দুটো সুটকেস। পেছনে পড়ে রইলো করাচীর এতদিনের সাজানো সংসার এবং তা‘র প্রাণ-প্রিয় স্বামী। স্ত্রী সন্তানদের প্লেনে তুলে দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে এ্যান্থনি ভাবছেন এবার তাকে এ দেশ থেকে পালাতে হবে। কিন্তু সোজা পথে সে যেতে পারবেনা। সমস্যা হচ্ছে তখন পাকিস্তানে নিয়ম ছিল বছরে একবারের বেশি বিদেশে ভ্রমণ করা যাবে না।

তিনি নিজেকে নতুন করে সাজালেন। পরে নিলেন সালোয়ার কামিজ। দশ দিনের না কামানো দাড়ির সাথে দারুণ মানিয়ে গেলো সে সেই পোশাক। অবৈধ ভাবে প্রবেশ করলেন আফগানিস্তান। কাবুল থেকে প্লেনে চেপে বসলেন লন্ডনের উদ্দেশ্যে ।

প্লেনের জানলা দিয়ে দেখছিলেন কাবুলের আকাশের ছোট ছোট মেঘ আর তার কানে বাজছিল ঢাকার আর্মি মেসের ‘মারো এবং পোড়াও’ আর্মি ইউনিটের অফিসারদের কথোপকথন।
আজকে কি করলে?
দুটো গ্রাম জ্বালিয়েছি।
কত জন মারলে?
আঠারো জন।
মাত্র আঠারো জন! আমার ইউনিট মেরেছে ষাট জন। তোমার ডবলেরও বেশি।
প্রতি রাতে তাকে শুনতে হতো ধ্বংস আর হত্যার নিখুঁত বিবরণ। পাকিস্তানী আর্মি অফিসাররা বাঙ্গালী মেয়েদের স্তনের বর্ণনা দিতে দিতে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো।

এ্যান্থনির প্লেন কাবুল থেকে লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরের মাটি স্পর্শ করলো ১২ই জুন ১৯৭১। ১৩ই জুন সানডে টাইমস এ ছাপা হলো সেই প্রতিবেদন। বিশাল হেডলাইন। একটি মাত্র শব্দ। ‘জেনোসাইড’। হৈ চৈ পরে গেল পৃথিবী জুড়ে। পশ্চিমা বিশ্বে সব পত্রিকা সেই প্রতিবেদনের সূত্রধরে লিখলো আরও শয়ে শয়ে প্রতিবেদন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দলিল এটি। ইন্দিরা গান্ধী যখন বাংলাদেশের পক্ষে মত আদায়ের জন্য আমেরিকা ইউরোপ সফর করেছেন তিনি তা‘র হ্যান্ড-ব্যাগে রাখতেন সেই পেপার কাটিং। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রাখা আছে এ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সেই প্রতিবেদন।

তা‘র স্ত্রী ইভন মাসকারেনহাস এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, সে সময় লন্ডনে পাকিস্তানী বন্ধুরা আমাদের সাথে মেশা বন্ধ করে দিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার এত রেগে গিয়েছিল যে আমাদের পাকিস্তানী সিটিজেন-শিপ বাতিল করে দিয়েছিল। এদিকে ব্রিটিশ সরকারও আমদের ঠিক আপন করে নিচ্ছিল না। কেননা আমেরিকা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে, তাই গ্রেট ব্রিটেনও সে দিকেই ঝুঁকে ছিল। আমাদের বেশ কিছুদিন নাগরিকত্বহীন হয়ে খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে কাটাতে হয়েছে। তারপর ভারত সরকার বললো যেহেতু এ্যান্থনির জন্ম ভারতের গোয়ায়, হোকনা জন্ম ১৯৪৭ এর আগে তা‘কে এবং তা‘র পরিবারকে আমরা ভারতীয় নাগরিকত্ব দিলাম।

আমাদের স্কুলের একজন মাস্টার মশাই বলতেন, একগাদা লোকের সাথে ভুল পথে না হেঁটে একা হাঁটা ভাল। বাকী সাত জন সাংবাদিকের মত সত্যকে লুকীয়ে হাঁটতে চাননি এ্যান্থনি। তাই আজ মহাকাল লিখছে তা‘র জীবনের গল্প। ১৯৮৬ সালে মাত্র আটান্ন বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মানুষ চলে যায় কিন্তু তা‘র পূজা থেকে যায়। সেই প্রতিবেদনটি তিনি শুরু করেছিলেন এইভাবে...

আব্দুল বারির কপাল খারাপ!
ইষ্ট-পাকিস্তানের হাজার হাজার মানুষের মত এক ভয়াবহ ভুল সে করেছে। সে পাকিস্তানী সৈন্য দেখে দৌড় দিয়েছে।
আব্দুল বারির বয়স ২৪। পাতলা ছোট খাটো মানুষ। এই মুহূর্তে সে কৃমি রোগীর মত কাঁপছে। তা‘র চারিদিকে বেশ ক‘জন পাকিস্তানী সৈন্য মেশিন গান তাক করে ঘিরে আছে। বোঝা যাচ্ছে এখনই তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে।
কুমিল্লার ২০ মাইল দক্ষিণে মুজফফর গঞ্জের কাছাকাছি পাকিস্তানের নাইনথ্ ডিভিশনের জি-টু অপারেশনের মেজর রথোর আর আমি ঘটনার একটু দূরে দাড়িয়ে আছি। মেজর আমাকে বললেন, সাধারণত আমাদের সামনে কেউ দৌড় দিলে আমরা তা‘কে হত্যা করি। কিন্তু যেহেতু আপনি এখানে আপনার উপর সম্মান দেখিয়ে আমরা ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। আমি প্রশ্ন করলাম, ওকে কি কারণে হত্যা করা হবে?
কারণ পরিষ্কার। ও একজন হিন্দু হতে পারে। একজন মুক্তি হতে পারে। একজন আওয়ামী লীগার হতে পারে।..........

আব্দুল বারিকে দিয়েই তিনি রিপোর্ট শেষ করেছেন। বারিকে প্রমাণ দেখাবার জন্য লুঙ্গি খুলতে হয়েছিল। বারি ছিল একজন নিরীহ দর্জি। তবুও সৈন্যরা চাইছিল বারিকে মেরে ফেলা হোক। এ্যান্থনির বিনীত অনুরোধে বারির জীবন রক্ষা পেয়েছিল। এই প্রতিবেদন ছাপা হবার পর বারির প্যান্টই শুধু খোলা হয়নি সারা বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের প্যান্টও খোলা হয়েছিল। সেই দৃশ্য দেখে সারা দুনিয়া হয়েছিল হতবাক। মুক্তিযোদ্ধা এ্যান্থনি মাসকারেনহাস কে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।




আশীষ বাবলু, সিডনি,
ashisbablu13@yahoo.com.au





Share on Facebook               Home Page             Published on: 9-Apr-2019

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far