আরশিতে মুখ, কিছু কথা আশীষ বাবলু
আমার হাতে বইটি আসে একটি সুদৃশ্য কাগজের মোড়কে। মোড়ক উন্মোচন করে খুবই যত্নে ছাপানো বইটির পাতা উল্টাতে গিয়ে চোখ আটকে গেল। বইটির নাম ‘আরশিতে মুখ’, লেখিকা আমাদের সিডনির রোকেয়া আহমেদ।
ভূমিকায় লেখিকা লিখেছেন - এখানে ভান-ভণিতার কোন আড়ম্বর নেই। এ শুধু জীবনের সহজ পঠন।
কথাটির সত্যতা প্রথম লেখাটিতেই অনুধাবন করলাম। বদলে যাওয়া এই আমি। তিনি লিখেছেন, দেশে থাকার দিনগুলোতে যে অনিয়মকেই নিয়ম বলে মেনে নিয়েছি সিডনির ট্রেন পাঁচ থেকে দশ মিনিট লেট হলে ভাবি ‘একি অরাজকতা’। রোকেয়া আহমেদ সহজেই লিখেছেন, একবার ভাল কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বোধহয় পুরানের সাথে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। প্রবাসে জীবন যুদ্ধে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করতে গিয়ে দেশের দিন মজুর ও শ্রমিকদের শ্রম নিংড়ানো কষ্টকে টের পাই..।
লেখিকা প্রশ্ন করেছেন, এটা কি হিপোক্রেসি, ভাব-বিলাস নাকি আবেগ সর্বস্ব নস্টালজিয়া?
রোকেয়া আহমেদ | লেখিকা রোকেয়া আহমেদের ২০০০ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী জীবন শুরু। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর তার আর দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি।
লিখেছেন, ‘পরবাসী হয়েছি স্বেচ্ছায়, দেশের বিরহে পুড়েও কেন বিদেশকে ভালবাসি? হেথায় তোরে মানাইছে না রে.. আমি কি তবে সেই তত্বে বিশ্বাসী ভালোবাসা তা সে প্রেমই হোক বা দেশপ্রেম, তাকে পাতে নিতে নেই। সুগন্ধি লেবুর মত দূরে রেখেই তার সৌরভকে অনুভব করতে হবে।’
আমরা জানি প্রবাসীদের ঐ একটাই স্বপ্ন, একদিন দেশে ফিরে যাবো। আমার নাম মনে পড়ছেনা এক কবি লিখেছিলেন,
ফিরবো বললেই ফেরা যায় নাকি হাসি দিয়ে শুধু কান্নাকে ঢাকি।
কান্না ঢাকতে ঢাকতে প্রবাসীদের জীবন দফারফা!
‘আরশিতে মুখ’ বইটি শুরু করে বুক মার্ক দিয়ে সরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এক ডজন সুলিখিত প্রবন্ধের সমাহার বইটিতে। আমাদের মনের যে আয়না ঘর সেই আয়না বা আরশিতে লেখিকা নিজেকে যাচাই করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের প্রত্যেক প্রবাসীর জীবনের গল্প কোননা কোন ভাবে একই রকম।
রোকেয়া আহমেদ লিখেছেন, সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত ঢাকার আকাশ দেখার আমার ছিল নিত্য বিলাস। এখন বহুতলা ভবনের ভীরে আমার সেই আকাশ হারিয়ে গেছে। সিডনির সুনীল আকাশ আমার দেশ ছাড়ার কষ্টকে কিছুটা লাঘব করেছিল। হঠাৎ এখানে একদিন টের পেলাম আগের মত আর আকাশ দেখা হয়না। অপিসে ডেড লাইন মিট করার তাগিদে মুখ তুলে আকাশ দেখার সময় নেই। এটা তো আমাদেরও সবার জীবনের গল্প তাইনা?
তিনি ক্যাম্বেলটাউন স্কুলে বাংলা পড়াতে গিয়ে হঠাৎ অনুধাবন করেন, বাচ্চাদের সাহসী আনন্দিত মুখগুলো আকাশের ক্যানভাস হয়ে ওঠে। সেই আকাশে তিনি ওদের সাথে এক কাতারে স্বপ্নের ঘুড়ি উড়ান।
হুমায়ুন আহমেদের লেখা প্রসঙ্গে লেখিকা লিখেছেন, তিনি বেঁচে থাকবেন তার গল্প বলার অসাধারণ দক্ষতা আর দামাল তারুণ্যে দীপ্ত ‘তুই রাজাকার’ শ্লোগানে।
এই লাইনটা পড়ে আমি একটু থমকে গিয়েছিলাম। একদম খাটি কথা! জয় বাংলার পর যদি আর একটি স্লোগান যা বাংলার মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করেছে সেটি হচ্ছে ‘তুই রাজাকার’। স্যালুট রোকেয়া আহমেদ।
তিনি ছেলেবেলার গল্প শোনার আর গল্প পড়ার দিনগুলিতে তার গোগ্রাসে বই পড়ার কথা বলেছেন । লিখেছেন, ‘বই পড়া আমাকে গভীর ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে।’
কথায় আছে, লিখতে শেখানো হয়তো যায় কিন্তু ভাবতে শেখানো যায় না। সেটা সম্ভব একমাত্র বই পড়ে। আমাদের বর্তমান সাহিত্য জগতে যে সমস্যাটা আমার সব সময় চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে, যারা বই পড়েন তারা লেখেন না আর যারা লেখেন তারা বই পড়েন না।
শেষে বলবো, বইটির প্রধান ত্রুটি এর হঠাৎ পরিসমাপ্তি। শেষ পাতাটি দেখলে মনে হয় আরো পৃষ্ঠা বাকি রয়ে গেছে। বাধানো হয়নি।
লেখিকাকে বলবো লেখা থামাবেন না। বই পড়ুয়াদের বলবো বইটি পড়বেন, গ্যারান্টি দিচ্ছি হতাশ হবেন না।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|