ঈদের গল্প আশীষ বাবলু
একটা সময় ছিল যখন সিডনিতে ঈদ আসতো আর দশটা সাধারণ দিনের মত। সেটা বহুদিন আগের কথা। ইদানীং ঈদ আসে অনেক আনন্দ নিয়ে। আপনি যদি কখনো সিডনির ল্যাকেম্বায় রোজার সময় যান তবে আপনার মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হবে। ইফতারির কয়েক ঘণ্টা আগে রাস্তায় বসে নানা রকম খাবারের দোকান। পেঁয়াজু, হালিম, বেগুনি, কাবাবের গন্ধ আপনাকে ঘাড় ধরে নিয়ে যাবে ঢাকার নবাবপুরের রাস্তায়। মনে হবে আব্বু বা চাচুর হাত ধরে ইফতারির আগে পিয়াজু কিনতে এসেছেন। ল্যাকেম্বার এই দোকানের হালিম ভাল তো ঐ দোকানের আলুর চপ। কোন দোকানে চানা টুকটুকে বাদামি, কোন দোকানের কালো। তবে দুটোই সমান সুস্বাদু। কোল বালিশের মত বেগুনির পাশে দিশেহারা আলুর চপ। লাল কাপড়ের স্কার্ট পড়ে হালিমের হাড়ি ধোঁয়া ছাড়ছে। তেলেভাজা গরম-গরম খেতে অমৃত তবে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে অম্বল, চুকা ঢেকুর সেটা খেয়াল রাখতে হবে। কাবাব তৈরি হচ্ছে নিভু নিভু কয়লার আগুনে। আঃ কী মারহাবা গন্ধ। ভাবাই যায়না আমি এখন দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে সিডনি শহরে আছি। মনে হচ্ছিল কোন ফিল্ম স্টুডিওতে দাড়িয়ে আছি। এখানে রোজার মাসের ঢাকা শহরের একটা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। লাইট, ক্যামেরা, সাউন্ড, এ্যাকশন। পিচ ঢালা এই পথটাকে ভালবেসেছি....গান বাজছে, নায়ক-রাজ রাজ্জাক নাচতে নাচতে এসে রাস্তার দোকান থেকে পেঁয়াজু কিনছেন! ল্যাকেম্বার প্রত্যেকটি বাংলাদেশী খাবারের দোকানদারদের আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনাদের কৃপায় পরবাসে থেকেও পরবাসী হতে হচ্ছেনা। অনেক পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ছেলেবেলাটা সেই কবে খুচরো পয়সার মতো হারিয়ে ফেলেছি, হিসেব রাখতো দূরে থাক টেরও পাইনি। কিন্তু এসব দেখলে কতকিছু মনে পড়ে যায়। যাইহোক, আমি বসে ছিলাম ল্যাকেম্বা ষ্টেশনের পাশের রাস্তার এক বেঞ্চিতে। ইফতারির সময় প্রায় হয়ে আসছে , দেখছিলাম ব্যস্ত পথচারীদের ছোটাছুটি। সবাই ঘরে ফিরতে চাইছে আপন জনের কাছে। হঠাৎ দেখি একজন মহিলা সুন্দর করে সেজে-গুজে নৃত্য পরিবেশন করছেন ফুটপাতে। বারবার যখন একই কায়দায় ঘুরছিলেন বুঝতে অসুবিধে হলোনা মহিলার মাথায় একটু সমস্যা আছে। তিনি একমনে তার নৃত্যের প্রদর্শন করে যাচ্ছেন কাউকে পরোয়া না করে। আমাদের হোলসওয়ার্দি স্টেশনেও একজন আছেন মাঝবয়সী মানুষ সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলেন। এরা কারো ক্ষতি করেনা। আমাদের মাঝে থেকেও তারা অন্য জগত-এর বাসিন্দা। এদের কারো কাছে কোনও নালিশ নেই। সংসারের কাছে কোন দাবি দেই। অতীত ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমাদের মত চাওয়া পাওয়া নেই। শুধু বর্তমান নিয়ে বেঁচে থাকা!
হঠাৎ আমার পেছনে কারো স্পর্শ অনুভব করলাম। মুখ ঘুরিয়ে দেখি একজন বৃদ্ধ। একমুখ দাড়ি। অযত্নে জট পাকানো চুল। মলিন শার্ট প্যান্ট। তার হাতে কাগজে মোড়ানো কয়েকটা খেজুর আর গোটা দুই পিয়াজু। তিনি আমার দিকে একটা খেজুর তুলে ধরলেন। আমি ইতস্তত করতেই তিনি হাতঘড়ির দিকে আঙ্গুল দিয়ে সময় দেখালেন। বুঝতে পারলাম ইফতারির সময় হয়ে গেছে। আমি একটা খেজুর তুলে নিলাম। তিনি আমারে দিকে একটা জলের বোতল এগিয়ে দিলেন। আমি সেই বোতল থেকে জল খেলাম। উনি চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বললেন এবং জল খেলেন। দুজনে একই সাথে খেজুর মুখে দিলাম। বৃদ্ধ তার মায়াবী চোখ দুটো বন্ধ করলেন। তার মুখে এক অনাবিল প্রশস্তি। আমাদের কোন কথা হলনা। উনি জানতে চাইলেন না আমি কোন দেশের, কোন জাতের, কোন ধর্মের। সে তার বুকের মধ্যে পুষে রাখা বিশ্বাসটুকু আমার সাথে ভাগ করে নিলেন। এধরনের কিছু মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই ধর্মের নামে যারা অধর্ম করছে তারা সুবিধা করতে পারছেনা।
রমজানের এই রোজার শেষে আসে খুশির ঈদ। আমাদের ছেলেবেলায় ঈদের আনন্দ ছিল একটু অন্য রকম। আমি সেই পাকিস্তানী আমলের কথা বলছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সুস্বাদু খাওয়া-দাওয়াতো আছেই আরেকটা আকর্ষণ ছিল ইভনিং-শোতে সিনেমা। কয়েক সপ্তাহ আগে টিকিট কিনে রাখতে হতো। তখন স্টুডেন্ট কনসেশনে হাফ দামে সিনেমার টিকিট পাওয়া যেত। আইয়ুব খান ছাত্রদের খুশী করার জন্য এই ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। নূতন উর্দু ছবি রিলিজ হতো। বাংলা ছবিও। জহির রায়হান ও আমজাদ হোসেন দুজনে মিলে বানাতেন ঈদের জন্য একটি স্পেশাল ছবি। ছবিটি এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে তৈরি করা হতো। নায়ক নায়িকা সুচন্দা-রাজ্জাক ছিল বাঁধা। আমরা চিত্রালী সিনেমা পত্রিকায় ছবি দেখতাম, একদিকে শুটিং চলছে তারই ফাঁকে আমজাদ হোসেন পরবর্তী দৃশ্যের ডায়লগ লিখছেন। সেসব ছবি আহামরি মনে রাখার মত কিছু হতোনা এটা ঠিক তবে ছবিতে কিছু সংলাপ আমাদের মুখে মুখে বহুদিন ফিরতো। তেমন একটি এখনো মনে আছে, বাল্যবন্ধু কি বিষয়?
আমাদের পুরানো ঢাকার সদর ঘাটের রাস্তায় বসতো জুয়ার আসর। কাঠের টুকরায় পেরেক লাগিয়ে তৈরি হতো রুলেট মেশিন। একটাকায় পাঁচ টাকা। পুলিশ এই বিশেষ দিনে এসব দেখেও দেখতোনা। একবার মনে আছে এমন একটি আসরে আমি আর বাল্যবন্ধু রঞ্জন দাড়িয়ে দেখছি। আমরা দুজনেই তখন হ্যাফপেন্ট। জুয়া না খেললেও জুয়া খেলা দেখতে কার না ভাল-লাগে! প্রত্যেকটি হেরে যাওয়া মানুষ ভাবছে ভাগ্য একবার ফিরবেই। হঠাৎ আমার পাশে দাঁড়ানো রঞ্জন একটাকা বাজি লাগিয়ে দিল। আমিতো হতবাক। তখন একটাকা অনেক টাকা। একটাকায় ফুচকা, ঝালমুড়ি, চটপটি, এবং কাসুন্দি লাগানো একটুকরা নারকেল পাওয়া যায়। রঞ্জনের কোন দিকে খেয়াল নেই। হাফপেন্টের পকেটে হাত দিয়ে পাক্কা জুয়ারি মত রুলেট মেশিনের দিকে তাকিয়ে আছে। পেরেকে লাগানো কাঠের কাটা চরকির মত ঘুরছে। টান টান উত্তেজনা। তারপর ধীরে ধীরে হেলে দুলে সেই কাটা এসে থামল সেই ঘরে যেখানে রঞ্জনের লাগানো টাকা খানা এতিমের মত পড়ে আছে। ওরে বাবা! রঞ্জন জিতেছে! কাল বিলম্ব না করে চেক লুঙ্গি আর ছেড়া গেঞ্জি পরা ক্যাসিনোর মালিক গুনে গুনে পাঁচ টাকা রঞ্জনের হাতে তুলে দিল ।
দুজনে ভিড় ঠেলে বিজয়ের আনন্দে বেরিয়ে এলাম। আমরা এখন ধনবান। শুধু ঈদ নয় এবার আমাদের বাম্পার ঈদ! রঞ্জনকে বললাম আমার কাছেও একটাকা আছে। এই বলে বুক পকেটে হাত দিলাম। দেখি টাকাটা নেই। প্যান্টের পকেটেও টাকাটা নেই। কোথায় গেল টাকা। রঞ্জনের মুখে মুচকি হাসি। ও আমার পকেট থেকে এক টাকা হাতিয়ে বাজিটা ধরেছিল!
আশীষ বাবলু, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, ashisbablu13@yahoo.com.au
|