বই পড়ে বড়লোক আশীষ বাবলু
ইলন মাস্ক এগার বছর বয়সে ইনসাইক্লপিডিয়া পড়ে শেষ করেছিলেন। ১৫ বছর বয়সে একটা মানসিক অস্থিরতা তাকে ভীষণ ভাবে কষ্ট দিচ্ছিল। মনে প্রশ্ন- মিনিং অফ লাইফ। বেঁচে থাকাই কি জীবন?
বলে কি ছেলে? ১৫ বছর বয়সে জীবন জিজ্ঞাসা!
ইলন মাস্ককে আমরা সবাই চিনি। ইনি হচ্ছেন পৃথিবীর এক নাম্বার অথবা দুই নাম্বার বড়লোক। সম্পত্তির পরিমাণ ১৮৫ বিলিয়ন ডলার। ইদানীং যে মানুষই তার সান্নিধ্যে এসেছেন, সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে- ভদ্রলোক খুবই স্মার্ট। তবে এটা ঠিক বাংলা ‘স্মার্ট’ নয়। বাংলায় স্মার্ট বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোট-সুট-টাই পরা, চোখে সানগ্লাস, ঠোটের ফাকে সিগারেট, হাতে গাড়ীর চাবি আঙ্গুলে ঘোরাচ্ছেন, এমন একজন।
ইলন মাস্কের বেলায় ‘স্মার্ট’ ব্যাপারটা ভিন্ন। তিনি সোজা সাপটা কথা বলেন। তার প্রতিটি কথায় ওজন আছে। তার সান্নিধ্যে মানুষ আলোকিত হয়। তিনি জিনিয়াস।
সাংবাদিক যখন তাকে প্রশ্ন করলেন, রকেট বানানো শিখলেন কি করে?
উত্তরে তিনি বললেন- বই পড়ে।
ইলন মাস্ক প্রতিদিন দশ ঘণ্টা বই পড়েন। জন্ম ১৯৭১। বয়স মাত্র পঞ্চাশ পেরিয়েছে। কারি কারি টাকা তার ব্যাঙ্কে। কোথায় শুয়ে বসে পা তুলে খাবেন দাবেন মৌজ করবেন তা‘না তিনি বসে বসে বই পড়ছেন! পাগল কাকে বলে!
শেষ পর্যন্ত কি জীবনের মানে কিছু বুঝলেন? সাংবাদিক আবার জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ বুঝলাম’। উত্তর দিলেন ইলন মাস্ক। ‘বুঝলাম, জীবনে উত্তর দেবার চাইতে প্রশ্ন করা কঠিন। প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হতে হয়। জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হয়। শিখতে হয়, জানতে হয়। সেটা একমাত্র সম্ভব বই পড়ে।’
পৃথিবীর সবচাইতে তিন জন বড়লোকের একজন ওয়ারেন ব্যাফেট। তিনি যতটুকু সময় জেগে থাকেন তার অর্ধেক সময় বই পড়েন। শেয়ার বাজারের বেচা কেনা তার চাইতে বেশি বোঝেন এমন কেউ বর্তমান পৃথিবীতে নেই। প্রতি বছর শেয়ার হোল্ডারদের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি তাদের সবসময় কয়েকটা বিশেষ বই পড়তে অনুরোধ করেন।
বিল গেটস এর পরিচয় দেবার দরকার নেই। তার পরিষ্কার হিসেব বছরে ৫০ খানা বই পড়তে হবে। অর্থাৎ সপ্তাহে একটি বই তিনি পড়বেনই।
তাকে প্রশ্ন করা হয়ে ছিল এত টাকার মালিক কি করে হলেন? উত্তরে তিনি বললেন সব সময় মনে রাখতে হবে টাকার আরেক নাম ‘আইডিয়া’। মাথায় আইডিয়া না আসলে পকেটে টাকা আসবে না। নতুন আইডিয়া বই না পড়লে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
১৪০ বিলিয়ন ডলারের মালিক জেফ বেজোস্। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘অ্যামাজন’। বই পড়তে এতো ভালবাসেন যে অন-লাইনে বই বিক্রি করে তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন, বাকিটা ইতিহাস। এখন তার অ্যামাজনে চোখের জল ছাড়া হেন বস্তু নেই যা বিক্রি হয় না।
আপনি যখন টেলিফোনে ফেসবুকের পাতায় মুখ-গুজে চোখের পাতা খোলবার ফুরসত পাচ্ছেন না, তখন এই ফেসবুকের মালিক ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বাংলো বাড়িতে বসে আছেন চেয়ারে হেলান দিয়ে। পাশে ঝকঝকে মেহগনি টেবিলে অর্ধ সমাপ্ত কফি কাপ। বড় কাচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সবুজ লন। একটা হলুদ পাখি সেই সবুজে টুক টুক করে লেজ নাড়ছে। অথচ চেয়ারে বসা ভদ্রলোকের কোনদিকে খেয়াল নেই। তার চোখ আটকে আছে কোলের উপর খুলে রাখা বইয়ের পাতায়।
ভদ্র লোকটির নাম মার্ক জুকেরবার্গ। তিনি খুব ছোট বয়স থেকে বিশ্বাস করতেন বই পড়ার জন্যই তার পৃথিবীতে জন্ম। বই তার এত প্রিয় যে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তার একান্ত আপন হচ্ছে বই। তার আশ্চর্য আবিষ্কার ‘ফেসবুক’। সেখানেও ঐ ‘বই’ শব্দটি এসে গেছে।
একটি দম্পতির কথা বলছি। সুধা মূর্তি, নারায়না মূর্তি। ১৯৮১ সালে ২৫০ ডলার পুঁজি নিয়ে একটি কোম্পানি খোলেন। নাম ‘ইনফোসিস’। আজকে এই কোম্পানির ক্যাপিটাল হচ্ছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। সেখানে কাজ করে তিন লক্ষ কর্মচারী।
পাঁচ হাজার বইয়ের পার্সোনাল লাইব্রেরি তাদের বাড়িতে। দুজনেরই সখ বই পড়া। সুধা মূর্তি বললেন আমাদের স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া, অভিমান, ভালবাসা সবই বই কেন্দ্রিক, বই নিয়ে। তিনি গোটা পঞ্চাশটি বই লিখে ফেলেছেন। এই দম্পতির আরও একটি পরিচয়ও আছে, ইংল্যান্ডের প্রাইমিনিস্টার ঋষি সোনক ওদেরই মেয়ের জামাই।
সুধা মুর্তি বলেন, লাইব্রেরি হচ্ছে মনের হাসপাতাল। রুচি, বুদ্ধি, সংযত ভাষা, বিনীত ব্যাবহার, সহবত, এসব আমরা পাঠ্য বই পড়ে শিখিনি। শিখেছি লাইব্রেরির বই পড়ে।
২০১৭ সালের এক রিপোর্টে জানা গেছে পৃথিবীর সব চাইতে বেশী বই পড়ে যে দেশের মানুষ সেটা হচ্ছে ইন্ডিয়া। তারপরই থাইল্যান্ড। তারপর চিন। নয় নম্বরে আছে সৌদিআরব।
সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে আইসল্যান্ডে তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার মানুষের জন্য প্রতি বছর ১৩ হাজার নতুন বই ছাপা হয়। সে দেশের প্রতি দশ জনের মধ্যে একজন লেখক।
বাংলাদেশে সবচাইতে বেশী বই প্রকাশিত হয় বই মেলায়। ২০২১ সালে মেলায় নতুন বই প্রকাশিত হয়েছিল চার হাজার। সারা বছরে বড় জোর আট থেকে দশ হাজার। ১৬৫ মিলিয়নের দেশে সংখ্যাটা খুব কম।
আমেরিকায় প্রকাশিত হয় বছরে সারে তিন লক্ষ নতুন বই। প্রকাশনার রেভিনিউ ২৩ বিলিয়ন ডলার। ভাবা যায় না। সেই টাকায় বেশ কয়টা পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব।
একটা সময় ছিল বই পড়াটা ছিল একটা সামাজিক দায়। কিপলিং এর নতুন প্রকাশিত বইটি না পড়ে সাহেবরা পার্টিতে গেলে নিজেকে অস্পৃশ্য ভাবতেন। আমারও মনে পড়ে হুমায়ুন আহমেদের নতুন বইটি পড়া না থাকলে যুবক যুবতীদের আড্ডায় লজ্জা বোধ হতো। তবে একটা কথা ঠিক বই মানুষকে শুধু ভালই করেনা, ভদ্রও করে।
জ্ঞান আহরণের ক্ষুধা থেকেই মানুষ বই পড়ে। ডঃ মোহম্মদ শহিদুল্লা জীবনের শেষ বয়সে বলতেন, আর কিছুদিন যদি বেঁচে থাকতে পারতাম তবে আরও কিছু বই পড়া যেতো।
জ্ঞান আহরণের পিপাসা যে কি গভীর হতে পারে তার সব চাইতে বড় উদাহরণ হচ্ছে স্টিফেন হকিংস। যে ধরনের শারীরিক অক্ষমতার মধ্যে তিনি গিয়েছেন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সহ্য করাই অসম্ভব। অথচ তিনি এই অবস্থাতেও খুঁজে বেড়িয়েছেন ইউনিভার্সের আশ্চর্য রহস্য। আমরাতো একটু মাথা ব্যথা হলেই ভাল্লাগেনা ভাল্লাগেনা বলে চেঁচাতে থাকি!
বই পড়া মানুষদের সান্নিধ্য সব সময়ই ভাল-লাগে। কথায় আছে চন্দন গাছের বনে যে সব গাছ থাকে তাদের গায়েও চন্দনের গন্ধ পাওয়া যায়।
এই বই নিয়ে কত রকমের তথ্য যে আছে ইন্টারনেটে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যুদ্ধের মাঝখানে বই পড়তেন। কুকুরের পরেই মানুষের বেস্ট ফ্রেন্ড হচ্ছে বই। মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাইয়ের একটা ফ্যাশন তৈরি হয়েছিল ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলেশনের সময়। লাশ তখন সহজ লভ্য। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে এমন বেশ কিছু বই আছে।
তবে আমার যে তথ্যটি খুব ভাল লেগেছে তা হচ্ছে ব্রাজিলের কারাগারে কয়েদিদের একটি বই পড়লে চার দিনের সাজা মকুফ হয়ে যায়।
যাক, এখানেই শেষ করছি। বই পড়ুন। মনে রাখবেন সব বই কথা বলে তবে কিছু কিছু বই আছে কথা শোনে!
 আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|