একজন বাংলা প্রেমীর কথা আশীষ বাবলু
কিছুদিন আগে আমার হাতে একটা বই এসেছে। বইটি পড়তে পড়তে খুবই আশ্চর্য হয়েছি। বাংলা ভাষা নিয়ে এমন সুন্দর লেখা! লেখকের নাম পরিচিত মনে হচ্ছেনা! এই বই এবং তার লেখককে নিয়ে লেখার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গ লিখছি।
আচ্ছা বাংলা ভাষা কি আমাদের শেখার দরকার আছে? না শিখলে আমাদের কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? বাংলা ভাষা শিখে খুব বেশি হলে আমরা যারা প্রবাসী তারা দেশে গিয়ে আত্মীয় স্বজনদের সাথে বাংলায় কথা বলতে পারবো এইতো? বাংলা ভাষা না শিখলে টাকা পয়সা রোজগারের কোন অসুবিধা নেই, বরং শুধু মাত্র বাংলা ভাষা শিখলে না খেয়ে মরার সম্ভাবনা আছে!
আমার লেখার এইটুকু পড়ে অনেকেই ভাবছেন কি আবোল তাবোল লিখছি! কিছুদিন আগে এক ভদ্রলোক আমাকে উপরোক্ত উপদেশ দিয়েছেন। তিনি ইংরেজিতে একটা বইও লিখেছেন। সারাদিন ভেবেছি আমাদের ভাষাটি কি এতই উপেক্ষিত!
একটা সময় ছিল যখন বাঙ্গালী সংস্কৃত শিখতো, ফারসি শিখতো। কারণ ছিল সেই ভাষাতে সাহিত্য ছিল উন্নতমানের। খুব বেশি দিনের কথা নয় যখন বঙ্কিম-চন্দ্র ‘কপাল কুন্ডলা’ লিখেছেন, ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ লিখেছেন, তখন বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য সৃষ্টি করা যেতে পারে তা মানুষ কল্পনাও করেনি। তখন মানুষ জানতো বাংলা ভাষা দিয়ে জমির দলিল লেখা যায়, বিধবা বিবাহ রোধ করার বিজ্ঞপ্তি লেখা যায়।
বাংলা ভাষায় একজন সুন্দরী মহিলার হৃদয়ে সাড়া জাগানো প্রেম নিবেদন করা যায়না। ব্যর্থ প্রেমিক তার বুকের আকুলি বিকুলি, কষ্ট, বাংলায় প্রকাশ করতে পারতেন না। কী ভয়াবহ অবস্থা ভেবে দেখেছেন। বঙ্কিম-চন্দ্র বাংলা ভাষায় লেখার আগে ইংরেজিতে কয়েক খানা উপন্যাস লিখেছেন। তার পর ঠিক করলেন না, বাংলায় নতুন শব্দ তৈরি করবো এবং বাংলাতেই লিখবো। এরপর মাইকেল মধুসুদন এলেন, তিনি ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা শুরু করলেন, তার পর একদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি ঠিক করলেন আর ইংরেজি নয়। বন্ধুদের বললেন তিনি বাংলায় লিখবেন। এবং এ্যাপিক মানে মহাকাব্য লিখবেন! বন্ধুরা হৈ হৈ করে উঠলো, বাংলায় সম্পূর্ণ এক পাতা কবিতা লেখা যায়না আর তিনি লিখবেন মহাকাব্য! আজ আমরা জানি যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন থাকবে মেঘনাদ-বধ কাব্য!
ইংরেজিতে অনেক বাঙ্গালীই ইদানীং সাহিত্য চর্চা করছেন। বই লিখছেন, এবং তাদের বই বেষ্ট সেলারও হচ্ছে। তবে এদের সাথে বঙ্কিম বা মাইকেলের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। যেসব বাঙ্গালী ইংরেজিতে কবিতা গল্প লিখে নাম করছেন তাদের কিন্তু মাতৃভাষায় লিখবার প্রতিভা বা ক্ষমতা নেই। এমন বাঙ্গালী খুব কমই পাওয়া যাবে যে দুটো ভাষাতেই সমান দক্ষ! মাইকেল এবং বঙ্কিমের কিন্তু সেই ক্ষমতা ছিল।
আমি লেখাটি শুরু করেছিলাম একটি বই নিয়ে। বইটির লেখক বাঙ্গালী নয়। তবে তিনি বাংলা এবং ইংরেজি দুটো ভাষাতেই সমান দক্ষ। ভদ্রলোকের নাম ক্লিনটন বি সিলি। জন্ম ১৯৪১। আমেরিকায়। যে বইটির আমি পড়ছিলাম তার নাম, বরিশাল এন্ড বিয়ন্ড। ভদ্রলোকের নামটি আমি ইন্টারনেটে টাইপ করলাম। গুগল আমাকে জানালো ক্লিনটন বি সিলি বাংলা ভাষায় পণ্ডিত! বলে কি? ভাবলাম নাম দেখ অনেক কিছুই আজকাল বোঝা যায়না। নিশ্চয়ই পিতামাতা কেউ বাঙ্গালী? না! তার চোদ্দ পুরুষ কেউ বাঙ্গালী নয়!
স্টান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বায়োলজিতে লেখাপড়া করেছেন ক্লিনটন বি সিলি। ১৯৬৩ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন তখনকার ইষ্ট-পাকিস্তান মানে বর্তমান বাংলাদেশে। বরিশালের মাটি, সবুজ পরিবেশ, মানুষজন, ভাল লেগে গেল। তিনি বরিশাল জেলা স্কুলে বায়োলজি পড়াতে শুরু করলেন। সেখানেই শুরু হলো বাংলা ভাষা শিক্ষা। তিনি লিখছেন আমি একদিন ক্লাস নিচ্ছি তখন খবর এলো জন এফ কেনেডিকে হত্যা করা হয়েছে। আমি আমেরিকান তাই সবাই আমাকে ছেকে ধরল কি হয়েছে? এখন কি হবে? আমাকে উদ্ধার করলেন ইউ এস আই এস এর বরিশাল শাখার পরিচালক, গোলাম কিবরিয়া। উনি ছিলেন বিদ্বান এবং অতি সজ্জন একজন মানুষ।
প্রয় দুই বছর বরিশালে থেকে তিনি ফিরে গেলেন আমেরিকায়। বাংলার মানুষ আর ভাষাটিকে তিনি ভুলতে পারছিলেন না। তিনি শিকাগোর ইউনিভার্সিটিতে ডিপার্টমেন্ট অফ সাউথ ইন্ডিয়ান ল্যাংগুয়েজ এন্ড সিভিলাইজেশন থেকে মাস্টার ডিগ্রি করলেন। এটা ছিল ৬৮/৬৯ এর কথা।
১৯৭০ সালে যখন সেই বিশাল সাইক্লোন হোল বাংলাদেশে, ফোর্ড ফাউন্ডেশন জানালো তাকে আবার ইস্ট-পাকিস্তান যেতে হবে। তিনি সুটকেস গুছিয়ে ফেললেন। সব ঠিক ঠাক। হঠাৎ খবর এলো যে ইয়াহিয়া খান জানিয়েছেন সেখানে কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই! সব ঠিক আছে কোন রিলিফ ওয়ার্কসের দরকার নেই! তাই তার প্রিয় বরিশালে আসা হলোনা!
একদিন আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটির লেখক ওয়ার্কশপে তার সাথে দেখা হলো জোতিন্ময় দত্তের সাথে। জোতিন্ময় দত্ত একজন ডাকসাইটে সাংবাদিক এবং লেখক, বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে মীনাক্ষীকে বিয়ে করেছেন। তিনি মি ক্লিনটনকে বললেন তুমি বরিশালে এতদিন থেকে এসেছো, তুমি কী জানো সেখানে বাংলার এক নাম করা কবি জন্মে ছিলেন? জোতিন্ময় দত্ত জীবনানন্দের একটি কবিতার বই ক্লিনটনকে উপহার দিলেন। রাত-জেগে তিনি বইটি পড়লেন, তার খুব ভাল-লেগে গেল এবং কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে জোতিন্ময় দত্তকে দেখালেন। জোতিন্ময় দত্ত খুব খুশি হয়ে তার কানে কানে বললেন , তুমি জীবনানন্দ দাশের উপর পিএইচডি কর।
কোমর বেধে কাজে নেমে গেলেন ক্লিনটন বি সিলি। চলে এলো ইস্ট পাকিস্তানে। সেটা ছিল ১৯৭১ এর বাংলাদেশ, সেখানে বেশিদিন থাকা হলো না। কলকাতার পাবলিক লাইব্রেরীতে ডুবে গেলেন জীবনানন্দে। রিসার্চ আর রিসার্চ। যে ট্রাম জীবনানন্দের জীবন কেড়ে নিয়েছিল তার লাইনে দাড়িয়ে তিনি অনুভব করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কম্পন।
তার পর শিকাগোতে ফিরে ১৯৭৬ সালে শেষ করলেন তার পিএইচডি থিসিস। লাইফ এন্ড ওয়ার্কস অফ জীবনানন্দ। তারপর একে একে বাংলা সাহিত্য নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি। বুদ্ধদেব বসুর সারা জাগানো বিতর্কিত উপন্যাস ‘রাতভর বৃষ্টি’ ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। মাইকেলের মেঘনাদ-বধ কাব্যের অনুবাদ তিনি এখনো করে যাচ্ছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তার রয়েছে অসংখ্য বই। শুধু লিখেই শেষ নয় তিনি কম্পিউটারে বাংলা লেখার উপর ও অনেক অবদান রেখেছেন।
আমার মায়ের এই ভাষাটিকে অনেকে যেমন উপেক্ষা করছেন ঠিক তেমনি ক্লিনটন বি সিলির মতো অনেক অবাঙ্গালী মানুষ ভালবেসে বুকে টেনে নিচ্ছেন। মায়ের যাই হোক না কেন সন্তানহারা হবার সম্ভাবনা নেই। আজ আমার এই লেখাটি ক্লিনটন বি সিলিকে উৎসর্গ করলাম।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|