ভালবাসার ভালবাসা এম এস আরেফীন
গত সন্ধ্যায় আমার স্ত্রী আমার হাতে একটি খাম দিয়ে সেটাকে দেখতে বললেন। খামের উপর কোন নাম নেই ধাম ও নেই। খাম খুলতেই ভেতরে ছোট্ট একটি কার্ড, যার মুখ পৃষ্টে এক গুচ্ছ ফুলের ছবি আশা ও ভালবাসার বাণী বিচ্ছুরণ করছে। মুখ পৃষ্টে স্পষ্ট ইংরেজিতে লেখা লাভ। কার্ডটা খুলে বেশ অবাক হলাম। ভেতরে কিছুই লেখা নেই। একেবারে সাদা শুভ্র বিরান ভূমি। কৌতূহলী দৃষ্টি আর এক ছটাক হাসি নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালাম। জানালো ক্লাস সিক্স এ পড়া তার বোনের মেয়েকে ক্লাসের কোন এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি এটা প্রদান করেছেন। কে কিভাবে প্রদান করেছে সেই বর্ণনা জানতে চাইনি বা সেটা নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনি, কারণ সম্বোধন ও বাণী-হীন কার্ডটাই বলে দিচ্ছে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে কৌশল করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে, কার্ডটা তাকে প্রাপকের কাছে চালান করতে হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত যে বুদ্ধি ও কৌশল বের করতে তাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। কার্ডটা দেখে ও তার নেপথ্য কাহিনী শুনে আমার একটা দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া হলো। অসম্ভব ভালো লেগেছে একটি নতুন প্রেমের আত্মপ্রকাশে - অনুভূতিটা অসাধারণ, একটি ছোট্ট হৃদয় প্রথম বারের মতো আরেকটি হৃদয়ের জন্য আকুল হয়ে আছে, তার চিন্তায় তার বেড়ে যাওয়া হৃদ স্পন্দনে কাছে না পাবার কষ্ট এবং পাওয়া না পাওয়ার রোমাঞ্চ, শিউড়ে উঠা, শরীরে কাটা দেয়া, ঘন ঘন দীর্ঘ শাস প্রশ্বাস আর শরীরে তেড়ে উঠা রক্ত প্রবাহ - এ এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। আর কষ্ট হয়েছে, প্রকাশের ধরনে ও গোপনীয়তায়।
শাশ্বত প্রবাহমান ভালবাসা এই দুনিয়াতে প্রবাহিত হবে এটাই স্বাভাবিক তবে গোপনীয়তায় আর রাগ ধাকে মনে হচ্ছিল যে প্রেরক কেন এই গোপনীয়তা অবলম্বন করলো। তার চিন্তা চেতনায় অনেক গুলো কারণ থাকলেও, আমি তিন টা মুখ্য কারণ বের করলাম।
১. প্রত্যাশিত প্রেমিকার প্রত্যাখ্যানের ভয় ২. মা বাবা মুরুব্বি শিক্ষক জানতে পারলে শাস্তি হবে সেই ভয় ৩. বন্ধু বান্ধব জানতে পারলে হাসি তামাশা করবে সেই ভয়
ভালবাসা ও ভয় একই ঘরানার দুই মাসতুত ভাই এবং এরা একে অন্যকে ছাড়া চলতে ফিরতে পারেনা। যেখানেই ভালবাসা সেখানেই ভয়।
সেই পুচকে প্রেমিকের ভয়ের কারণ যাই হোক উপরোক্ত কারণগুলোর সাথে আমরা সবাই বেশ পরিচিত এবং বিশেষত দুই নাম্বার কারণটি। কাউকে ভালবাসি জানতে পারলে মা বাবা রাগ করবে। ভালবাসি ভাল কথা কিন্তু সেই সাহস সমস্ত বাধ ভেঙ্গে প্রকাশের পর্যায়ে চলে গেছে জানতে পারলে মা বাবা আস্ত রাখবেন না কাউকে ভালবাসার অপরাধে কতকিছু যে বন্ধ হবে। টিভি দেখা, গল্প করা, টিউশনিতে যাওয়া বন্ধু বান্ধবের সাথে মেলা মেশা করা আরো কত কি। অথচ আশ্চর্য জনক ভাবে জীবনে একটা সময় আসে যখন এই মা বাবা ই চায়, যে কাউকে বিয়ে করে ভালবেসে আমরা সুখী হই। শুধুমাত্র বয়সের প্রেক্ষাপটটা জীবনের প্রেক্ষাগৃহে একই অনুভূতি পুরো ভিন্ন ভাবে দৃশ্যমান করে।
ভেবেছিলাম সময়ের প্রবাহে কালের বিবর্তনে আমরা বদলেছি, বদলেছে আমাদের মানসিকতা ও চিন্তাধারা আমার ধারনাটা যে ভুল সেটা জানার জন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না। নাম ঠিকানা ও বার্তা বিহীন শূন্য কার্ডটি বলে দিলো ২০১৮ সালেও আমরা আগের মতই আছি। জানি ছোট্ট বয়সের প্রেমের অনেক টানাপোড়ন আছে যা মা বাবকেই বহন করতে হয়। তবুও ভালবাসার ওয়াস্তে আমরা কি পারিনা আরো একটু উদার হতে, আমরা কি পারি না এই ভেবে আনন্দিত হতে যে আমার সন্তানের জীবনে ভালবাসার আগমন ঘটেছে, হোক সে ছোট বা অবুঝ। আমরা কি পারিনা এই বিশাল একটি অনুভূতিকে ইতিবাচকতায় স্বাগত জানাতে।
কবে সেদিন আসবে, যেদিন না লেখা কার্ডের মুখোশে ভালবাসাকে তার অস্তিত্ব গোপন করতে হবে না। কবে সেই সূর্য উঠবে যেদিন বিগত রাতের ভয় গ্লানির পরোয়া না করে - ভালবাসা শুধু ভালবাসার কথাই বলবে।
এম এস আরেফীন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|