দিঘির জলে কার ছায়াগো? আশীষ বাবলু
বৈশাখী মেলায় মেয়েটির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। বয়স ২১/২২ এর বেশি হবেনা। জিন্স, টি-সার্ট পরে সে মেলায় এসেছে। ছিপছিপে মেয়েটিকে এই ড্রেসে মানালেও এই বাঙ্গালী মেলায় এ ড্রেস মানাচ্ছিল না। মেয়েটির হাসি আমি যদি মুক্তোর মত বলি তবে যে কোন ডুবুরি ঝিনুক কুড়োবার আনন্দে হাবুডুবু খাবে। আর তার চোখ ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে মনে হয়না, আমার মনে হয় লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এখন মানুষ নির্মাণে ঈশ্বরকে সাহায্য করছেন, চোখদুটি তা‘রই তুলির টানে আঁকা। মোনালিসার মত সরল অথচ রহস্যে ভরা।
মেয়েটি সুন্দরী। এ ধরনের সুন্দরী হঠাৎ খসে পরা তারার মত। কদাচিৎ দেখা যায়। আমার চেয়ে বয়সে যেহেতু অনেক কম তাই তুমি করেই বললাম। নাম কি তোমার ?
তিথি।
বেশ সুন্দর নাম। অর্থ জানো ?
হ্যাঁ, চাদের দিন-কাল।
ঠিক্ বলেছ। প্রতিপদ, দ্বিতীয়া...
সে মুখ ঘুড়িয়ে বলল, আমাবস্যাও কিন্তু একটা তিথি।
এবং পূর্ণিমা, তুমি যার বই খুঁজছো তিনি কিন্তু চাঁদ খুব ভালবাসতেন।
জানি। হুমায়ুন আহমেদ বলতেন, কবিরা চাঁদ দেখেনা, জোস্না দেখে।
গায়ক গোলাম আলি কি বলেছেন শোন,- সেটা জোস্না রাত ছিল, তোমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। কেউ বলল ওটা চাঁদ, কেউ বলল চেহারা তেরা...
হো হো করে হাসল তিথি। আমার বইবর দোকান মুহূর্তের মধ্যে জোস্নার আলোয় ভরে গেল। একটু আগেও বুঝতে পারিনি ও এতটা প্রাণ খুলে হাসতে পারে।
বইয়ের দাম মিটিয়ে মেলার মধ্যে অদৃশ্য হল তিথি।
ঘণ্টাও কাটেনি এবার হাজির হলো আরিফ। আমাদের হাবিব ভাইয়ের ছেলে। ওর পরনে জিন্সের উপর টি-শার্ট। বুকের উপর ভাঙ্গাচোরা ডিজাইনে লেখা ‘লাইফ সাক্স’। মুখে হালকা দাড়ি। এই দাড়িকেই বোধহয় বলে ফাইভ ও ক্লক বিয়ার্ড। চেহারায় কিচ্ছু ভাল্লাগেনা এমন একটা ভাব। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন আংকেল ?
ভাল। তুমি কেমন আছ ? নতুন চাকুরী কেমন চলছে ?
ঠিক আছে। তবে একটু বোরিং।
কোন ব্যাঙ্কে তোমার চাকুরী...?
কমনওয়েলথ।
মেলা কেমন লাগছে ?
অলরাইট..
অলরাইট মানে ? এত মানুষ জন..এত খাওয়া দাওয়া...এত হৈ চৈ...
এসব ভাল লাগেনা। ভাবছি বাসায় গিয়ে টিভিতে টেনিস দেখবো। আজ রজার ফেডারার খেলবে। আপনার কি হ্যান্ড লাগবে ? মানে বই টই টানাটুনি করতে হবে ?
না না আমি ঠিক আছি। তুমি কি একা এসেছ ?
হ্যাঁ, মা, আব্বু পরে আসবে।
আমি আংকেল জনিত গাম্ভীর্য একপাশে রেখে বললাম, মা বাবার কথা বলছিনা। গার্লফ্রেন্ড ?
ও গালে টোল পরা শাহরুখ খানের মত হাসি দিয়ে বলল, নেই।
আমি আর এ প্রসঙ্গে এগোলাম না।
আরিফ আঙ্গুল দিয়ে ওর ছোট করে কাটা চুলে হাত বোলাচ্ছে। সুন্দর এ্যাথলেটিক শরীর। ইদানীং ছেলে মেয়েরা বেশ স্বাস্থ্য সচেতন। দেখতে ভাল লাগে। সেই কতটুকুন দেখেছি ওকে। খুব শসা খেতে ভালবাসতো। শসা হাতে ধরিয়ে দিলে কান্না থেমে যেত। ছেলে পেলেরা এখানে খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলাম , আরিফ তোমার বয়স কত হলো ?
আমি ওকে অনেক দিন ধরে চিনি, তাই এই প্রশ্নটা করা যায়। আমাদের দেশের মত বয়স কমাবার প্রচেষ্টা এদেশে তেমন দেখিনি। আমাদের দেশে বাচ্চাদের বয়স- বাসায় ছয় হলে স্কুলে পাঁচ, আর বাসে বা ট্রেনে সারে তিন। এখানে কোন পাঁচ বছরের বাচ্চাকে চার বছর বলে দেখুন না, প্রতিবাদ করে বলবে , ‘নো, আই এ্যাম ফাইভ।’ এখানে সিনেমার নায়িকারাও বয়স লুকোয় না।
আরিফ বলল, টুয়েন্টি ফাইভ হবো নেক্সট মাসে।
আরিফ টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো থেকে একটি বই তুলে পাতা উল্টাচ্ছে একমনে। আশে পাশে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে তাতে তা’র কোন পরোয়া নেই। এমনকি যে বইটির পাতা উল্টাচ্ছে তার একটি লাইনও পড়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করছে না ! বাসায় গিয়ে এই ছেলে এখন টিভিতে টেনিস দেখবে।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আরিফ আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে ?
কি কাজ আংকেল?
আমাকে একজনকে খুঁজে এনে দিতে পারো ?
কাকে ? আন্টিকে ? তাকেতো একটু আগে একটা শাড়ির দোকানে দেখলাম।
না না আন্টিকে নয়। একটা মেয়েকে, জিন্সের উপর একটা কালো টি শার্ট পরনে।
এত মানুষের ভিড় এর মধ্যে কত মেয়ে জিন্সের উপর ব্ল্যাক টি-শার্ট পরে এসেছে !
মেয়েটির নাম তিথি। ওর কালো টি-শার্টে ছোট ছোট হলুদ ফুল-ছাপ।
ঠিক আছে দেখি ট্রাই করে। এই বলে আরিফও ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হলো।
তারপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। মেলা তখন টপ গিয়ারে। হু হু করে বাড়ছে মানুষের ঢল। মিলন মেলার এই উৎসবে উপস্থিত কত মানুষ। উপস্থিত স্বয়ং বৈশাখ। মানুষ কথা বলছে, নাচছে, গাইছে, হাসতে হাসতে এলিয়ে পরছে। কেউ মন খারাপ করে নেই। মন খারাপ করা ব্যাপার গুলো মানুষ ভুলে গেছে। এর জন্যই মেলা আমাদের এত প্রিয়।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে লক্ষ করলাম আরিফ আর তিথি কথা বলতে বলতে আমার বইয়ের স্টলের দিকে আসছে। কাছে এসে আরিফ বলল, আংকেল খুঁজে এনেছি, আপনি কী এর কথা বলছিলেন?
হ্যাঁ, কোথায় পেলে ?
প্রায় এক ডজন জিন্স আর টি-শার্ট পরা মেয়েকে নাম জিজ্ঞেস করেছি, অনেক কষ্টে তিথিকে খুঁজে পেয়েছি।
কিছু পেতে হলে একটু কষ্টতো করতেই হয়, আমি বললাম।
আপনি আমাকে ডেকেছেন কেন ? তিথি আমাকে জিজ্ঞেস করল।
এই প্রশ্নটার উত্তর আমার অনেক আগেই তৈরি করে রাখা উচিত ছিল। চেহারায় একটু সিরিয়াস ভাব এনে,একটা বই ওর দিকে তুলে ধরে বললাম, হুমায়ুন আহমেদের এই বইটা তুমি সম্ভবত খুঁজছিলে ।
আমিতো কোন পার্টিকুলার বই খুজছিলাম না। দেখি কি বই এটা।
দিঘির জলে কার ছায়াগো।
তিথি বইটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলো, ঠিক আছে এই বইটা আমি নেব।
জোর করে তোমার নিতে হবেনা আমি বলেছি বলে।
না ঠিক আছে, এই বইটা আমি পড়িনি।
আমি বইটা একটা প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ও ওর টুকটুকে হলুদ ব্যাগ থেকে টাকা বেড় করে আমাকে দাম ধরিয়ে দিল। ওরা দুজনে আবার কথা বলতে বলতে মেলার ভিড়ের দিকে এক সাথে হাঁটতে শুরু করলো। হঠাৎ কী হলো আমি চেঁচিয়ে আরিফকে ডাকলাম। ও দৌড়ে আমার কাছে এলো। আমি নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি টেনিস দেখতে বাসায় যাচ্ছনা ?
নো আংকেল। আমি অন্য সময় ইউ টিউবে দেখে নেবো।
আরিফ আবার এক দৌড়ে তিথির কাছে ফিরে গিয়ে পাশা-পাশি হাটতে হাটতে মেলার জন সমুদ্রে অদৃশ্য হলো।
আজকে ঘটনাটা লিখলাম এই কারনে যে গত মাসে আরিফ আর তিথির বিয়েতে খুব আনন্দ করেছি।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|