ঈদেল হাওয়া এম এস আরেফীন
আমার মনে হয় ঈদ, রোজা কিংবা যে কোন পালা পার্বনের আনন্দটা অথবা মজাটা সবচেয়ে বেশী মেলে কৈশোর থেকে তরুণ বয়সের মধ্যবর্তী সময়ে। তবে কৈশোর জীবনে এই আনন্দগুলোর মাত্রাটা অনেকটা ভিন্ন, কারণ সেই বয়সে সব অভিজ্ঞতাই “জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতা” নামক মোড়কে উপস্থিত হয়। যেমন, প্রথম রোজা রাখা, এবং প্রথম রোজার প্রথম ইফতার, কিংবা প্রথম রোজা ভাঙ্গা অথবা প্রথম রোজা রেখে গোসলের সময় পানি খেয়ে রোজা ভেঙ্গে ফেলা, আবার জীবনে প্রথম ঈদের সালামি সংগ্রহের প্রতিযোগিতা ও নানাবিধ প্রথম অভিজ্ঞতা।
এই সময়ের কিশোরদের বা তরুণদের ঈদের আনন্দটা কি সেই ব্যাপারে আমার কোনই ধারনা নেই। তবে আমাদের আমলে অর্থাৎ, এখানে আমল শব্দটার মানে হচ্ছে আমাদের কৈশোরে ঈদের আনন্দের শুরুটা হতো ঈদের জামা কাপড় কেনার মধ্য দিয়ে। আমার কৈশোরে অর্থাৎ ১৯৮০ সালের দিকে ঈদের কেনাকাটার ধুমটা সাধারণত পড়তো ১০ রোজার পর থেকে। আবার কারো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ছিলো। কেউ কেউ ঈদের কেনাকাটা শুরু করতেন শবে বরাতের পর থেকেই আর আরেক পক্ষরা চাঁদ রাতে।
আমাদের সময়ে যেদিন মা বাবা আমাদের কাপড় কেনার জন্য আমাদেরকে মার্কেটে নিয়ে যেতেন সেই দিনটার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আর যেদিন সেই মহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হতো সেদিন আমাদের আনন্দের আতশবাজি এতটাই রঙিন হতো যে আমদেরকে দেখে মনে হতো আমরা ঈদের কাপড় নয় বরং কোরবানি ঈদের গরু কেনার জন্য হাটে যাচ্ছি। আর যেদিন জামা কাপড় জুতা নিয়ে বাসায় ফিরে আসতাম মোটামুটি সেদিন থেকেই আমাদের ঈদ শুরু, অর্থাৎ সেদিন থেকে শুরু করে ঈদের তিন দিন পর্যন্ত চলতো ঈদ আনন্দ ম্যারাথন। এবং এর পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন রুটিনে আরো একটি নতুন আইটেম যুক্ত হতো। আর সেটা হচ্ছে, প্রতিদিন অন্তত একবার করে হলেও “ঈদের কাপড় বের করে দেখা”। নতুন কাপড়টা খুলে তার আনকোরা ভাজের দিকে চেয়ে থাকা অথবা নতুন কাপড়ের গন্ধে চোখ বন্ধ করে ঈদের দিনের স্বপ্ন দেশে হারিয়ে যাওয়া। আবার মাঝে মাঝেই নতুন জুতাটাকে বাক্স থেকে বের করে আলতো ছুঁয়ে দেখা, কিংবা নতুন জুতা তারপরেও ঝেড়ে মুছে রাখা। কেউ কেউ আবার নতুন জুতা পায়ে দিয়ে বিছানার বা কার্পেটের উপর টহল মারতো। তাতে করে নতুন জুতা পরার আনন্দটাও মিটলো এবং জুতাটা পুরনোও হলোনা। কারো কারো ক্ষেত্রে ঈদের নামাযটা একটা অবাঞ্ছনীয় ব্যাপার। গোমরা মুখে, ঢুলু ঢুল চোখে কোনমতে নামাযটা শেষ করা এবং তার পরেই আনন্দ ঝুড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়া। খাবার-দাবারতো আছেই আর তার থেকে মজার বিষয় ছিলো ঐ দুই তিন দিনের জন্য আমরা কিশোররা টোকাই হয়ে যেতাম। রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলতো যে ঈদে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সালাম করে কে কত সালামি টোকাতে পারে।
সারাদিন আনন্দ, হৈচৈ, ঘুরাঘুরি, সালামি টোকানো, খাওয়া দাওয়া এত কিছুর পরেও, এতো আনন্দের পরেও মনে হতো আরো আনন্দের প্রয়োজন এবং আশ্চর্যজনক ভাবে আনন্দের কমতি ছিলোনা। অতএব আনন্দ ধারাটাকে ১৬ কলা পূর্ণ করতে রাতের খাওয়া দাওয়ার শেষে আমরা সবাই হাজির হতাম টিভির সামনে, ঈদের রাতে ঈদ আনন্দমেলা দেখার জন্য। সেই ঈদ আনন্দমেলা দেখে শেষ করার পরে মনে হতো - হ্যাঁ এবার হয়েছে, একেবারে জম্পেশ, জমকালো, জাঁকজমকপূর্ণ এবং আনন্দে ভরপুর ঈদ পালন হলো।
এই লেখাটা যখন মাথায় আসে তখন মনে হচ্ছিলো ঈদের দিনের এবং আনন্দের সব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে লিখবো আর মনে হচ্ছিলো লেখাটা বড় হবে। কিন্তু না, লিখতে বসে চিন্তার ঘোড়াটা বেশিদূর ছুটতে পারলো না। কিছু লেখালেখির পরেই চিন্তার ঘোড়াটাকে রোজায় ধরলো এবং পেছন থেকে টান দিয়ে ধরে রাখলো, তাই আমার সব চিন্তা চেতনা ও শৈলীগুলো এক জায়গায় যুবু থুবু হয়ে পড়ে রইলো!
তবে যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। আমার পাঠকদেরও মনে হয় একই দশা। উনারাও মনে হয় রোজার চাপে চোখ মেলে রাখতে পারছেন না আর তাই পাঠকদের কথা ভেবেই আমিও আমার লেখাটাকে আর বড় করলাম না। লেখক হিসেবে পাঠকদের কথা চিন্তা করাটাও আমার একটা গুরু দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর আজ সারা বিশ্বে যখন গ্রাহক সেবা বিপণন নীতি নিয়ে হুলুস্থুল অবস্থা সেখানে আমিও না হয় পাঠক-সেবা দিয়ে এই রমযানে আমার সোয়াবের ঝুলিতে কিছুটা বোনাস জুটিয়ে নিলাম।
এই যুগের কিশোরদের ঈদ আর সেই যুগের কিশোরদের ঈদ, এ যুগের ঈদ কিংবা সেই যুগের ঈদ এই সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে যে বিষয়টা মুখ্য তা হচ্ছে ঈদ। ঈদ মানেই আনন্দ, আর আনন্দ মানেই - পাখা মেলে দেয়া মিষ্টি দখিনা হাওয়া খুশির মাতাল হাওয়া ঈদের মাতাল হাওয়া কিংবা অজস্র ঈদেল হাওয়া
এম এস আরেফীন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|