আশ্চর্য আলাপ আশীষ বাবলু
দুপুর বেলার সুখ নিদ্রাটা ভেঙ্গে গেলো কলিং বেলের কর্কশ শব্দে। নিশ্চয়ই স্ত্রীর অর্ডার করা কোনো পার্সেল! এক মুখি বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললাম।
পার্সেল কই? দেখি খালি হাতে এক সাদামাটা ভদ্রলোক দাড়িয়ে। কোনদিন দেখেছি বলে মনে হয়না।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে ভাই?
ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম ভগবান।
এই নামে কাউকে চিনি বলে মনে পড়লো না। বললাম, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?
উনি বললেন, আমার জন্য আর কি করবেন। ভগবানের জন্য মানুষ কবে কী করেছে!
গেল ঘুমটা একদম চটকে! এই ভর দুপুরে মশকরা! ভদ্রলোকের মুখের উপর দিলাম দরজা বন্ধ করে।
দেখি দরজায় টোকা দিচ্ছেন লোকটা। দরজা খুললাম। প্রায় ধমকের সুরে বললাম, বলুন-তো আপনি কে? আমার কাছে কি চাই? লোকটা বললেন, এলাম আপনার সাথে একটু গল্প করতে।
-আমার সাথে? আমি ওয়ার্কিং ফ্রম হোম। কাজে ব্যস্ত।
লোকটা বললো, একদম বাজে কথা। গত দুইদিন যাবত সিক্ না হয়েও সিক-লিভ নিয়ে আপনি শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছেন।
এ ব্যাপারটাতো ভদ্রলোকের জানার কথা নয়। স্ত্রীকেও বলেছি আমার বুক ধড়ফড় করছে বলে কাজে যাচ্ছিনা। সন্দেহ কাটাতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার আইডেন্টিফিকেশন, মানে ড্রাইভিং লাইসেন্স জাতিয় কিছু আছে?
লোকটা ভুরু কুচকে বললেন, কেন?
- আপনার নাম ঠিকানা একটু জানতে চাই।
গালে হাত বোলাতে বোলাতে লোকটা বললেন, যে কিনা সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড চালাচ্ছে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিনা জানতে চাইছেন?
না! এসব আর নেওয়া যাচ্ছে না। ভদ্রলোক বদ্ধ পাগল! দিলাম আবার দরজা বন্ধ করে।
সেই আগেকার মত আবার দরজায় টোকা। দরজা না খুলে পারলাম না। বললাম, ভাই, কেনো খামাখা বিরক্ত করছেন, আমার সাথে গল্প না করে, পাশের বাড়িটা দেখিয়ে বললাম, ঐ বাড়িতে যান, রবার্টের বউ মার্গারেট আছে, মহিলা গল্প করতে ভালবাসে, তার গল্প করার অফুরন্ত সময়।
এবার ভদ্রলোক স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমিও তাকালাম। দেখি তার দুই কান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। দুই আঙ্গুল দিয়ে একটা চুটকি দিলেন, দুই খানার বদলে চার খানা হাত হয়ে গেল। মাথায় উঠে এলো ঝক ঝকে মুকুট।
এবার আর বিশ্বাস না করে উপায় নেই। হ্যাঁ স্বয়ং ভগবান আমার দরজায় দাড়িয়ে। আর আমি নরাধম তাকে চিনতে না পেরে তার কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইছি? ছি ছি ছি!
বললাম, আসুন আসুন, কী সাঙ্ঘাতিক! আপনি আমার মত একজন পাপী-তাপীর ঘরে এসেছেন, বসুন বসুন বলে সোফার উপর পরে থাকা কুশনটা সরিয়ে বসতে বললাম।
ভগবান বসতে বসতে বললেন, তোদের ঐ মিরাকল দেখার অভ্যাসটা যাবেনা। এক ডজন হাত পা না থাকলে বিশ্বাসই করিসনা যে ভগবান!
দেখলাম কান থেকে ধোয়া বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, চার হাতের বদলে এখন দুই হাত, মাথার সোনালি মুকুটও হাওয়া!
ভগবানকে কী জিজ্ঞেস করা যায়, চা খাবেন নাকি কফি?
ভগবানের দেখা পেলে তাকে কি ভাবে আপ্যায়ন করতে হয় তা কোন ধর্ম গ্রন্থে লেখা নেই। আমার স্ত্রী তো জল আর নকুল দানা দিনের পর দিন খাইয়ে যাচ্ছে।
আমার অন্তরের কথা ভগবান বুঝেছেন, বললেন, দে দেখি এক-গ্লাস জল।
জলের গেলাস তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। নকুল দানা দিতে সাহস হলো না! মেঝেতে তার পায়ের পাশে জড়সড় হয়ে বসলাম। উনি আমাকে ইশারায় তার উল্টো দিকের সোফায় বসতে বললেন।
এবার আমি বসেছি ভগবানের মুখো-মুখি।
ওনার হাবভাব বেস সাধারণ । কত অষ্টরম্ভা মানুষকে দেখেছি হম্বিতম্বি করতে। অথচ তিনি রিয়েল ভগবান হয়েও মাটির মানুষ। যাহ্ ভগবানকে মানুষ বলে ফেললাম!
যাইহোক সাহস করে মুখ খুললাম। খুবই সাধারণ প্রশ্ন,
- এতো লোক থাকতে আমার ঘরে কি মনে করে এলেন শ্রী ভগবান?
তিনি হেসে বললেন আমার নামের আগে ‘শ্রী’ লাগিয়েছিস কেন? জানিসনা কবি আর ভগবানকে নাম ধরে ডাকা যায়? তবে এটাও মনে রাখবি ভগবানের কিন্তু সবাইকে ‘তুই’ বলে সম্বোধনের অধিকার আছে। তোকে আমি তুই বলবো।
- আপনি আমাকে যা খুশি তাই বলুন। আমার কোন আপত্তি নেই। তবে মাঝে মধ্যে আমার নামটা নেবেন। এতদিন ভগবানের নাম নিয়েছে মানুষ। ভগবানের মুখে মানুষের নাম নেওয়ার অভিজ্ঞতাটুকু আমি মনে রাখতে চাই।
- তথাস্তু! আশীস! তোর প্রশ্ন ছিল এত লোক থাকতে তোর ঘরে কেন এলাম? কেন জানিস? আমার দেখে ভাল লেগেছে যে তুই কাজ পালিয়ে কয়েকটা দিন নিজের মত সময় কাটাচ্ছিস।
- বলছেন কী ভগবান! কাজ পালিয়ে জানালার পাশে শুয়ে বসে গড়াগড়ি খাচ্ছি বলে আপনি খুশি হয়েছেন?
- কেন হবোনা? পৃথিবী এখন কেজো আর হিসেবি মানুষে গিজ গিজ করছে। তোর মত কিছু মানুষ এই পলিউটেড এরিয়ায় এক ঝলক অক্সিজেনের মত। মানুষ কি কেবলই ছুটবে? একটু নিজের মত করে বাঁচবে না?
আমার ভেতরে একটা আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। ভেবেছিলাম মিথ্যে সিক্ লিভ নিয়েছি বলে তিনি আমাকে বকা-ঝকা দেবেন। অথচ তিনি খুশি হয়েছেন! মনে বেশ সাহস পেলাম। বললাম, একটা ব্যাপার আজকে ক্লিয়ার হলাম আপনি আছেন।
- আছি মানে?
- না বলছিলাম কী ভগবান আছেন না নেই এই নিয়ে জোর তর্ক সবখানে। আপনাকে সশরীরে দেখে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো, আপনি আছেন।
- কি আশ্চর্য! আমি আছি কি নেই এতে কী আসে যায়। এমন ফালতু তর্ক করে কি লাভ? ভ্যান গখ এর আঁকা সূর্যমুখী দ্যাখ, তারায় ভরা আকাশ দ্যাখ। ভ্যান গখ বেচে আছে না ঘুমিয়ে আছে নাকি চুলায় গেছে এসব নিয়ে ভাবনা করা কি জরুরি? যদি শিল্প থাকে তবে শিল্পীও আছেন!
আমি প্রসঙ্গ পালটালাম।
- ভগবান, আপনাকে কনফেস করছি, রোজ তো যেতে পারি না। তবে মাসে একবার সময় করে আমি মন্দিরে যাই আপনার দর্শন পেতে।
- আচ্ছা কে বলেছে আমি মন্দিরে থাকি? তোরা নিজেরা মন্দির বানিয়ে বলিস ওটা আমার ঘর!
আমার মনেও এই ভাবনাটা হতো। যে ভগবান এত-বড় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তৈরি করেছেন, গাছ-পালা, পশুপাখি. পাহাড়-পর্বত আরও কত কি! সে কিনা নিজের থাকবার ঘর বানাচ্ছেন মানুষকে দিয়ে? প্রশ্ন করলাম, আপনার ঘর কোথায়? মানে আপনি থাকেন কোথায়?
ভগবান জলের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আমার ঘর হচ্ছে, আকাশ ছোঁওয়া পাহাড়ে, গহিন বনে, শান্ত জলাশয়ে, সমুদ্রের ঢেউয়ে আছড়ে পরা বালুকা বেলায়। একটু চোখ খুলে দ্যাখ, আমাকে দেখতে পাবি।
- সেই কবে থেকে আপনাকে দেখার চেষ্টা করছি, ছোট থেকে আপনাকে বোঝার জন্য ধর্মের বই পড়ছি।
ভগবান আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে টেবিলের উপর জলের গ্লাসটা রেখে বললেন,
- আমার ঐসব ধর্ম বইয়ের সাথে কোন লেনদেন নেই। আমাকে যদি পড়তে হয় তবে সূর্যের প্রথম আলোক ছটার দিকে তাকিয়ে আমাকে পড়, তোর প্রিয় বান্ধবীর চোখের তারায় তাকিয়ে আমাকে পড়, আকাশে পাখিদের ঘরে ফেরার দিকে তাকিয়ে আমাকে পড়, সন্তানের হাসির দিকে তাকিয়ে আমায় পড়।
-আমি এসব যে পড়া যায় কখনো ভাবিনি। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
- তোদের এই ক্ষমা চাইবার অভ্যাসটা বন্ধ কর। আমি কাউকে শাস্তি দেইনা, ক্ষমা করার প্রশ্ন আসে কি করে!
আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি, বলছেন কি আপনি কাউকে শাস্তি দেননা? নরকে আপনি আগুনে নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা রেখেছেন কিভাবে?
- কি বলছিস বোকা কোথাকার! আমি তোদের সৃষ্টি করেছি। তোরা আমার সন্তান। কোন পিতার পক্ষে তার সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করা কি সম্ভব?
- এসব তো শাস্ত্রে লেখা আছে! পণ্ডিতরা তো তাই বলেন!
- এরা পণ্ডিত নয়, ধর্ম ব্যবসায়ী। তোদের বোকা বানাবার জন্য বলে, আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তোদের সবার কাজ-কারবার নোটবুকে লিখে রাখবো। আমি তোদের সৃষ্টি করার সাথে সাথে দিয়েছি স্বাধীনতা। তোদেরও জন্য কোন প্রাইজের ব্যবস্থা রাখিনি। শাস্তির ব্যবস্থাও রাখিনি।
আমি একটু চিন্তিত হয়ে বললাম, শুনেছি পৃথিবীতে আপনি পরীক্ষা নিচ্ছেন, আমরা স্বর্গে যাবো না নরকে!
ভগবান বিরক্ত হলেন, বললেন, একদম বাজে কথা। জীবন কোন পরীক্ষার ব্যাপার নয়। জীবন নাটকের রিহার্সাল নয়, স্বর্গে যাবার প্রস্তুতি নয়। জীবন মানে জীবিকাও নয়। জীবন হচ্ছে আনন্দে বেঁচে থাকা।
- বেশি আনন্দে-তো মানুষ খেই হারিয়ে ফেলবে। জ্ঞান শূন্য হবে?
- খেই হারানোটা সম্পূর্ণ তোদের নিজস্ব ব্যাপার। যে অন্যায় কাজ তুই তোর জন্য, তোর পরিবারের জন্য করতে পারবি না সেটা তুই অন্যের জন্য করবি কেন? ভাল মন্দের এই সুবুদ্ধি টুকু আমি কি তোদের মগজে দিইনি?
- আপনার যুক্তি অকাট্য! কোন তুলনা হয়না। আপনি সর্বশক্তিমান। আপনি মহান। আপনি সর্ব শ্রেষ্ঠ।
-প্লিজ.. ভগবান হয়েও তোদের রিকোয়েস্ট করছি, এই তোতা পাখির মতো আমার প্রশংসা করবি না। আমাকে তেল দিবি না। আমি বাচ্চা ছেলে নই যে আমাকে ‘গুডবয়’ বললে আমি হাত পা ছুঁড়ে নাচবো। যদি প্রশংসা করতে হয় তবে আমার সৃষ্টির প্রশংসা কর। ঐযে আকাশের কোনে হঠাৎ জেগে ওঠা রংধনু, ঐ ফুল, ঐ পাখি, পাতার উপর সূর্যের আলোর চিকিমিকি, এসবের প্রশংসা কর।
- তবে আমাদের কাছে আপনার কি চাওয়া? কোনো জিজ্ঞাসা আছে?
- আছে। এই পৃথিবীতে তোরা জন্মেছিস, এখানে তোদের কী বেশি ভাল লেগেছে? কিছু কি শিখেছিস?
ভয়ে ভয়ে মাথা নামিয়ে বললাম, হয়তো শিখেছি, হয়তো শিখিনী।
- আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। ভগবান মিষ্টি করে হেসে বললেন, আমি মানুষের মতো রাগ করতে পারি না। সমালোচনা করতে পারি না। বিরক্ত করা আমার অভ্যাস নয়। মনে রাখবি এই সংসারে একটা আরশি আছে। সেই আয়নায় মাঝে মধ্যে নিজের মুখটা দেখবি, তবেই ভাল মন্দ শিখতে পারবি।
ভগবানের মুখের মিষ্টি হাসিটা তখনও মিলিয়ে যায়নি। তার একটা হাত ধরে বললাম বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি আপনার সাথে বসে আছি।
ভগবান আমার হাতের উপর তার একটা হাত রাখলেন, বললেন, আমাকে বিশ্বাস করতে হবেনা। আমি চাই তোরা আমাকে অনুভব কর।
- অনুভব করবো কি করে?
- যখন তুই তোর প্রিয়তমার কপালে চুমু খাবি, যখন তোর পোষা কুকুরের মাথায় হাত বোলাবি আর ও লেজ নাড়বে। যখন তোর ঘুমন্ত সন্তানের শরীরে চাদর খানা তুলে দিবি, তখন অনুভব করবি আমাকে। সেখানে আমার স্পর্শ পাবি।
আমার চোখের কোনে কখন দু‘ফোটা অশ্রু জমা হয়েছিল বুঝতে পারিনি। গাল বেয়ে নেমে এলো টের পেলাম। কে কে তুমি?
ভগবান বললেন, জ্ঞান আর ভালবাসার যোগফল হচ্ছি আমি।
একথা বলে ভগবান উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমাকে এখন যেতে হবে। আমি বললাম, এরপর কোথায় খুঁজে পাবো আপনাকে? তিনি বললেন, কোথায়ও যেতে হবে না। তোর অন্তরে খুঁজে দ্যাখ সেখানে আমাকে পাবি।
আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে ভগবান অদৃশ্য হলেন। ঘোর যখন কাটলো মনে হলো ভুল করে ফেলেছি, একটা সেল্ফি তোলা হয়নি!!
কৈফিয়ত : আগেই বলে নেই, ঠাকুর ঘরে কে আমি কলা খাইনি! এ যুগের আশ্চর্য বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে বহুবার প্রশ্ন করা হয়েছে যে আপনি কি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন? তিনি তার উত্তরে বলেছেন আমি বিশ্বাস করি স্পিনোজার(Spinoza)বর্ণিত ঈশ্বর। সেই সূত্র ধরে ডাচ ফিলোসফর স্পিনোজার কিছু বই ঘাটাঘাটি করে সহজ ভাবে তার বিশ্বাসের সারাংশ আপনাদের করকমলে পেশ করার চেষ্টা করেছি। জোর পূর্বক কারো ঘাড়ে এই বিশ্বাস চাপাবার কোন মতলব আমার নেই। সুকুমার রায়ের ভাষায়, নাইবা তাহার অর্থ হোক / নাইবা বুঝুক বেবাক লোক।
আশীষ বাবলু, সিডনি, ashisbablu13@yahoo.com.au
|