অধ্যাপক বদরুল আলম খানের লেখা ‘সংঘাতময় বাংলাদেশ’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে এই ফেব্রুয়ারি মাসে। সেদিন সকালবেলা ব্রেকফাস্ট টেবিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বইটির পাতা উল্টাচ্ছিলাম। এক পাতা দুই পাতা করে কখন ত্রিশ পাতায় চলে এসেছি খেয়াল করিনি। ঘড়িতে দেখি নয়টা। অপিসে যাবার সময় পার হয়ে গেছে। ঠিক করলাম অসময়ে অপিসে না গিয়ে বরং বইটি পড়ে শেষ করি। একটি বই পড়ার জন্য একদিন অপিস কামাই!
প্রথমে বলি বইটি বড় স্বচ্ছন্দে পড়া যায়। অধ্যাপক প্রচুর খাটা খাটুনি করে বইটি লিখেছেন। গবেষণার তথ্যকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করার চেষ্টা করেছেন। যুক্তি তর্ক থেকে অনেক সময় গল্প তৈরি হয়। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন গল্প পরিহার করার জন্য।
আমাদের দেশের বর্তমান সংঘাত এবং মানসিকতার ঐতিহাসিক পটভূমির থেকে বইটি শুরু করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘জাতির ভবিষ্যৎ বিকাশের প্রশ্নটি কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকেই ভাবা সংগত নয়। যেহেতু তার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, বলতে গেলে সবই।'
দেশের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য দিকগুলি এখানে নিদারুণ ভাবে উপেক্ষিত। পরিসর সংকট যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে শাসকের নির্লজ্জ লালসা নদী, জল, মাটি, ফসল, আকাশ, ভূখণ্ড, কুক্ষিগত করার নানা বিধ ষড়যন্ত্র ততই অতিমাত্রায় কদর্য রূপ ধারণ করছে।’ তিনি দুঃখ করে বলেছেন ‘ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও আমরা ঠিক করতে পারলামনা যে দেশটা আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র হবে না আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে।’ তিনি লিখেছেন ‘মৌলবাদী ইসলামের সঙ্গে বাঙ্গালী মননের দ্বন্দ্বই বস্তুত এখানে সাংস্কৃতিক জগতের দ্বন্দ্ব।’
রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলেছেন, - মানুষের সর্বত্র অধিকার বাণিজ্যে, মানুষের সর্বত্র অধিকার বিদ্যায়, কেবল ধর্মেই মানুষ এমন চিরন্তন রূপে বিভক্ত যে সেখানে পরস্পরের মধ্যে যাতায়াতের কোন পথই নেই।
অধ্যাপক খান লিখেছেন, মৌলবাদী ইসলাম বিরোধী শক্তি হিসেবে বাংলা সংস্কৃতিকে দেখে। তাদের কাছে বাংলা সংস্কৃতি ও হিন্দু সংস্কৃতি প্রায় একই ব্যাপার। তাই বাংলাদেশের সংস্কৃতির শেকড় থেকে বাঙ্গালী জাতি এবং সেই জাতীর মিশ্র ধর্মীয় চেতনাকে বিচ্ছিন্ন না করে এখানে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন।’
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। তিনি লিখেছেন, ‘সোনার বাংলা নামে সেই ইউটোপিয়া এক সময় সমগ্র জাতীকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশর জন্ম দিয়েছিল। ঐ সংহতির মূলে ছিল আধুনিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন। বাংলার মানুষ উপলব্ধি করেছিল যে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের চেয়ে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শোষণ মুক্ত সমাজের গুরুত্ব তাদের জীবনে অনেক বেশি।’
আমার মনে হয় একটা ব্যাপার আমাদের বুঝতে হবে দেশের নামের আগে যদি ধর্ম এসে যায় তখন সেটাকে আর গণতান্ত্রিক দেশ বলা চলেনা। আমি এখানে অনেক আড্ডায় বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের বলতে শুনেছি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মই সে দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হওয়া উচিত। একটা কথা বুঝতে হবে কোন আইন অথবা সিদ্ধান্তের পেছনে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেই সেটা গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হয়না। আপনারা বলতে পারেন কেন হবেনা? গণতন্ত্রের অর্থই হলো অধিকাংশ মানুষের সিদ্ধান্ত?
হিটলারের পেছনে ছিল অধিকাংশ জার্মানদের সমর্থন। তবে কি ইহুদিদের নিধনের সিদ্ধান্তকে গণতান্ত্রিক বলা যায়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ মানুষ যদি সংখ্যালঘু কালো মানুষদের বিরুদ্ধে কোথাও অপমানজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে কি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে সেটাকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে? এই অস্ট্রেলিয়ায় যখন হোয়াইট অস্ট্রেলিয়ান পলিসি ছিল, সেটাকি গণতান্ত্রিক ভাবে সঠিক ছিল? না সঠিক ছিল না। তাই সত্যিকার গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ছাড়া যেমন কোনো সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনা তেমনই আবার মানবাধিকার সংক্রান্ত কিছু মূল শর্ত ভঙ্গ করেও কোন ব্যবস্থা গণতন্ত্রে মর্যাদা পেতে পারেনা।
বইটিতে লেখক বদরুল রহমান খান দেশে জাতীয় আদর্শের আরেকটি স্তম্ভ জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভুলগুলি পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন জাতীয়তাবাদের দুই বিপরীতমুখী স্ত্রোতধারা লক্ষ করা যায়। কেননা এই জাতীয়তাবাদ আন্দোলন চালু রাখার জন্য নেতাদের দিতে হয় অন্ন, বস্ত্র,শিক্ষা,বাসস্থানের নিরাপত্তা দেবার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন দেখা গেল এইসব প্রতিশ্রুতি পালনের উপযুক্ত কৌশল বা জ্ঞান নেতাদের অজানা। মঞ্চে বক্তৃতা আর সঠিক পথে দেশ চালানো এক কথা নয়।
রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটা বেশ ভয় পেতেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি মনুষ্যত্বকে বরণ করে নিয়েছি,আমি হীরের মূল্যে কাচ কিনব না, উগ্র দেশপ্রেম যে মনুষ্যত্বকে লঙ্ঘন করবে, এ তো আমি আমার জীবনে ঘটতে দিতে পারব না।’ এ বিষয়ে তার ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে অনেক কথা আছে। উপন্যাসটি পড়ে নাট্যকার বের্টোলেট ব্রেখট লিখেছিলেন, ‘জাতীয়তাবাদের বিপথগামীতা সম্পর্কে উপন্যাসটি এক বলিষ্ঠ ও মৃদুভাষী সাবধান বাণী শুনিয়ে যায় যে, জাতীয়তাবাদ বিপথগামী হলে সকলের প্রতি সুবিচার করে না। একটি গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা থেকে অন্য সব গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণার জন্ম দিতে পারে।’
আমাদের দেশে ঠিক এটাই হয়েছে। দেশে জাতীয়তাবোধ যতই তীব্র হচ্ছে দেশপ্রেম তত কম চোখে পরে। ৭১এর স্বাধীনতার অর্থ এখন মনে হয় অনেকের কাছেই ছিল পাকিস্তানের কাছ থেকে ধনোর্পাজনের সুযোগ ছিনিয়ে নিয়ে ধনী হবার সুযোগ নেওয়া।
বইটিতে বদরুল আলম খান লিখেছেন, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থতা, স্বৈরতন্ত্রিক দাপট, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, নিরাপত্তাহীনতা, জাতীয়তাবাদের ভাবমূর্তিকে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে।
এখানে অবশ্যই পাল্টা যুক্তি আসবে যে একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে হুট করে জনগণের ইচ্ছা পূরণ সম্ভব নয়। তবে শাসক গোষ্ঠীর আর একটু চোখ কান খোলা রাখার দরকার ছিল বলে আমিও লেখকের মত বিশ্বাস করি।
অধ্যাপক খান লিখেছেন, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরে একটি প্রচ্ছন্ন শক্তি লুকিয়ে ছিল যা ধীরে ধীরে ফ্রাকেনষ্টাইনের মাতো বৃদ্ধি পেতে পেতে তার জন্মদাতাকেই বিনাশ করে বসল। সেই প্রচ্ছন্ন শক্তি হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতির প্রবল উত্থান।
তিনি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ নির্মাণের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে মানুষের জীবনযাত্রার মান কিছুটা আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত না করে কোনো সমাজে জাতীয়তাবাদী চিন্তা বিকশিত হতে পারেনা। তিনি বেশ সুন্দর কথাটি বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদ কোন বস্তু নয়, সেটি মূলত একটি চেতনা, যে চেতনা বিকাশে শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ১৯৭৫ এর পহেলা মার্চ যখন ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন তখন জনগণ রাস্তায় নামলো স্বাধীনতার দাবিতে। স্বাধীনতার প্রশ্নটি এইভাবে আওয়ামী লিগের সামনে এসে যাবে তা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতায় ছিলনা। সেই সঙ্গে নয় মাসের মত অল্প সময়ে স্বাধীনতা লাভও আওয়ামী লিগের কাছে অকল্পনীয় ছিল।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে মুজিবের ধরা দেওয়ার প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন, ‘বন্দী হওয়ার কাড়নে তিনি মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে থাকেন। ওই যুদ্ধের সংগঠনে তার কোন ভূমিকা ছিলনা।’
তবে অনেকে মনে করে মুজিব পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তিনি মুজিব হতেন না, হতেন বিচ্ছিন্নতাবাদী। আমরা হারাতাম এক বিশাল ভাবপ্রতিমা। বন্দী মুজিব ছিলেন অনেক শক্তিশালী ও প্রেরণাদায়ক। তার উত্তরে বলা যায়, দেশ যদি নয় মাসে না হয়ে নয় বছরে স্বাধীনতা পেত তবে ঐ ভাবপ্রতিমা কতদিন মানুষকে প্রেরণা দিত? আমারাতো দেখেছি স্বাধীনতার ঠিক পাঁচ বছরের মাথায় দেশের জনগণ দ্রুত মুজিবের উপর আস্থা হারাচ্ছিল।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ মাত্র নয় মাসে সংগঠিত হলেও অনেক ত্যাগ অনেক বীর-গাঁথা এই সময়টাতে, বইটিতে সেই দুঃখ সুখের দিনগুলো নিয়ে আরো কিছু পৃষ্ঠা ব্যয় করলে লেখকের চোখে মুক্তি যুদ্ধের দিনগুলোর স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ হতো আমাদের।
২৫ শে জানুয়ারি ১৯৭৫ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ব্যর্থতার দিন। চতুর্থ সংশোধনী বিলটি এনে বাংলা দেশের মহান সংবিধানটি হত্যা করা হয়।
অধ্যাপক বদরুল রহমান লিখেছেন,‘যখন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা জারি হয় তখন আওয়ামী লিগের জাতীয় পরিষদে সদস্য সংখ্যা ৩০০ এর মধ্যে ২৯৩ জন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, তবুও দেশ শাসন করতে বাকশাল করার প্রয়োজন হলো? এটি একটি অদ্ভুত রাজনৈতিক ষ্ট্রাটিজি বললে ভুল হবেনা।’
‘আমাদের সংবিধানে ছিল দু’বারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি হতে পারবেনা। চতুর্থ সংশোধনীতে তা লোপ করা হয়। যতবার খুশি ততবার রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। মুজিব বেঁচে আছেন অথচ অন্য কেউ রাষ্ট্রপতি হবে, তা দলের কিছু অতি ভক্ত মুজিব পূজারীদের কাছে গ্রহণ যোগ্য ছিলনা। সেই দায়ভার আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ বহন করছে।’
এখন কোন রাষ্ট্রপ্রধানকে গদি থেকে নামাবার জন্য রাস্তায় নেমে বাংলার মানুষকে বুকের রক্ত দিতে হচ্ছে। অধ্যাপক লিখেছেন, ‘অথচ দেশে গণতান্ত্রিক এবং সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য ঐ সময়টা উপযুক্ত ছিল। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের উপস্থিতি। ঐ নগণ্য সংখ্যক বিরোধী দলিয় সদস্যকে স্বীকৃতি দিয়ে গড়ে তোলা যেত গণতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত। ...অথচ বাকশাল নামে একদলীয় শাসন কাঠামো সৃষ্টি করে বিরোধী শক্তির সীমিত বিকাশকেও সে সময় প্রতিহত করা হয়। একটি মুকুলিত গণতন্ত্রের বিকাশের পথকে সেদিন রুদ্ধ করা হয়েছিল।’
এই প্রসঙ্গে তিনি খুব সুন্দর একটা কথা বলেছেন যে,‘রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা অর্জন হয় বিরোধী দল বা জনগণের কাছে জবাবদিহি দিয়ে। বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনীতির বা সমাজের যে করুন বাস্তবতা বর্তমানে আমাদের প্রতিদিন যুঝতে হচ্ছে তার শেকড় খুঁজতে হবে কিয়দংশ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের রাজনীতিতে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকা অন্যদিকে টার্ন নিল। শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। জুলিয়াস সিজার যেদিন সম্রাট হয়ে মুকুট পরেছিলেন ঠিক তার পরের দিন তিনি নিহত হয়ে ছিলেন। তা’র ঘাতকরা ছিল গণতন্ত্রের আদর্শবাদী। আমাদের দুর্ভাগ্য মুজিবের ঘাতকরা ছিল আপাদমস্তক নির্মম ঘাতক। কোন আদর্শের ছোয়া তাদের চরিত্রে ছিলনা।
এই পট পরিবর্তনের পর দেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে দেখতে লাগলো মুখোসের আড়ালে কিছু মানুষের সত্যিকার চরিত্র। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র নিয়ে গালভরা বুলি যারা এতদিন বলে এসেছেন তাদের চেহারা গুলো মানুষের কাছে পরিষ্কার হলো। অমানবিক চরিত্রের আমি দুটো উদাহরণ দিচ্ছি, ওসমানী যিনি বাংলার মানুষের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি কাল বিলম্ব না করে মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হলেন। আর ভাসানী যাকে মুজিব পিতার মত সম্মান করে গেছেন, সেই পুত্রসম মুজিবের বিশাল লাশটি যখন পড়েছিল ৩২নম্বর বাড়ীর সিঁড়িতে তখন মজদুর জননেতা ভাসানী মোশতাক সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে আল্লার কাছে মোনাজাত করেছিলেন। হায় দুখিনী বাংলা!
অধ্যাপক জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সফল কমান্ডার হওয়া সত্যেও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা গণহত্যা, ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল তাদের তিনি রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসালেন। কোর্ট মার্শালের সাজা দিয়ে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, অথচ কর্নেল তাহের তার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন। জিয়াউর রহমানকে লেখক বাংলাদেশের সব চাইতে সুবিধাবাদী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। চার জাতীয় নেতাকে জেল হত্যার চক্রান্ত তার অজান্তে হবার কথা নয়। তার শাসন কালে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়। যারা সবাই ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য।’
এখানে উল্লেখ করা যায় যে অনেকে মনে করেন জেলে চার নেতাকে হত্যা শেখ মুজিব হত্যারই ধারাবাহিকতা। তবে এর মধ্যে একটা কিন্তু আছে। যে ঘাতকদের সাত বছরের রাসেলকে হত্যা করতে হাত কাঁপেনি তারা চার নেতাকে হত্যা না করে জেলে পুরেছিল কেন? এবং পরবর্তী পর্যায়ে এমন কী কারণ ঘটল যে তাদের হত্যার প্রয়োজন হয়ে পড়লো? অধ্যাপক যদি এই ঘটনাটির উপর একটু আলোকপাত করতেন তবে এই নির্মম এবং অবহেলিত ব্যাপারটির একটু সত্যানুসন্ধানের সুযোগ পেতাম।
রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করার যে ইচ্ছা জিয়াউর রহমান ব্যক্ত করে ছিলেন তা তিনি সত্যি সত্যি ঘটিয়ে ছিলেন। তার আমলেই সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত চলছে। ৩০ শতাংশ রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়লে, ৭০ শতাংশ কর্পোরেশনে, ৫০শতাংশ বৈদেশিক মন্ত্রনালয়লে, এবং প্রচুর অবসর প্রাপ্ত অফিসার লাইসেন্স পারমিট, কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সামরিক বাহিনী এবং ধর্ম বাংলাদেশের পলিটিক্স থেকে কোনদিন মুক্ত হতে পারবে বলে মনে হয়না।
পরের অংশ
|