দুর্গা পূজার স্মৃতি আশীষ বাবলু
সিডনিতে এবার শুনলাম ১৪ খানা দুর্গাপূজা হচ্ছে। আমরা খুবই ভাগ্যবান অস্ট্রেলিয়ার মত একটা দেশে বসবাস করি। খ্রিসমাস, ঈদ, পূজা এমনকি বুদ্ধ পূর্ণিমাও এখানে ধুমধাম করে পালিত হয়। এককালে রোমান ক্যালেন্ডারে বছরের ১০০দিন বাঁধা থাকতো না না রকম উৎসবে। এত উৎসবে মেতে থাকলে রোমানরা কাজ কর্ম করেছে কখন? নিশ্চয়ই করেছে তানা হলে পৃথিবীর বুকে সভ্যতার এত-বড় একটা মোটা দাগ ওরা কি করে রেখে গেছে। উৎসব-পরব হচ্ছে বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
এই দুর্গা পূজা হয় শরৎ কালে। বাংলার গাঁয়ের খবর যারা রাখেন তারাই জানেন এই ঋতুটি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সব চাইতে সু-সময়। কৃষকের মুখে তখন থাকে হাসি। আমরা জানি মা-দুর্গা ফেমাস হয়েছেন মহিষাসুর (দুষ্ট লোক) বধ করে। যেখানে বধ করেছিলেন সেটা হচ্ছে চামুণ্ডা পাহাড়ে। সে স্থানটি হচ্ছে মাইসোর, ভারতের কর্ণাটকে। অথচ এই পূজা কোথায়ও এমন জাঁকজমক ভাবে পালিত হয়না এই বাংলার মত করে। এই রহস্যের উত্তর হয়ত পণ্ডিতদের কাছে আছে, তবে আশ্চর্য হতে হয় এই দুর্গা পূজা শুধু প্রিয় নয়, একদম মিশে গেছে বাংলার মাটিতে। আমাদের বাউলেরা গান ধরেছে, - ওই দেখ মা দুর্গা দেবী সিংহবাহিনী / গণেশেরে কোলৎ কইরা আইছে জননী।
মা-দুর্গা একা আসেন না। চার সন্তান নিয়ে আসেন। তার প্রত্যেকটি সন্তানের রয়েছে আলাদা পোর্টফলিও। লক্ষ্মী টাকাপয়সার, সরস্বতী বিদ্যা, কার্তিক বীরত্বের, গণেশ সাফল্য,ব্যবসাপাতি। সাথে রয়েছে পেঁচা, ইঁদুর, ময়ূর, রাজহাঁস, সিংহ। যাকে আমারা বলি ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স। আরেক জন উল্লেখ করার মত হচ্ছেন,কলা বৌ। গণেশের পাশে তিনি দাড়িয়ে থাকেন লাল পাড় তাতের শাড়ি পরে। কলা গাছকেই শাড়ি পরানো হয়। তাকে সাজানো হয় বাংলার আনাজপাতি দিয়ে। কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান, ধান এই নয়টি গহনা দিয়ে। একে বলা হয় নবপত্রিকা। কথায় আছে প্রিয়জনেরে যা দিতে পারি, তাহা দেই দেবতারে।
ছোট বয়সে প্রতিমা দেখার আনন্দ ছিল সবচাইতে বেশি। আর ফেবারেট ছিল অসুর। উনি থাকতেন বাচ্চাদের আই লেভেলে। একটা বাজে লোক, মানে গুণ্ডা বদমাশ হলে কি হবে, দারুণ ফিগার, টেরেফিক ডাঁট। মৃৎশিল্পীরা নানা ভঙ্গিমায় প্রতি বছর অসুর তৈরি করতেন। মা-দুর্গার ত্রিশূলের খোঁচা খেয়েও মুখে হাসি! বড় হয়ে আজ বুঝতে পারছি একটা অসুর পোষ মানাতে পারলে দেশে এখনও একটু শান্তিতে থাকা যায়!
একটা কথা বললে ভুল হবেনা মা-দুর্গা একটা অসুর ঠিকই বধ করেছেন সেটা হচ্ছে গোঁড়ামি। একটা কাণ্ড অলক্ষ্যে ঘটেছে সেটা হচ্ছে সাংস্কৃতিক মিলন। শারদ সাহিত্য, শারদ সঙ্গীতের সমাহার বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। দুর্গা, শুধু পূজা হয়েই থাকেনি, হয়েছে উৎসব। রবীন্দ্রনাথ বার বার বলেছেন, সকলে যোগ দিতে না পারলে, আর যাই হোক তাকে উৎসব বলা যায় না। আনন্দ-যজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ থাকতে হবে। আমাদের পুরাণ ঢাকার সর্বজনীন পূজার গল্পটা আপনাদের বলি।
আমাদের পাড়ার শিবা মানে শিবেন্দ্র বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরা গ্রাম থেকে একটা দুর্গা প্রতিমা (ছোট সাইজ) কিনে নিয়ে এসেছিল ওদের বাসায়। ওর বাবা প্রতিমা দেখে তো হতবাক। প্রতিমা বাসায় এলে তার পূজা করতে হয়, এটাই নিয়ম। দুর্গা পূজা-তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। শিবার বাবা ওকে চর চাপ্পর দিয়ে প্রতিমা সহ বাড়ি থেকে বেড় করে দিয়েছেন। বেচারা শিবা তাতি বাজারের এক বাড়ির উঠোনে বসে প্রতিমা কোলে নিয়ে কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফেলছে। খবরটা চলে এসেছে তাঁতিবাজারের ক্লাব ঘরে। সাইফুদ্দিন ভাই তখন সদলবলে খেলছিলেন ক্যারাম। উনি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। যেন তেন প্রেসিডেন্ট নয়, ঢাকার সবচাইতে বড় রংবাজ পাঁচপাত্তুর সাথে চলাফেরা করেন। পাঁচপাত্তু নামের রহস্য অনেক দিন পর উদ্ধার করেছি। পাশ পার্ট টু। তিনি কলেজে পার্ট টু পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। যাই হোক, সাইফুদ্দিন ভাই ক্যারাম বোর্ডের লাল গুটিটা ফেলতে ফেলতে বললেন, শিবাকে এখানে নিয়ে আয়। এই ক্লাবে হবে দুর্গা পূজা। শিবা, প্রতিমা নিয়ে হাজির হলো। ডাকা হলো সেক্রেটারি মিলন-দাকে। শুরু হলো প্রস্তুতি।
বাঁশ টাস নিয়ে এলো তাহের ডেকোরেটর। স্টেজ, গেট তৈরি শুরু হলো। চাঁদার বই ছাপানো হলো। তাঁতি বাজারের সোনার দোকানগুলোতে গিয়ে শুধু বলা, সাইফুদ্দিন ভাই পাঠিয়েছেন, পূজার চাঁদা। আর কোন কথা নেই, মুক্ত হস্তে দান। আমরা ছোটরা কাগজের শিকলি বানাতে শুরু করলাম। কল-রেডি থেকে মাইক এসে গেল। ৭৫ আর,পি,এম রেকর্ডে পিন পরতেই বেজে উঠলো সিরাজদৌলা। চুপ, সরে এসো আলেয়া - নবাব আসছেন। গোলাম হোসেন তোমার চোখে জল?
রঙ্গিন কাগজের ঝালট, আর একরত্তি প্রতিমা। অথচ আনন্দ আর ধরেনা। কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। নতুন শাড়িতে বৌদিরা। ফুল-ছাপ জামাতে মেয়েরা। আমাদের কাজের খালাও গোলাপি শাড়ি পরেছে। মোড়ের মাথার ভিক্ষুক টির গায়েও নীল শার্ট আর নতুন রাবারের স্যান্ডেল। আজ তার হাতে ভিক্ষা-পাত্রটি নেই। ক্লাবের সেক্রেটারি মিলন-দার এক ছোট বোন ছিল। নাম বেলী। বেশ ঢল ঢলে মুখ। সে যখন তেরছা চোখে তাকাতো আমি জড়সড় হয়ে যেতাম। ওকে সব সময়ই দেখতাম তবে কোন দিন কথা বলা হয়নি। সেই পূজাতেই কিছু একটা কাজ করছিলাম, হঠাৎ পেছন থেকে ডাক, এই বাবলুদা! তাকিয়ে দেখি বেলী। একটু থতমত খেয়ে বললাম, কি? ও বললো, বাবা বলেছে পুজো সংখ্যা দেশ পত্রিকা পড়া হয়ে গেছে, তুমি বাসায় এসে নিয়ে যেও।’ সোভান বুক স্টল থেকে আমাদের বাসায় তখন প্রতি সপ্তাহে দেশ পত্রিকা আসতো।
আমি তখন মাত্র হাঁপ প্যান্ট থেকে ফুল প্যান্ট ধরেছি। যথা সময় ওদের বাড়ি হাজির হলাম। বাড়ি মানে ওদের বাড়ির গেটে। বেলী দরজা খুললো, দুই বেণী, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বললো, দাড়াও। ছুটে গিয়ে পত্রিকাটা নিয়ে এলো। আমার হাতে দিয়ে বললো, পত্রিকার ভেতরে একটা জিনিস আছে, দেখো। কি জিনিস জিজ্ঞেস করার সাহস হলোনা। আমি পা চালিয়ে ওদের গলিটা থেকে বেড়িয়ে এলাম। হাঁটতে লাগলাম আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে। রায় সাহেবের বাজারে ঢুকে পড়লাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাজারে লোকজন হাতে গোনা। ডিম ওয়ালার কুপির আলোয় ঝুড়িতে ডিম সাজিয়ে বসে আছেন। সেই আলোতে দেশ পত্রিকাটা খুলে দেখি, ভেতরে একটা চিঠি। বেলীর লেখা। চিঠিতে লিখেছিল, আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাও, শুধু রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেঁটো না। আমাদের জানলার দিকে তাকাবে, আমি তোমার জন্য রোজ অপেক্ষা করি। পুজায় আমি গান গাইবো, তুমি অবশ্যই শুনবে। তা না হলে ঝগড়া।
চিঠিটা পড়ে আমার মধ্যে কী ভয়াবহ রকমের আনন্দ হয়েছিল সেটা আপনাদের কি করে বোঝাই। এতগুলো বছর পরও চিঠির প্রত্যেকটা লাইন মনে আছে, এটাইতো বড় প্রমাণ। যাই হোক এলো বিজয়া দশমী। পূজার শেষ দিন। মা দুর্গা আজ ফিরে যাবেন। ফাংশন হলো। কবিতা, গান, নাচ। পাড়ার কেউ বাকি রইল না। ‘তালগাছ’ কবিতাটি তিন জন আবৃতি করলো। আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুঁড়িল ... এই গানটি তরুনদার নব বিবাহিত স্ত্রী গাইতে গাইতে কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। শেষ করতে পারলেন না। বেলী এলো মঞ্চে। আজকে শাড়ি পরেছে। হাতে গানের খাতা। কি গান গেয়ে ছিল মনে নেই, তবে গানের মাঝ পথে মাইক খারাপ হয়ে গেল। বেলী থামলো না। গেয়েই গেল। শো মাস্ট গো অন।
এর পর বিসর্জন, ঠাকুর যাবে বুড়িগঙ্গায়। এতগুলো দিনের আনন্দের পর বুক ভার করা সময়। বড়রা ছোটদের মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করছেন। সব চাইতে বেশি ধান-দূর্বা পড়েছে সাইফুদ্দিন ভাইয়ের মাথায়। এই ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করার একটা কারণ আছে। প্রাচীন কালে ধান ছিল ধনের প্রতীক। অন্যদিকে দূর্বা দীর্ঘায়ুর প্রতীক। দূর্বা সহজে মরেনা। দুর্বার আরেক নাম ‘অমর’। হঠাৎ দেখি বেলী আমাকে ইশারায় ডাকছে। আমি ওর কাছে গেলাম। আমাকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে আমার হাতে এক মুঠো ধান-দূর্বা গুজে দিল, বললো মাথায় দাও। এই বলে সে চোখ বন্ধ করলো। আমি ওর মাথায় ধান দূর্বা ছড়িয়ে দিলাম। সেই ছিল আমার প্রথম বড় হওয়া।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|