এক বিশপের দেড়শত বিবি আশীষ বাবলু
ক্যানবেরা সরকারের মাথায় হাত! ডারউইনের উত্তরে ব্যাথার্ষ্ট আইল্যান্ডে একজন ফরাসী ভদ্রলোক এ্যাবরিজিনাল মেয়েদের বিয়ে করার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। জানা গেল তিনটে চারটে নয়, এ পর্যন্ত তা’র স্ত্রীর সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়েছে। ক্যানবেরা খবর নিয়ে আরো জানল এই ভদ্রলোক যেমন তেমন লোক নয় ব্যাথার্ষ্ট আইল্যান্ডের খৃস্টান মিশনের পরিচালক। ছি! ছি! ছি! ১৫০টি বিয়ে! ক্যানবেরা আর ডারউইনের টেলিগ্রাফ লাইনে টরে টক্কা আর থামেনা। বিয়ে পাগল লোকটিকে মাথায় ঘোল ঢেলে গাধার পিঠে চড়িয়ে উপযুক্ত স্বাস্তি দেওয়া উচিত। আরো খবর এসেছে, সেই লম্পট লোকটা নাকি কিছুদিন হলো একটি আট মাসের মেয়েকে বিয়ে করেছে! তা’র চাইতেও বড় খবর সেই ফরাসী একজন ক্যাথলিক প্রিস্ট! লজ্জা লজ্জা লজ্জা। ক্যানবেরা নিশ্চিত ঐ বিয়ে সাদির ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভাবে ভুয়া, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে সেক্স ট্রেড!
আমি যে সময়টার কথা লিখছি সেটা ১৯১১ সালের কথা। তখন আজকের মত যোগাযোগ বা যাতায়াত ব্যবস্থা ছিলনা। তবে এসব খবর পৌছাতে টেকনোলজির দরকার হয়না, হাওয়ায় ওড়ে। সেই খবর গিয়ে পৌঁছাল রোমে, ভ্যাটিকানে, স্বয়ং পোপের কাছে। খবরটা শুনে পোপেরতো পিলে চমকে গেল। পই পই করে খাতা খুলে দেখলেন, হ্যাঁ, ফ্রান্সিস জিসেলকে (Francis Gsell) তা’রাই পাঠিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। জিসেলের জন্ম ১৮৭২ সালে ফ্রান্সে। তারপর চলে আসেন রোমে। ১৮৯৬ সালে তাকে প্রিষ্টের সম্মান দেওয়া হয়, এবং মিশনারি কাজের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হয়। একটা সৎ কাজের জন্য তাকে পাঠানো হলো আর তিনি কিনা সেখানে ১৫০ খানা বিয়ে করে বসে আছেন! ব্যাটাচ্ছেলে করেছে কি!
মহামান্য পোপ তলব করলেন ফাদার ফ্রান্সিস জিসেলকে। কারণ দর্শাও। জবাবদিহি দিতে হবে। সাত সমুদ্র পেড়িয়ে জিসেল গেলেন পোপের কাছে, ভ্যাটিকানে। তিনি যে ঘটনা পোপকে বললেন সেটাই হলো গল্প।
অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম কোনে ডারউইন পেড়িয়ে ব্যাথার্ষ্ট আইল্যান্ড। সেই আইল্যান্ডের লোকদের বলা হতো টিউই (Tiwi). সেইখানে নিয়ম হচ্ছে এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। মেয়ের মা-বাবা ঠিক করতেন কার সাথে মেয়ের বিয়ে হবে। একদিন মার্টিনা নামে ১৫/১৬ বছরের একটি মেয়ে ফাদার ফ্রান্সিসের কাছে হাজির, কাঁদো কাঁদো ভাবে বললো ওর বাবা মা এক বৃদ্ধের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছে। এ বিয়েতে ওর একদমই মত নেই। ফাদার জিসেল যেন তাকে এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্টিনার নেশাখোর বৃদ্ধ হবু স্বামীটি সেখানে হাজির হলেন। কাউকে তোয়াক্কা না করে মার্টিনার চুলের গোছা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। ফাদার জিসেলের চোখের সামনে ঘটে গেল সেই বীভৎস এবং করুন দৃশ্য অথচ তিনি কিছুই করতে পারলেন না, কেননা এটাই হচ্ছে এই আইল্যান্ডের মানুষদের স্বাভাবিক কর্ম। সামাজিক নিয়মের উপর মাথা ঘামানো অন্যায় হবে ভেবে ফাদার ফ্রান্সিস মেয়েটির চোখের জলে ভেজা অনুরোধ রাখতে পারলেন না।
কিছুদিন পর মেয়েটি অর্থাৎ মার্টিনা আবার এসে হাজির। এবার তা’র পায়ে একটা তীর বিদ্ধ, দরদর করে রক্ত ঝরছে। ফাদার ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি তীরটি খুলে চিকিৎসা শুরু করে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যে মার্টিনা সুস্থ হলো। জানতে পারলেন বিয়ের আসর থেকে সে পালিয়েছে। ওরা ইট, পাথর, তীর ছুড়েছিল তা’কে লক্ষ করে। এ যাত্রায় মেয়েটির মা-বাবা এলেন তাকে নিয়ে যেতে। ফাদার বললেন, তোমাদের মেয়ে অবশ্যই নিয়ে যাবে, তবে আমার একটা অনুরোধ ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে বিয়ে দিওনা।
মার্টিনার বাবা-মা ফাদারকে বললেন, তুমি যদি চাও মার্টিনাকে কিনে নিতে পার। এবার বোধগম্য হলো বিয়ে করতে হলে ছেলেদের টাকা দিয়ে মেয়েকে কিনতে হয়। ফাদার সামান্য টাকার বিনিময়ে মার্টিনাকে কিনলেন এবং মিশনারিতে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করলেন। এই খবরটা খুব অল্প দিনের মধ্যেই সমস্ত আইল্যান্ডে ছড়িয়ে গেল। বিভিন্ন মা-বাবারা তাদের মেয়ে বিক্রি করতে ফাদারের কাছে হাজির হতে লাগলেন। সেই ভিড়ের মধ্য ৮/৯ বছরের মেয়েরাতো ছিলই ৯ মাসের মেয়েকেও মা-বাবা হাজির করতো বিক্রির জন্য। ফাদার তা’দের কিনে রাখতেন আর মিশনারিতে লেখাপড়া থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন। আঠারো বছর বয়স হলে মেয়েরা নিজের ইচ্ছে মত বিয়ে করার সুযোগ পেত। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেই মিশনারিতে মেয়ের সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়ে গেল। যেহেতু ফাদার ফ্রান্সিস মেয়েদের কিনেছেন তাই এই সমাজের নিয়ম অনুসারে ১৫০ জন মেয়ে হচ্ছে ফাদার ফ্রান্সিসের স্ত্রী!
স্বয়ং ফ্রান্সিস জিসেলের মুখে এই কাহিনী শুনে মহামান্য পোপের প্রাণে পানি এলো। কী কেলেঙ্কারি কাণ্ডই না তিনি মিছি মিছি ভেবে বসেছিলেন! পোপ বললেন, যাও ফ্রান্সিস, অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাও এবং তোমার মহান কর্মে মননিবেশ কর।
ফাদার ফ্রান্সিস জিসেল ফিরে এলেন ব্যাথার্ষ্ট আইল্যান্ডে তা’র মিশনারিতে। ২৮ বছর তিনি সেই মিশনে কাজ করেছেন। ফাদার সম্মান করতেন সেই আইল্যান্ডের মানুষদের সামাজিক আচার, নিয়ম কানুন, সংস্কৃতি। কোনদিন খ্রিষ্টানিটি ওদের মধ্যে প্রচার করার চেষ্টা করেননি। আশ্চর্য হবার কথা তা’র ৩০ বছর সেই মিশন চালাবার সময়ে একজন আদিবাসীকেও তিনি খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করেন নি। অথচ আজ ব্যাথার্ষ্ট আইল্যান্ডের ৯৯ভাগ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে খ্রিষ্টান।
ফাদার ফ্রান্সিস জিসেল ১৯৬০ সালে ৮৮ বছর বয়সে আমাদের সিডনির ক্যানসিনটনে মারা যান। এখনও ব্যাথার্ষ্ট আইল্যান্ডের মানুষদের কাছে তিনি পরিচিত, দ্যা বিশপ উইথ হান্ড্রেড ফিফাটি ওয়াইভস। এক বিশপের দেড়শত বিবি।
আশীষ বাবলু, সিডনি - ashisbablu13@yahoo.com.au
|