একজোড়া চিচিঙ্গা এবং নস্টালজিক বৈশাখ আসাদ শামস
আগের অংশ
"তো একবার কারখানার মালিক দেখেন শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দিন দিন তার প্রডাকশন কমছে। তিনি মিটিং করে বিশেষজ্ঞ মতামত চাইলেন। অনেকেই বেতন বোনাস ইত্যাদি বাড়ানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্তু মালিক চাইলেন বিনা খরচে প্রডাকশন বাড়াতে। তো বোর্ড মিটিংএ একজন যার হিউম্যান সাইকোলজিতে ডিপ্লোমা করা ছিলো। তিনি বল্লেন যে খুব কম খরচে আমরা একটা ট্রাই করতে পারি। তিনি মালিককে পরামর্শ দিলেন শ্রমিকদের চলাফেরার করিডোরে বক্সিং প্র্যাকটিস করার একটা পাঞ্চিং ব্যাগকে আপনার একটা রাবারের মূর্তি দিয়ে মুড়ে বসিয়ে দিন। মালিক তাই করলেন। রাতারাতি ফল ফললো। কেনো জানো? " রুকু বললো, "হুম। তুমি এক কাজ করো। আমাদের কিচেনেও তোমার একটি আবক্ষ রাবারের মূর্তি ঝুলিয়ে রাখো। আমিও ওই মূর্তিকে ঘুষি মেরে মেরে রাগ কমিয়ে তোমার রান্নার স্বাদ আরও বাড়িয়ে দেব।" জিল্লুর হা হা ক'রে গলা ফাটিয়ে হাসতে থাকলো।
আজকের বৈশাখী মেলার কালচারাল প্রোগ্রামের নামকরণ হয়েছে 'প্যারামাটা থেকে পদ্মা'। নামকরণটা জিল্লুরের। রুকু আবার পেছনে ফিরে গেলো। অনেকদিন VOA শোনা হয়না। অথচ এক সময় BBC আর ভোয়া ছিল প্রতিরাতের বিশ্বের সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। সেইসময় ভোয়া'র একটা নিয়মিত অনুষ্ঠানের নাম ছিলো 'প্রোটোম্যাক থেকে পদ্মা'। জিল্লুর হয়ত ওখান থেকেই নামটির আইডিয়া নিয়েছে। সেবছর আমেরিকাতে গিয়ে রুকু প্রোটোম্যাক নদীটা দেখে এসেছে। চমৎকার!
রুকু আবার ফিরে যায় বাংলাদেশের সেই প্রাক ইন্টারনেট এর যুগ, শর্ট ওয়েভ রেডিওতে সংবাদ শোনা আর নিউজ পেপারে ছাপা খবরের কাগজ পড়বার যুগে। যে যুগে ভয়েস অফ আমেরিকার কাছে তালেবান নেতা ক্যপ্টেন মাসুদ একজন বীর যোদ্ধা। জিল্লুর ছাত্র অবস্থায়ই গোপনে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল। জিল্লুর রুকুকে বলেছে তখন সোভিয়েতকে ঠেকানোর জন্যে আমেরিকা এই তালেবান সৃষ্টি করেছে। আর সেই তালেবান আজ আমেরিকার জন্যে বুমেরাং হয়েছে। রুকু রাজনীতি পছন্দ করেনা কিন্তু জিল্লুরের কাছে হাজারবার প্যাঁচাল শুনে শুনে মানের অজান্তেই ওটা নিয়ে ভাববার বদভ্যাস গড়ে উঠেছে। রুকুর ধারণা বুমেরাং নয় এই ক্যাওয়াসটাও ওদের পরিকল্পিত। কেননা যেখানেই গন্ডগোল সেখানেই মুরুব্বির প্রয়োজন। আর সেই ফাঁকে মুরুব্বির অন্যের অধিকার হরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন।
একসময়ের আর্ট কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট জেবা ভাবী আর শিল্পী তন্ময় আহসান মিলে মেলার ডেকোরেশন করেছে। টেবিলে একটা আইটেম সবার মন কেড়েছে। একটা বড় থালাতে বেশ কিছু ফলমূল শাকসবজির ডালি। সবগুলি দেখলেই মনে হয় যেন বাংলাদেশের নেটিভ। এই অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশের প্রায় সব নেটিভ শাক সব্জিই ফলে। তার পরও পেতে কষ্ট। ভাবী নাকি পাঁচ দোকান খুঁজে এগুলি এনেছেন। ভাবী পারেন ও!
একজোড়া চিচিঙ্গা থালার ওপর পড়ে থাকতে দেখে রুকু আবার আনমনা হয়ে যায়! চিচিঙ্গার আসল নাম যে 'শ্রীচন্দন' তা রুকু প্রথমে একদিন জিল্লুরের ঢাকার বাসায় জিল্লুরের মা থেকে জেনেছিল। খুব চমৎকার মানুষ! রুকু বলেছিলো আমরা এই সব্জিটিকে 'রেখা' বলি। জিল্লুরের মা সাহিত্যিক মনের মানুষ, কাগজে লেখালিখি আর সমাজসেবা করেন। তিনি নামটি পছন্দ করলেন। বললেন, "বাহ! খুব কাব্যিক নাম! " জিল্লুর মাঝখানে ফোঁড়ন কেটে বললো, "কাব্যিক নাম নয় মা ; বলো জ্যামিতিক নাম।" জিল্লুর তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরী থেকে বিশাল 'প্লান্ট এনসায়ক্লোপেডিয়া' নামিয়ে আনলো। "এর সাইন্টিফিক নাম জানো মা? 'Trichosanthes cucumerina '. জিল্লুরের মা হাসতে হাসতে বললেন,"রাখ তোর সাইন্টিফিক নেম! সব জায়গায় পণ্ডিতি।" রুকুকে বললেন, "অনেক নামের পেছনে অনেক ইতিহাস থাকে। অনেক নাম তার আদি প্রকৃতি ধরে রাখে, আবার অনেক নাম তার উৎস হারিয়ে অপভ্রংশ নিয়ে বেঁচে থাকে।" জানো মা, আমার বাপের বাড়ির দেশে আমরা বলতাম চিচিঙ্গা, আর আমার শ্বশুরের দেশে এসে দেখি ওঁরা বলেন 'ছেড়্চন '। আমি তো হেসেই মরি! কিন্তু এখন আমিও বলি 'ছেড়্চন'। "যোস্যিন দেশে যদাচার"। কি জানো, চিচিঙ্গার আসল নাম কিন্তু 'শ্রী চন্দন'। এই দ্যাখো না এই রেখাগুলি দেখতে অনেকটা কপালে চন্দন দিলে যেমন দেখতে হয় তেমনটি। তাইতো আদিতে সনাতন ধর্ম অধ্যুষিত এই অঞ্চলের মানুষেরা এর এই নামকরণ করেছিলো। ওই 'শ্রী চন্দনের ' অপভ্রংশ গুলিই আসলে আমাদের 'চিচিঙ্গা' কিংবা 'ছেড়্চন'। কিন্তু মা তোমাদের নামটি কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে! সম্ভবত খুব আধুনিক যুগে জ্যামিতির সংজ্ঞা জানা শিক্ষিত কেউ এ নামকরণ করেছিল, 'রেখা'।"
জিল্লুরের মা'র বলার ধরণ দেখে রুকু মনে মনে হেসেছিল। বুঝেছিলো জিল্লুর তার পণ্ডিতি কোথা থেকে শিখেছে। ভদ্রমহিলা বলেনও সুন্দর! ঐদিন ওই আলো আধারিতে জিল্লুরের মায়ের মুখখানি রুকুর নিজের মা আর বাঙলা ম্যাডামের মুখের সাথে মিশে একাকার হ'য়ে গিয়েছিল। চিচিঙ্গার রেখার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুকু বার বার উচ্চারণ করতে থাকে, "রেখা, রেখা..রেখা ...." আবারও রুকু ফিরে যায় সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সময়ে। হ্যাঁ, ঐদিন তো কার্জন হলের সামনে দিয়ে কাঁটাতারের ব্যারিকেড ভেঙে শিশু একাডেমীর দেয়াল বরাবর দাঁড়ানো অবস্থায় যে বুলেটগুলি 'রেখা'র বুকটা ঝাঁজরা করেছিলো.... তখন তো রেখার সাথে জিল্লুরই ছিলো। রেখা ছিলো রুকুর যমজ বোন, জিল্লুরের রাজনৈতিক জগতের বন্ধু। দুজনেই একই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। রেখার সূত্র ধরেই রুকুর সাথে জিল্লুরের পরিচয়। রেখা ছিলো রাজনীতির পোকা আর রুকুর শুধু কবিতা। রাজনীতি রুকুর একদমই পছন্দ নয়। তখনও নয়, এখনও নয়। ওই রাজনীতিই তো রেখার বুকটা ঝাঁজরা করেছিলো। জিল্লুর শিশুর মত কেঁদেছিল। বলেছিলো, "গুলিটা রেখার বুকে না লেগে আমার বুকে লাগলো না কেন?" গুলি অবশ্য জিল্লুরের গায়েও লেগেছিলো বাম দিকের কনুইয়ে। একটু ছেঁচড়ে গিয়েছিল।
জিল্লুরের বন্ধু আসাদ, রাজা, জাহিদ, সাংবাদিক ফজলুল শুভ্র আর দিনুও ছিলো ঐদিন। ওরাও রেখার বন্ধু ছিলো। দিনু পত্রিকার ফটোগ্রাফার। দিনুর ক্যামেরায় রেখার সেই ছবি তোলপাড় তুলেছিল! রুকু দু'বছর পর ম্যাগাজিনের কবিতায় লিখেছিলো,
"দিনু'র ক্যামেরায় বুকের রক্তরেখায় বিপ্লবী পোস্টার যায় স্বর্গের সীমানায় "
বিপ্লব, রাজনীতি কখনই রুকুর প্রিয় কোন বিষয় নয়; কিন্তু তবুও রেখার প্রসঙ্গ এলেই নোংরা রাজনীতির খোলস উন্মোচনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় রুকু কল্পনায় রাজনীতিবিদ হয়ে যায়। জিল্লুরের মত সুকান্তের কবিতার শব্দ পরিবর্তন ক'রে অস্ফুটে উচ্চারণ ক'রে কেঁদে ওঠে,
....রেখা ভূমিষ্ঠ রক্তে ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ..... বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই 'রেখা '
অশ্রু সিক্ত প্রত্যয়ে জিল্লুর যোগ করে, "সরল রেখা।"
এই গল্পের সব চরিত্রই কাল্পনিক। জীবিত কিংবা মৃত কোনো মানুষের সাথে কোনো মিল থাকলে তা কাকতালীয় - লেখক
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া রচনাকাল ১ লা বৈশাখ থেকে ২০ বৈশাখ ১৪২৩ (১৪ ই এপ্রিল থেকে ৩রা মে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ)
আগের অংশ
|