বদলে যাচ্ছে পৃথিবী আশীষ বাবলু
এ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলছে দুনিয়া। আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট, ইংল্যান্ডের ব্রেক্সিট, ইউরোপের দুরবস্থা, অস্ট্রেলিয়ায় পলিন হ্যানসন, একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা সবখানে। তার সাথে ছুটছে টেকনোলজি, যার সাথে তাল মেলাতে জনগণের ত্রাহি অবস্থা । একটু শান্তিতে কি থাকা যাবে? আমার চাকুরীটা থাকবে তো?
একদিকে নূতন চিন্তাধারার শাসক শ্রেণী আর অন্যদিকে টেকনোলজির অভাবনীয় উন্নতি। আমেরিকায় রয়েছে চার মিলিয়ন ক্যাশিয়ার যাদের বর্তমানে কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে তো ব্যবসার চাইতে ক্যাশিয়ার বেশি! সংবাদ সংগ্রহের জন্য এখন আর সাংবাদিক দের ছুটতে হচ্ছেনা, যার হাতে ক্যামেরা রয়েছে সেইতো সাংবাদিক! সেদিন টিভিতে একজন নামকরা ইকনমিষ্ট বলছিলেন, চাকুরী ছাটাইয়ের সুনামি আসছে, এখন নতুন প্রজন্মের এমন কিছু শেখা উচিত যা যন্ত্রের পক্ষে করা সহজ নয় । আমার ডাক্তার বন্ধু সেদিন বলছিলো, রোগীরা গুগল দেখে আগে থেকেই রোগের ড্যাইগনোসিস্ করে আসে। ভাগ্যিস এদেশে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া সব ওষুধ কেনা যায়না তাই জিপি হয়ে টিকে আছি। স্পেশালিষ্ট না হলে ভবিষ্যতে এ লাইনে আর খেয়ে থাকা যাবেনা! আর আর্কিটেক্টদের কথা বলে লাভ নেই!
পৃথিবী কতটা বদলে যাচ্ছে চিন্তা করে দেখুন! ফরাসী বিপ্লবে তিনটি স্লোগান ছিল, - লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, আর ফ্রাটারনিটি। এই ফ্রাটারনিটি অর্থাৎ বন্ধুত্ব বা ফেলোশিপ নিয়ে আজকাল আর কেউ কথা বলেনা। সেই ছোট বেলায় আমরা শুনেছি, চিন পাকিস্তান ভাই ভাই, আরব জাহান ভাই ভাই। এখন আর এমন কথা কেউ বলেনা। এখন একটা দেশের সাথে আরেকটা দেশের সম্পর্ক হচ্ছে প্রতিযোগিতা , অথবা বিজনেস পার্টনার। চোখে পরার মতো খবর চিনের লোকদের ক্রয় ক্ষমতা কিছুদিনের মধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে! পৃথিবীর অন্য দেশগুলো ও বসে নেই। বাংলাদেশে লিপস্টিক আর শ্যাম্পুর চাহিদা গত পাঁচ বছরে তিনগুণ বেড়েছে। আগে এসব বস্তু বড়লোকদের থলথলে বউ আর তাদের ন্যাকা ন্যাকা মেয়েদের একচেটিয়া অধিকারে ছিল। এখন আমাদের গার্মেন্টসের মেয়েরাও এসব ব্যাবহার করছে।
এইযে পরিবর্তনের একটা জোয়ার চলছে এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। আশার কথা বাংলাদেশের মত নবীন দেশও নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির হার সাত পার্সেন্ট ক্রস করবে। সন্তানেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াচ্ছে দেখে এতদিন যারা আমাদের মা-বাবা ছিলেন তা‘রা ব্যাপারটা কিভাবে নেবে সেটাই দেখার বিষয়! মনে রাখতে হবে তোমার সঙ্গে হয়তো কেউ হাঁটবে, তবে তোমার জন্য কেউ হাঁটবে না!
মহাত্মা গান্ধীকে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক একবার প্রশ্ন করে ছিলেন, আচ্ছা মিঃ গান্ধী ব্রিটিশদের মত স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং ভারতবাসীদের কবে হবে? গান্ধীজী একটা চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের একটা প্রভিন্সের জনসংখ্যা তোমাদের সমস্ত দেশের জনসংখ্যার চাইতে বেশি। তোমাদের এতটুকু দেশবাসীর স্ট্যান্ডার্ড বাড়াতে একশো বছর সারা গ্লোবটাকে শোষণ করতে হয়েছে। আর আমাদের যা জনসংখ্যা তার স্ট্যান্ডার্ড তোমাদের মত করতে কত বছর কত গুলো পৃথিবী শোষণ করতে হবে ভেবে দেখেছ?
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেবের কথা বার্তা বা কাজ কারবার দেখে বোঝাই যাচ্ছেনা কে তার বন্ধু আর কে তার শত্রু । আমি আগেই বলেছি আজকাল দেশে দেশে বন্ধুত্ব হয়না। রাশিয়ার সাথে ট্রাম্পের বন্ধুত্ব হবে কিনা তার চাইতে অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে পৃথিবীর মানুষ অপেক্ষা করছে চিন আর আমেরিকার সম্পর্ক কেমন হবে সেটা দেখতে। কেউ কারো বন্ধু নয়, এ কেমন কথা এ কেমন দেশ? বুঝেছ উপেন এ জমি লইব কিনে। কথা হচ্ছে এখন উপেনরা যাইবে কোথায়? কি করিবে?
ইতিহাস বলছে পৃথিবীতে বড় রকমের কোন পরিবর্তন আজ পর্যন্ত কোনো দেশের রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধান আনেন নি। এনেছে সাধারণ মানুষেরা। এটা বড় আশার কথা। যদিও দুনিয়ার সব বাঘা বাঘা চিন্তাবিদরা বলছেন এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয়, তবে আমি আপনাদের দুটো আনন্দ সংবাদ দিচ্ছি।
প্রথমটা হচ্ছে ইনফরমেশন টেকনোলজির বিশাল উন্নতি। হ্যাঁ মানলাম বিজ্ঞানের উন্নতি আমাদের অনেক চাকুরী খেয়ে দিচ্ছে তবে আমাদের দিচ্ছে জীবন ধারণের এক নূতন মানে। চিকিৎসা, যোগাযোগ, জ্ঞান, সুযোগ সুবিধা, চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে এনেছে এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনা। মানুষ আরো অনেকদিন বেশি বেঁচে থাকছে। সবচাইতে বড় কথা এই মহা যজ্ঞে যার কাছে একটি মোবাইল আছে সেই অংশ গ্রহণ করতে পারছে। জাত, ধর্ম, বর্ণ, দেশ নির্বিশেষে। আপনি, আমি, গোপালগঞ্জের রিকশাওয়ালা সবাই। জগতে আনন্দ-যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ হে। কথাটা এমন ভাবে সত্যি এর আগে কখন হয়নি।
অন্য ভাল খবরটি হচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। এরা আমাদের মত চিন্তা ভাবনা নিয়ে বড় হচ্ছে না। এই নব তরুণ সমাজ কোন দেশের মধ্যে বাঁধা পরে নেই। এরা বাংলাদেশর ,কম্বোডিয়ার অথবা আমেরিকার তরুণ হিসাবে পরিচিত নয়। গতবছর বাংলাদেশে ২০ বছরের শুভ আমার সাথে যেসব কথা বলছিল ওর সাথে একজন অস্ট্রেলিয়ায় বড় হওয়া তরুণের কোন পার্থক্য আমি খুঁজে পাইনি। আমাদের যুবক বয়সে প্রধান লক্ষ ছিল কি করে বেশি পয়সা উপার্জন করা যায়। আমাদের গুরুজনরা বলতেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হও, টাকাই টাকা। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কিন্তু সেকথা বলছে না। ওরা বলছে, নতুন কিছু করে দেখাতে হবে। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, জন্মেছিস যখন এই পৃথিবীর বুকে একটা দাগ রেখে যা!
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|