bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



মন্তাজ মিয়ারা
এম এস আরেফীন



- স্যার একডা টেহা বেশী দেন স্যার, রাস্তায় রাস্তায় পানি, গাড়ি টানা কষ্ট, হের উপর জামের লেইগ্যা ঘুইরা আইলাম স্যার।
- আরে, দূর বেটা, রাস্তায় রাস্তায় পানি, পানি কি আমি আনছি? আমি কি আসমানের দিকে চায়া চিল্লায়া চিল্লায়া কইসি “আল্লাহ মেঘ দে পানি দে...”। জামের লেগা ঘুইরা আইসে, আমি তরে কইসি ঘুইরা আইতে? আবার টাকা বেশী চাস? যা, ভাগ হারামজাদা।
- স্যার গালি দেন ক্যা, স্যার?
- যা ভাগ

মন্তাজ মিয়া রিকশা ঘুরালো। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। টাকার জন্য নয়, গালি খেয়ে। দিনে পাঁচ দশ বা বিশ টাকা কম আয় হলে মন খারাপ হয় না। কিন্তু বিশ পঁচিশ মিনিট কিংবা আধা ঘণ্টার পরিচিত সওয়ারীর কাছ থেকে গালি খেলে মনটা ভেঙ্গে যায়। রিকশাওয়ালার দুঃখ কেউ বোঝেনা। উপরওয়ালাও না। কি খাটনির কাম রিকশা টানন। তার উপর আইজ রোইদ তো কাইল তুফান। আর আজীবনের অভিশাপ রাস্তার জাম আর টেরাফিকের মাইর তো কপালে বান্দা। কিছুই বোঝেনা মন্তাজ মিয়া। রিকশাওয়ালারা কি দেখতে ভিন্ন জাতের হয়, তাদের চোখ, নাক, কান ভিন্ন রকম অথবা সব রিকশাওয়ালাই কি কুচকুচে কালো। না, তাতো নয়। এমন অনেক রিকশাওয়ালা আছে যাদের দেখতে রাজপুত্রের মতো লাগে। কিন্তু তাদেরও তো একই অভিযোগ - রিকশাওয়ালাদেরকে কেউ মানুষই মনে করেনা। রিকশা চালায়, গতর খাটায়, আয় করে। চুরি, ডাকাতি বা রাহাজানিতো করে না। তাও পুরো দুনিয়ার সবার আক্রোশ রিকশাওয়ালাদের উপর কেন?
এসব আকাশ কুসুম ভাবছে, হঠাৎ এক ভদ্রমহিলা হাঁকলেন।

- এই রিকশা যাবেন?
- কই আফা?
- আজিমপুর কলোনি?
- হ, যামু

বলেই ভদ্রমহিলা উঠে পরলেন। মন্তাজ মিয়া একটু ধাক্কা খেলো। ভদ্রমহিলা দামদর না করেই উঠে গেলেন। শেষমেশ ভাড়াটা মিলবেতো ঠিকমতো? মিলবে মনে হয়। মহিলা মানুষ, দেখে শুনে ভদ্রই মনে হচ্ছে। তার উপর আপনি করে বলেছেন। রিকশা চালানো দুনিয়ার নিকৃষ্টতম কাজ, তাই সবাই তাদেরকে “তুই” করে বলে। পৃথিবীর সব সম্পর্কের সাথে সম্বোধনের একটা নিবিড় প্রেম আছে। প্রেমিক প্রেমিকারা তুমি, স্যার বা বড় মাপের কেউ হলে আপনি, বন্ধু হলে তুই। ঠিক তেমনি রিকশাওয়ালা মানেই “তুই”। এর অর্থ দুটো হতে পারে,

১. সওয়ারীরা রিকশাওয়ালাদেরকে বন্ধুর মতো আপন ভাবেন
২. সওয়ারীরা রিকশাওয়ালাদেরকে নিকৃষ্ট জাত ভাবেন

প্রথমটা হবার সম্ভাবনা কম। সওয়ারীরা রিকশাওয়ালাদেরকে বন্ধু ভেবে তুই বলে সম্বোধন করলে রিকশাওয়ালাদের উচিৎ তাদের সওয়ারীদেরকে তুই করে বলা। কিন্তু বাস্তবে সেটাতো হয়না। ভাবা যায়, রিকশাওয়ালা এবং তার সওয়ারীর কথোপকথন যদি এমন হয় -

সোওয়ারী - ঐ, যাবি
রিকশাওয়ালা- হ, যামু, কই যাবি?
সোওয়ারী- নারিন্দা
রিকশাওয়ালা - চল, উঠ
সোওয়ারী - এক্কেরে সোজা নিয়া যাবি, ঘুরায়া পেচায়া নিবিনা
রিকশাওয়ালা - তুই চুপ মাইরা বয়া থাক, আমি সোজা টান দিয়া নিয়া যামু তোরে। তয় ভাড়া বেশী দিবি।
সোওয়ারী - আইচ্ছা দিমুনে।

বৃষ্টিটা ধরেছে, আকাশ যদিও গম্ভীর হয়ে আছে, পুরোপুরি মেঘলা ভাব। আকাশের এই রূপ দেখে মনে হচ্ছে, সে তার বুকে অনেক কষ্ট চেপে রেখেছে, কিন্তু সেই কষ্টগুলোকে সে বৃষ্টি হয়ে ঝরাতে চাচ্ছেনা। মন্তাজ মিয়ারও মাঝে মাঝেই এমন হয়। খুব কষ্ট হয় বুকের ভেতর কিন্তু সে কাঁদেনা, কাঁদতে চায়না।

গন্তব্যে চলে এসেছে তারা। জায়গাটা সুন্দর, প্রকৃতি ঘেরা। একটা পুকুরও আছে। ঢাকার মতো যান্ত্রিক শহরে এই এলাকাটা অনেকটাই ভিন্ন। চারিদিক ভিঁজে আছে। বৃষ্টি যেমন ক্লান্ত হয়ে এখন জিরিয়ে নিচ্ছে। তেমনি অনেকক্ষন বৃষ্টির তীক্ষ্ণ সূঁচালো ঝাট সহ্য করার পর গাছ পালা, মাটি, পুকুর, দালান, কোঠা সব কিছুই একটু বিশ্রাম নিচ্ছে।

- এই যে ভাই থামেন থামেন, চলে এসেছি থামেন, ভাই আপনাকে কতো দেবো?
- ১০ টেহা আফা

ভদ্রমহিলা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে, মন্তাজের দিকে এগিয়ে দিলেন।

- আফা আমার কাছে পঞ্চাশ টেহার ভাংতি নাই আফা
- আচ্ছা দাঁড়ান দেখছি,

কিছুক্ষণ ব্যাগ খুঁজে কোন ভাংতি পেলেন না ভদ্রমহিলা।

- আচ্ছা শোনেন, আপনি দাঁড়ান, আমি উপরে গিয়ে আপনার ভাড়া পাঠিয়ে দিচ্ছি।
- আইচ্ছা

মন্তাজ মিয়ার মনে সন্দেহ উঁকি দিলো। ভাড়া পাবেতো? আপনি করে বললো আবার ভাই ও বললো। কি জানি? ক্লান্ত শরীরে মাথা এতো কাজ করেনা। মন্তাজ মিয়া রিকশার পেছনের সীটে বসে পড়লো। একটু জিরিয়ে নেবে। সারাদিন বৃষ্টিতে রিকশা চালিয়েছে। রাস্তায় জমে থাকা পানিতে রিকশা টানা অনেক কষ্টের, অনেক ক্লান্তিকর। তাই সে এই ফাঁকে একটু বিশ্রাম নেবে। রিকশার পেছনের সীটে বসে মাত্র চোখদুটো বন্ধ করেছে আর অমনি, হঠাৎ বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলো। মুহূর্তেই তার চোখ চলে গেলো পাশের পুকুরটায়। সে শুধু দেখলো পুকুরের পানির মাঝখানে একটি বাচ্চা হাত উঁচিয়ে আছে। বাচ্চাটির উঁচিয়ে থাকা হাতটিই বলে দিচ্ছে, আমাকে বাঁচাও, সাহায্য করো।

মুহূর্তেই দৌড়ে পুকুরে ঝাঁপ দিলো মন্তাজ। সাতরে গিয়ে মেয়েটাকে উদ্ধার করে পুকুর পাড়ে নিয়ে আসলো। মেয়েটা চেতনা হারিয়েছে, তাকে আস্তে করে পুকুর পাড়ে শুইয়ে দিলো। এদিকে পুকুর পাড়ে মানুষের জটলা তৈরি হয়ে গেছে। ভিড়ের মাঝ থেকে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে ভিড়েই হারিয়ে গেলেন। এরপরেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক মন্তাজের দিকে এগিয়ে এলেন। তার হাত ধরে রিকশার কাছে নিয়ে আসলেন।

- নাম কি বাবা তোমার?
- মন্তাজ মিয়া
- কি করো?
- স্যার দেহেন তো কি করি, রিকশা চালাই
- পরিবার আছে?
- হ, স্যার
- কে কে আছে পরিবারে?
- স্যার, বউ আর একটা....
- তুমি আজকে আমাদের নাতনীটাকে বাঁচালে, তুমি না থাকলে হয়তো......

ভদ্রলোকের চোখ ভিজে এলো। তিনি বললেন,

- তুমি দাঁড়াও আমি আসছি

ভদ্রলোক উপরে চলে গেলেন এবং একটু পরেই ফিরে এলেন। হাতে পাঁচশো টাকার নোট, মন্তাজ মিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

- এটা রাখো, তোমার উপকারের ঋণ তো কোনদিনও শোধ দিতে পারবোনা। তবে এটা দিয়ে তোমার পরিবার আর সন্তানকে কিছু একটা কিনে দিও।

- স্যার, একটা কথা জিগাই?
- বলো
- আফনার নাতনীর বয়স কতো?
বেশ বড় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনি জবাব দিলেন, সাত বছর।

শহরের বুক চিরে মন্তাজ মিয়ার রিকশা ছুটছে। পেছনে কোন সওয়ারী নেই, কোন সওয়ারীর বকুনি নেই, “জোরে টান দে হারামজাদা” এমন কোন গালিও নেই, নেই কোথাও যাবার তাড়া। তাও তার রিকশা পঙখীরাজের মতো ছুটে চলছে, ছুটছে দুরন্ত ট্রেনের মতো, ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো। আর পাগলের মতো হাউ মাউ করে কাঁদছে মন্তাজ মিয়া আর আরো, আরো অনেক জোরে ছুটাচ্ছে সে তার রিকশা।
মন্তাজ মিয়ার বুকের কষ্ট গলে বের হয়ে আসা কান্নাকে লুকাতে, মন্তাজ মিয়ার কষ্টের সাথে নিজের কষ্টকে একাত্ম করে দিয়ে আকাশও ভেঙে পরেছে। সে ঝরছে ঝর ঝর করে, যেমনটি ঝরছে মন্তাজ মিয়ার চোখের পানি।

আজ তার ছেঁড়া পকেটে পাঁচশো টাকা, অথচ এই টাকায় কিছু কিনে দেবার মানুষটা আজ নেই। বেঁচে থাকলে তার মেয়েটার বয়সও সাত হতো। গত বর্ষায় ঠিক এভাবেই পুকুরের পাড়ে পা পিছলে পুকুরের অতলে তলিয়ে যায় তার মেয়ে রমিজা। আর আজ, এক বছর পরে প্রকৃতি তাকে ঠিক একই ঘটনার মুখোমুখি করেছে। অথচ দুটি ঘটনার ফলাফল ভিন্ন। সেদিন তাকে তার মেয়ের লাশটাকে পুকুর থেকে উঠিয়ে আনতে হয়েছিলো। কেনো এমন হলো, সে রিকশাওয়ালা বলে? আজকে সেই ভদ্র ঘরের মেয়েটা একই ঘটনার স্বীকার হয়েছে, বেঁচে আছে, সেই বাঁচিয়েছে। কিন্তু রমিজাকে সে বাঁচাতে পারেনি, পারেনি তার নিজের ছয় বছরের শিশু কন্যার হাসিটা ধরে রাখতে। কেনো এমন হয়, তারা নিকৃষ্ট বলে, নীচু জাত বলে, নীচু স্তরের কাজ করে, তাই?

কে দেবে এর উত্তর?

মন্তাজ মিয়ারাও মানুষ। তাদেরও আমাদের মতই চোখ, নাক, কান এবং সর্বোপরি একটা হৃদয় আছে। আর আমাদের মতই সেই হৃদয়ে আছে ভালবাসা, আছে সুখ, আছে দুঃখ, আছে কষ্ট আর আছে যন্ত্রণার নীচে চাপা পরে থাকা কান্না। আমরা কোনভাবেই কোন মূল্যেই রমিজাকে, মন্তাজ মিয়ার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবোনা। যতদিন মন্তাজ মিয়া বেঁচে থাকবেন, মেয়ে হারানোর শোকটা তাকে বহন করতেই হবে। মেঘলা আকাশের মতই ভারী হয়ে থাকবে তার বুক, কখনো কখনো হয়তো কান্নার বৃষ্টি ঝরবে। মন্তাজ মিয়ার মতো আরো হাজারো মন্তাজ মিয়ারা এই রকম দুঃখ কষ্ট বুকে নিয়েই আমাদেরকে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।

আমরা হয়তো তাদের কষ্ট বা দুঃখকে কমাতে পারবোনা তবে এই সব মন্তাজ মিয়াদেরকে আমরা যেন আর না কাঁদাই, তাদের যন্ত্রণা, কষ্ট বা দুঃখ আর না বাড়াই।

আমাদের ভালবাসা, সহানুভূতি, হাসি মুখ আর মার্জিত ভাষায় তাদের জীবনের অন্তত পনেরো, বিশ মিনিট বা আধা ঘণ্টার জন্য হলেও, এইটুকু নিশ্চিত করি, তারা ভাল আছে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের এই চর্চা তাদেরকে ভবিষ্যতেও আরো আরো অনেক ভালো রাখবে।


বিঃ দ্রঃ আজ থেকে কিছু যুগ আগে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনার কাল্পনিক বিচ্ছুরণ।



এম এস আরেফীন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 25-Mar-2019

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far