bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













চা দিয়ে চায়না
এম এস আরেফীন



চায়না, নামটা আমার আপনার কাছে চায়না হলেও চাইনিজদের কাছে এই নামটা খুব একটা প্রচলিত নয়। বরং তাদের কাছে তাদের দেশের নাম হচ্ছে “জোং গো” zhong guo. এই শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “মধ্য-দেশ” আর তাদের ধারনা উত্তরে মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়া নিম্নাংশ দক্ষিণে তাইওয়ান পূর্বে জাপান আর পশ্চিমে নেপাল পর্যন্ত সমস্ত জনগোষ্ঠীর জন্ম এই মধ্যদেশ বা চায়নাতে। সময়ের পরিক্রমায় মধ্যদেশের মানুষগুলো ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। উপরে বর্ণিত দেশগুলোকে মানচিত্রে চিহ্নিত করার পর আপনি নিজেও দেখতে পাবেন এই বলয়ের ঠিক মাঝখানে হচ্ছে চায়না মা মধ্য-দেশ। জোং মানে হচ্ছে মধ্য আর গো মানে দেশ। নিজের দেশের নামটা যেমন ঠিক সোদা ম্যান্ডারিন ভাষায় তেমনি অবাক করা বিষয় হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের জন্য ম্যান্ডারিন ভাষায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। আমরা যেমন কোরিয়াকে কোরিয়া, রাশিয়াকে রাশিয়া, ব্রাজিলকে ব্রাজিল বলি তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা তা নয়। তাদের অভিধানে বাংলাদেশের জন্য কোরিয়ার জন্য আমেরিকার জন্য ইংল্যান্ডের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে যেটা শুধু তারাই বুঝবে। যেমন বাংলাদেশকে তারা বলে মোংজালা, দক্ষিণ কোরিয়াকে তারা বলে হান গো, আমেরিকাকে বলে মেই গো, ইংল্যান্ড হচ্ছে ইং গো। জানলে অবাক হবেন, আমাদের কাছে চাইনিজদের ভাষার নাম হচ্ছে ম্যান্ডারিন আর তাদের কাছে তাদের ভাষার নাম পুথোংহোয়া। শুধু তাই নয় আমাদের ভাষায় চেয়ার টেবিল টিভি টেলিফোনের বাংলা থাকলেও আমরা যেমন প্রচলিত বাংলায় সেগুলোকে চেয়ার টেবিল টিভি টেলিফোন বলেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি তারা কিন্তু সেরকম নয়। তারা প্রতিটি বিষয় ও বস্তুকে তাদের ভাষাতেই প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যেমন ধরুন টেবিলকে তারা বলে জোজে, চেয়ারকে বলে ইজে, টেলিফোনকে তাদিনহোয়া আর টিভিকে ডিয়েন্সে, এমনকি কম্পিউটারকে আমরা অনেক ভাষাভাষীর লোকেরা কম্পিউটার বললেও তাদের কাছে সেটা ডিয়েনলাও৷ খুব ছোটবেলায় শুনেছি চাইনিজরা খুবই পরিশ্রমী জাতি আর এর পাশাপাশি যে কথা শুনে বড় হয়েছি তা হচ্ছে আলপিন থেকে এরোপ্লেন এর সবই তারা বানাতে জানে।

অফিসের কাজের সুবাদে এই দেশে মূলত সাংহাই আর গোয়াংজুতে গেছি বিশ পঁচিশ বার। তবে কাজের জন্য খুব অল্পকদিনের মিশনে গিয়েছি এবং সাতদিনের ট্রিপে চৌদ্দ দিনের কাজ চাপিয়ে পাঠায় তাই কাজ ফেলে ঘুরাফিরা একেবারেই হয়ে উঠেনা। আর অস্ট্রেলিয়ান হাই-কমিশনগুলো এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ যে খাবার কিনতেও বাইরে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। কুজিন স্পেশালিষ্ট শেফ আছেন কয়েকজন। যাই খেতে চান তা সে রাত বারোটায় হলেও বানিয়ে হাজির করবে। সেই কারণে অফিসিয়াল ট্রিপে সেই দেশটাকে ঘুরেফিরে দেখার সুযোগ হয়নি।

সবুরে মেওয়া ফলে, কথাটা সত্য, আর তাই আল্লাহ আমার সবুরের ফল দিয়েছেন। আল্লাহ মধ্য দেশে ঘুরে দেখার এমন ব্যবস্থা করলেন যে সেটাকে খোদ আমার শ্বশুরবাড়ি বানিয়ে ছাড়লেন। বিয়ের পরে ২০১৭ সালে প্রথম শশুরবাড়ি যাই। সেই ট্রিপে সাংহাই, বেইজিং, উহান, হেনান, ঝেনজোও, সিয়ান, গুয়াংজু ও সেনডং ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হইয়েছিলো। এতগুলো শহরের কারিশমা লিখতে গেলে ভ্রমণ কাহিনীর সিরিজ বের করতে হবে তাই সে পথে না হেঁটে একটা ভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখছি।

আমার শ্বশুরবাড়ি উহান, সেখানে পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনে একেবারে সোজা সাপটা বাংলা স্টাইলে দাওয়াত পেয়ে গেলাম। দাওয়াত সন্ধ্যায় ভেনুতে গিয়ে দেখি হোষ্ট সপরিবারে হাজির। আমি সেখানে পৌছাতেই আমার হাতে লাল মখমলের থলেতে হলুদ লাল ও গোল্ড কালারের কারুকাজ করা বেশ মোটা রিবন দিয়ে আটকানো একটা উপহার তুলে দেওয়া হলো। উপহারটা হাতে নিয়ে অনুভব করলাম ভেতরে কাঠের একটা মজবুত বাক্স। আমার পাশে দাঁড়ানো আমার অর্ধাঙ্গিনী ফিসফিস করে আমার কানে কানে বললেন - This is a expensive gift, keep it safe first. দামী গিফট পেয়ে মনে মনে পুলকিত হলাম।

পরের চার ঘণ্টা সবাই মজা করে দাওয়াতের বিভিন্ন ডিশ শেষ করেছি, আমার চোখ অবশ্য ঐ বাক্সেই আটকে ছিল। দাওয়াত সেরে বাসায় আসতে আসতে রাত অনেক হয়ে গিয়েছিলো। বাসায় ফিরে, মখমলের থলে থেকে কাঠের বাক্স বের করে খুলে আমিতো থ, একি! ভেতরে শুধু মাটি আর মাটি। ভাবলাম ভেতরে নিশ্চয়ই হীরা জহরত আছে, তাই খুড়তে লাগলাম! আমার অর্ধাঙ্গিনী বলে উঠলেন “আরে করছো কি, এটা কত দামী চা তোমার ধারনা আছে”। আমি বললাম এটাতো মাটি। সে বললো, না, এই চা খাবার দু ঘণ্টা আগে এই গুড়া গুড়া বস্তুর এক চামচ বাইরে রেখে শুকিয়ে নিয়ে পরে ফুটন্ত গরম পানিতে ছেড়ে দিয়ে চা বানাতে হয়। এই চায়ের ৫০০ গ্রামের দাম প্রায় ৩০০ ইউ এস ডলার! ভেজা ভেজা মাটির মত চা দেখে আর তার দাম শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম! জিজ্ঞেস করলাম এর এত দাম হবার কারণ কি? তিনি বললেন যে গাছের পাতা থেকে এই চা তৈরি সেই গাছ চায়নার একটি দুর্গম অঞ্চলে বৎসরে একবার ফলে। আর এই পাতা বের হয় বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে। পাতা বের হবার দশ দিনের মধ্যে পাতা সংগ্রহ করতে হয় কারণ দশ দিন পরে গাছ মরে যায় এবং পরের বছরের ফলনের জন্য দীর্ঘ ১১ মাসের অপেক্ষা করতে হয়।

আমি এখন যে দেশের বাসিন্দা এই দেশে যেহেতু এক বোতল পানির দাম এক গ্লাস বিয়ারের থেকে বেশী তাই এই দেশীয়রা পানির চেয়ে বিয়ার পান করাই শ্রেয় মনে করে। তেমনি চায়নাতে চা কালচার তাদের জীবনের সাথে এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে যে তারাও পানির বদলে চা পান করা শ্রেয় মনে করে। এখানে বলে রাখা ভাল, চায়নায় চা মানে হচ্ছে ফুটন্ত গরম পানিতে পাতা ছেড়ে দিয়ে সেই পাতার নির্জাস সমৃদ্ধ পানি অল্প অল্প চুমুক দিয়ে কয়েক ঘণ্টায় শেষ করা। জ্বী হ্যাঁ, শুনে অবাক হচ্ছেন কিন্তু চাইনিজরা এক ফ্লাস্ক চা কয়েক ঘণ্টা লাগিয়ে শেষ করে। ঐ যে বললাম পানির পরিবর্তে চা। আমাদের দুধ চা নামের পানীয়টা মুল চাইনিজদের কাছে ভিনদেশি একটি পানীয়। উত্তরপশ্চিম অঞ্চলের কিছু সংখ্যক চাইনিজ এই ধরনের চা পান করে থাকে, আর বাদবাকি ৯০% চাইনিজদের কাছে চা মানেই গরম পানিতে পাতার নির্জাস। ২০১৭ সালে চায়নার মোট যে আটটি শহরে ঘুরেছি সেখানে কমন যে বিষয়টি নজরে পড়েছে তা হচ্ছে, সবার হাতে বা ব্যাগে এমনকি কোমরের বেল্টের সাথে সেটে আছে একটি ছোট্ট থার্মাল ফ্লাস্ক। সেই ফ্লাস্কে আছে চা। একটু পর পর সবাই সেই ফ্লাস্কে চুমুক দিয়ে চা পান করে। এখন প্রশ্ন আসে ছোট্ট ফ্লাস্কে আর কতটুকুই বা চা আটে, আর এই চা খোর জাতির মানুষদের কি ঐ ৬০০/৭০০ মিঃ লিঃ ফ্লাস্কের চায়ে সারাদিন পার হয়? বাসা থেকে আনা চা ফুরিয়ে গেলে তারা কি করে? উত্তর হচ্ছে আবার বানিয়ে নেয়। তাদের সবার ব্যাগে অথবা পকেটে চায়ের গুড়োর পুড়িয়া সবসময়ই থাকে, আর রাস্তা ঘাটে বিশেষ করে ট্রেন ষ্টেশনে, বাস টার্মিনালে, জাহাজ বা বিমান বন্দরে, শপিং মলে এমনকি বড় শহরের পাবলিক টয়লেটে আছে boiling water dispenser. সেই যন্ত্রের নীচে ফ্লাস্ক ধরে কলের বোতাম চাপ দিলেই গরম পানি বের হয়ে আসে। বিনা মূল্যে ফুটন্ত গরম পানি! আমরা এমন এমন জায়গায়ও গেছি যেখানে পাবলিক টয়লেট নেই কিন্তু boiling water dispenser ঠিকই আছে। এমনকি ট্রেন/বাসের ভেতরও এই যন্ত্র ফিট করা। পথে ঘাটে যেখানে সেখানে এই যন্ত্র থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে, চাইনিজরা সাধারণত রুম টেম্পারেচার ওয়াটার বা যেটাকে আমরা নরমাল ওয়াটার বলি সেটা তারা পান করেনা। তারা সবসময় কুসুম কুসুম গরম পানি পান করে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, শরীরের ভেতরটা সবসময় উষ্ণ, তাই শরীরের তন্ত্র ও প্রণালীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে উষ্ণ পানি পান করা উচিত কারণ দেহের বাইরে থেকে হঠাৎ শীতল পানি দেহে প্রবেশ করলে শরীরের ভেতরে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে। তাদের কথায় যুক্তি আছে আর এই জন্যই আপনারা চায়নায় বেড়াতে গেলে দেখতে পাবেনঃ
১. তাদের যেকোনো অনুষ্ঠান পালা-পার্বণ বা দাওয়াত শুরই হয় চা পর্ব দিয়ে।
২. তারা সবসময় চা খাচ্ছে।
৩. তারা সবসময় উষ্ণ পানি পান করে থাকে।
৪. হোটেল/রেস্তোরাঁয় ছোট্ট কাপে উষ্ণ পানি বা চা পরিবেশন করা হয়।

উষ্ণ পানি পানের কথায় একটা ঘটনা মনে পরে গেল, সেটা দিয়েই শেষ করি। আমি বাংলাদেশী, গরমের দেশের মানুষ, তাই আমাদের দেশে ঠাণ্ডা পানি পানের প্রচলন খুব বেশী। রোজার সময় ইফতারে হিম শীতল পানি ঢক ঢক করে খাওয়া আমাদের কালচার। তেষ্টা পেলে দু এক গ্লাসে আমার কিছুই হয়না, আমার তেষ্টা মেটাতে এক বসায় নিদেন পক্ষে চার গ্লাস পানি লাগে। এই চার গ্লাস পানি পিনেওয়ালা আমি গাড়িতে বসে আছি, সাথে স্ত্রী পুত্র, শ্বশুর শাশুড়ি এক চাইনিজ মুসলিম দুলাভাই ও তার পুরো পরিবার। মোট ছয় ঘণ্টা জার্নি করে আমরা একটা হোটেলে থামলাম দুপুরের খাবারের জন্য। তেষ্টায় আমার বুক জ্যৈষ্ঠমাসের ফাটা কাঠ হয়ে আছে। হোটেলে ঢুকেই ওয়েইট্রেস কে খাস ম্যান্ডারিনে বললাম, - ও সিয়াং হো সোই, মানে আমি পানি পান করতে চাই। ওয়েইট্রেস একটা ছোট্ট কাপে পানি দিলেন, যা মুখে দিতেই জিহ্বা পুড়ে একেবারে কালা ভুনা হয়ে গেলো। আবার গেলাম। এবার ওয়েইট্রেসকে বললাম, - ও বুই হো কাই সোই, মানে আমি ফুটন্ত গরম পানি পান করিনা, একটু পরে সে আমাকে পানি দিলো, আবারো সেই ছোট্ট কাপে, সেই পানি মুখে দিয়ে দেখি এবারো গরম তবে তাপমাত্রা কম। এদিকে তৃষ্ণায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে আর তারা আমার ফাটা ছাতির উপর উষ্ণ পানি ঢেলেই যাচ্ছে তাও আবার ফোটায় ফোটায়। এবার গিয়ে বললাম - ও সিয়াং হো দো বিন সোই। মানে হচ্ছে আমি এক বড় জগ শীতল পানি পান করতে চাই। এবার সেই ওয়েইট্রেস এক জগ পানি নিয়ে আসলেন। তাকিয়ে দেখি জগের ভেতর বরফ ভাসছে। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ঐ ওয়েইট্রেসের সামনেই ঢক ঢক করে পুরো জগ শেষ করলাম। জগের ভেতরের বরফগুলোও দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খেলাম। ঠাণ্ডা পানির জগ মুখে তুলার পর থেকে দাঁত দিয়ে বরফ ভাঙা অবধি আমার হুশ ছিলনা। চোখ বন্ধ করে ঠাণ্ডা পানি খাচ্ছিলাম। পানি পান শেষ করে চোখ খুলে দেখি আমার সামনে হোটেলের ওয়েইটার, ওয়েইট্রেস ও ম্যানেজারের একটি দল, প্রায় আট দশজন হবে, সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর ভাবছে কে এই চিজরে বাবা, কোন গ্রহের মানুষ! এক নিঃশ্বাসে এই বরফ শীতল পানি শেষ করলো! তাদের একজন একেবারে খাস ইংরেজিতে আমাকে জিজ্ঞেসই করে বসলো - Where are you from?




এম এস আরেফীন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 31-Jan-2022

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far