bangla-sydney













চুন্নু চলে গেল
আশীষ বাবলু


দেখলাম চিরনিদ্রায় শায়িত পি, এস, চুন্নু। চকমকে কফিন। ধবধবে বিছানা। ফিটফাট কোট প্যান্ট পরা। বড় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। এমন সাজগোজ করতে আমি কখনো ওকে দেখিনি। তবে এই বিশেষ দিনে সাজসজ্জার প্রয়োজন একটু-তো আছেই, আজ যে চির বিদায়ের দিন।

যে ত্রিশ বছরেরও বেশি লাকি কান্ট্রি অস্ট্রেলিয়ার মত একটি দেশে আছে। অথচ সে মানুষটির ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টে সর্বসাকুল্যে একশ দশ ডলার, যার বাড়ী নেই, গাড়ী নেই, কী আশ্চর্য! তাকে বিদায় জানাতে এসেছে মানুষের ঢল। না না বর্ণের, না না ধর্মের, না না দলের, সবাই শোক স্তব্ধ। শেষ দেখা দেখতে এসেছেন। কিন্তু কেন? কি ছিল? কে ছিল প্রদ্দূৎ সিংহ চুন্নু?

চুন্নু হচ্ছে এক রাশ ব্যস্ততা। চুন্নু মানে এখনই ছুটতে হবে। চুন্নু মানে এখনই করতে হবে। চুন্নু মানে অফুরন্ত প্রাণ শক্তি, অফুরন্ত উদ্যম। তবে এই উদ্যম, এই প্রাণ শক্তি নিজের বৈষয়িক ফায়দা বা সংসারের জন্য নয়। সমাজসেবা।

কার বাবা দেশ থেকে নূতন এসেছেন মেডিকেয়ার কার্ড নেই, কিন্তু ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কার চাকুরী চলে গেছে, আজাদ ভাইকে বলে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। কোন বন্ধুর স্ত্রী হাসপাতালে কিন্তু সেখানকার খাবার খেতে পারছেন না, তার জন্য শুটকি মাছ আর আলু ভর্তা নিয়ে যেতে হবে। যে দুজন ছেলেকে ভিলাউড ডিটেনশন সেন্টারে ধরে নিয়ে গেছে তাদের জন্য উকিল ঠিক করতে হবে। গামা ভাইকে দিয়ে সার্টিফিকেট লিখিয়ে কাকে নিয়ে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে। তারমধ্যে স্বদেশ বার্তা, সোনার বাংলা, আওয়ামী লিগ, বঙ্গবন্ধু, মিটিং, এয়ারপোর্ট পিক আপ, ড্রপ অফ। কাজ আর কাজ। একটা সম্পূর্ণ দিনের আয়ু তো মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা!

মাঝে মাঝে ভাবতাম এত প্রাণ শক্তি ও পায় কোথায়? ও নিজে করে নাকি ঈশ্বর করায়? যদিও ঈশ্বর নিয়ে ওকে কোনদিন মাথা ঘামাতে দেখিনি।

আমার সাথে প্রথম পরিচয় রেন্ডুইক, ডনকাস্টার এভিনিউর কিশোর দাশের বাড়িতে। সেটা নব্বই- একানব্বইর কথা। সেখানে প্রতি উইক এন্ডেই আমাদের এক ডজন বন্ধু মিলে আড্ডা হতো। সেখানে ওকে দেখেছি কয়েকশ বার, কিন্তু কখনো ওর সাথে আড্ডা দেবার সৌভাগ্য হয়নি। সব সময় ব্যস্ত। কাজের মানুষেরা আড্ডা দেয়না। তবে আড্ডা না হলে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না। তাই চুন্নু আমার ঘনিষ্ঠ কখনো হয়নি তবে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হয়েছিল এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

আজাদ ভ্ইার ‘স্বদেশ বার্তা’ পত্রিকার শুরুতে চুন্নুই দেখতো। আজাদ ভাই, গামা ভাই ওকে খুবই স্নেহ করতেন। পরবর্তীতে লুৎফর রহমান শাওন দায়িত্ব নিলেন স্বদেশ বার্তার, চুন্নু মহাসমারোহে শুরু করলো ‘সোনার বাংলা’। যেহেতু টুকটাক লেখালিখি করতাম প্রতিদিন না হলেও প্রতি সপ্তাহে টেলিফোনে কথা হতো। আর দেখা হতো ক্যামসির বিশ্বজিতে এর বাড়ী। বিশ্বজিৎ ঝড়ের বেগে বাংলা টাইপ করতে পারতো। হাতের লেখাও ছিল অতি সুন্দর।

এখন ভাবতে বসলে মনে হয় কি অদ্ভুত সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল সেই সময়, সেটা ছিল সিডনির বাঙ্গালীদের যৌবন কাল। নব্বই এর দশক।

দু:সংবাদটা তপন আমাকে দিয়েছে। তপন কুণ্ডু হচ্ছে চুন্নুর খুলনার স্কুলের সহপাঠী। একই সাথে দুজনে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। আমাকে কাঁদো কাঁদো গলায় বললে চুন্নু হঠাৎ করে চলে গেছে।

হার্টএ্যাটাক?

যে মানুষটার হার্টই নেই, যে সমস্ত হৃদয় দিয়ে বসে আছে সিডনির মানুষদের, তার হার্টএ্যাটাক হয় কি করে? তার পর জানালাম অনেক কিছু। অফুরন্ত প্রাণশক্তি ছিল বলে শরীরের তোয়াক্কা কখনো করেনি।

সেই সময় সিগারেট আমরা সবাই খেতাম, মদও। চুন্নুকে এসব ছুতে কখনো দেখিনি। আর মেয়েদের কথা কি বলবো! মেয়ে মহলে ও ছিল খুবই জনপ্রিয়। আমরা সবাই জানি মেয়েদের জন্মগত ভাবে একটা বিশেষ ক্ষমতা থাকে, ছেলেদের স্বভাবের একটা বিশেষ ব্যাপার খুব সহজে বুঝতে পারে। বুঝতে পারে কাকে বিশ্বাস আর নির্ভর করা যায়। সেই সময় আমার নববিবাহিত স্ত্রী কত সহজে আমাকে অফিসে টেলিফোন করে বলতো, তুমি চিন্তা করো না আমি চুন্নুর সাথে গিয়ে শপিং করে নেবো।

চুন্নু তার মহাপ্রস্থানের আগ পর্যন্ত সিডনি আওয়ামী লিগের সেক্রেটারি ছিল। পলিটিকাল লোকদের আমি একটু ভয় পাই। নিজেকে পলিটিশিয়ান ভাবতো চুন্নু। ও নিজেই জানতো না নেতা হবার কোন যোগ্যতা ওর ছিলনা। সত্য কথা মুখের উপর বলে দেওয়া আর নিজের স্বার্থ না ভেবে পরের উপকার করতে যারা ঝাঁপিয়ে পরে তারা আর যাই হোক পলিটিশিয়ান হতে পারেনা। চুন্নু ঠিক চুন্নুর মত।

সেদিন ওর স্ত্রী বিলকিসের বক্তব্য শুনে তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাতা নত হয়েছিল। হারাবার দুঃখের কোন পরিমাপ হয়না। যে ভালবাসা ও ফেলে রেখে গেছে তারও কোন পরিমাপ নেই। সেদিন সাথী-হারা বিলকিসের করুন মুখের দিকে তাকিয়ে কোন সান্ত্বনার বানী শোনাবার মতো ভাষা আমার ছিলনা।

চুন্নু যদি চাইতো প্রচুর অর্থের মালিক হতে পারতো। রেস্টুরেন্ট ব্যবসাটা ও ভাল বুঝাতো। আমার মনে আছে আমাদের পারিবারিক একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ও খাবার সাপ্লাই করে ছিল। সেই খাবারের দাম চুকাতে আমাকে ওর পেছনে এক বছর লেগে থাকতে হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেই বলতো, পরে দিয়েন... পরে টাকা দিয়েন... আশীষদা।

চুন্নু, যে মানুষকে এত কিছু দিয়েছে তাকে ভুলে যাওয়া কঠিন। ওর ফিউনারালে গিয়ে একটা বড় শিক্ষা পেলাম।

মৃত্যুর পর কয়টা বাড়ী, কয়টা গাড়ী, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সোনা দানা, শাড়ি গহনার খবর কেউ জানতে চায় না, জানতে চায় না কতবার মন্দিরে গিয়ে তুমি ঘণ্টা বাজিয়েছো। জানতে চায় পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য তুমি কি করেছ। এমন কিছু করে যাওয়া উচিত যেন তোমার কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে বন্ধু বান্ধব দুটো কথা তোমার সম্বন্ধে বলতে পারে।

পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে চুন্নুর সম্বন্ধে কিছু বলার জন্য মানুষের লাইন। সঞ্চালক তুষার রায়ের পক্ষে সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে পরেছিল। সবাই ওর সম্বন্ধে নতুন কিছু বলতে চায়। এর চাইতে বড় সৌভাগ্য একটা মানুষের জীবনে আর কি হতে পারে?


পৃথিবীর কিছুমাত্র ধরে রাখার ক্ষমতা আমাদের নেই। যেতে নাহি দেবো তবু যেতে দিতে হয়। তবে আমার বিশ্বাস সিডনির বহু মানুষ বহুদিন চুন্নুকে হৃদ মাঝারে রাখবে, যেতে দেবে না।




আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au





Share on Facebook               Home Page             Published on: 26-Jan-2023

Coming Events: