বিদায় আলির ঈদ এম এস আরেফীন
দরাজ আলি মাতব্বর, এই নামটা এখন তার নিজের কাছেও খুব অপরিচিত মনে হয়। গত চৌত্রিশ বৎসর আজিমপুর এলাকায় তার একটাই নাম, বিদায় আলি। কিভাবে যেন তার আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবরাও এই নাম জেনে যায় আর তার সর্বজন-বিদিত নাম হয়ে যায় বিদায় আলি। বিষয়টা তার খুবই অপছন্দ কিন্তু তার কাজটাই যে এই রকম তাই জোর গলায় তার আসল নাম জারি রাখার বিষয়ে সে আর জোর-জবরদস্তি করেনি। সেই থেকে তার নাম বিদায় আলিই হয়ে গেল। তবে তার শঙ্কা তার মৃত্যুর পর সবাই তাকে বিদায় আলি নামেই জানবে। আর সে সেটা চায় না, তাই যদিও কবরে নাম ঝুলানো নাকি শরিয়তের খেলাফ তাও সে তার এপিটাফ তৈরি করে রেখেছে আর তার ছেলেকে বলে রেখেছে সে মারা গেলে তার কবরে যেন এই সাইন-বোর্ডটা টাঙিয়ে দেয়। সেই সাইন-বোর্ডে বড় বড় বাংলা ও ইংরেজি হরফে লেখা “দরাজ আলি মাতব্বর”।
বিদায় আলি - এই উদ্ভট নামের পেছনে কারণও আছে। সে গত চৌত্রিশ বছর ধরে আজিমপুর কবরস্থানের পাশে মরদেহ সৎকার্য করার ব্যবসা চালিয়ে আসছে। তার দোকান চির বিদায় ষ্টোরে কাফনের কাপড়, মরদেহের বাক্স, আতর, গোলাপজল, কর্পূর, গোসল দেনেওয়ালা থেকে শুরু করে মানুষ মারা যাবার পর যা যা প্রয়োজন তার সবই পাওয়া যায়। তার বাবা আরজ আলি মাতব্বর এই দোকান চালু করেন। ব্যবসা শুরু করার ছয় বছরের মধ্যে বাবা চির বিদায় নেন। এর পর থেকে চির বিদায় ষ্টোরের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান দরাজ আলি ওরফে বিদায় আলি। মৃত্যুর দোকান যেমন ২৪ ঘণ্টা খোলা, যে কোন সময় যে কারো মৃত্যু হতে পারে তেমনি চির বিদায় ষ্টোর ২৪ ঘণ্টাই খোলা বলা চলে। দোকানের ঝাঁপি উঠে সকাল সাতটায় আর বন্ধ হয় রাত দশটায়। আর রাত দশটার পর অন-কলে থাকেন বিদায় আলি। মানে ২০০৬ সালের আগে রাত দশটায় দোকান বন্ধ হবার পর তার দোকানের শাটারে লেখা থাকতো, “মৃতের দাফন কাফনের কাজের জন্য রাস্তার ওপাড়ে সিতারা হোটেলের ম্যানেজারের কাছে খোঁজ করুন”।
সিতারা হোটেল বছরের ৩৬৫ দিনই ২৪ ঘণ্টা খোলা। রাত বারোটার পর থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত স্পেশাল বিরিয়ানি “মাতাল বিরিয়ানি” বিক্রি চলে। এই বিরানির স্বাদে এক ধরনের মাতালতা আছে। একবার খেলে বার বার খেতে মন চায়। তাই সপ্তাহে সাত দিনই তাদের এই চার ঘণ্টার স্পেশাল সার্ভিস খুব ভাল চলে আর বিশেষ করে বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার রাতে বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়। যারা এখানে এসে বসে খেতে পারেনা তাদের জন্য হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে। সিতারা হোটেলের এই মাতাল বিরিয়ানি এতটাই বিখ্যাত যে ঐ দিকে নিউ মার্কেট ধানমণ্ডি আর এই দিকে সদরঘাট পর্যন্ত এর পার্সেল কাষ্টমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই দোকানের রাতের শিফটের ম্যানেজার বিদায় আলির বাসার ঠিকানা জানেন। তাই রাত-বিরাতে যখন বিদায় ষ্টোর বন্ধ থাকে তখন সিতারা হোটেলের মতিন মিয়াই ভরসা। মতিন মিয়াকে বললেই বিশ মিনিটের মধ্যে বিদায় আলির দেখা মেলে। আর বিদায় আলি চলে আসলেই আধা ঘণ্টার মধ্যে মৃতের সব কাজের ব্যবস্থা হয়ে যায়। বিদায় আলির মত এত তড়িৎ সেবা আর কেউ দিতে পারেনা তাই অত্র এলাকায় খুব দ্রুতই তার নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে। আর তার সাথে যাদের বেশি খাতির ও চেনা পরিচয় তাদের ক্ষেত্রে স্পেশাল প্রাইস অফার করে বিদায় আলি।
২০০৬ সালে বিদায় আলি একটা মোবাইল কিনলো। আর এরপর থেকে মতিন মিয়ার উপর ভরসা করা লাগেনা। মোবাইলটা কেনার পর বিদায় আলি ঢাকার সব বড় বড় সরকারি হাসপাতালের মর্গে আর বড় বড় সব প্রাইভেট হাসপাতালে কন্ট্যাক্ট সেট করলো। এতে করে বিদায় আলির ব্যবসায় কিছুটা জোয়ার আসলো। কিন্তু গত চৌত্রিশ বছরে দরাজ ওরফে বিদায় আলি কখনোই আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেননি, - হে আল্লাহ মানুষের মৃত্যু দাও আর আমার ব্যবসা ভাল হোক। তার ব্যবসা নিম্ন স্তরের হলেও তার নীতি খুব সুউচ্চ ও পরিষ্কার। অন্যের ক্ষতি করে নিজের লাভের কথা সে জীবনে কোনদিনও মনে আনেনি। এমনকি সে কোন বিষয়ে ভেজালও দেয়না।
এই ব্যবসায়ও ভেজাল আছে। ২০০৯ সালের কথা, হঠাৎ করে তার দোকানের ঠিক উল্টা পাশে আরো একটা নতুন দোকান উঠলো। নাম ছিলো শেষ দিন ষ্টোর। সেই দোকানের মালিকের সাথে তেমন কথাবার্তা বা পরিচয় ছিলনা তবে লোকটা খুব একটা সুবিধার ছিলনা। এই ব্যবসায় তেমন রকম ফের নেই, কারণ মাল সামান সব একই রকম, কাফনের কাপড়, গোলাপজল, আতর, আগরবাতি, মোমবাতি, ফুলের মালা বা ফুলের চাদর, কবরের সাইন-বোর্ড। এর পাশে গোসল দেনেওয়ালা আর কবরের দোয়া খায়েরের জন্য মৌলভী। ভিন্নতার মধ্যে কেউ কেউ যেটা চায় তা হলো খুব ভাল কোয়ালিটির আগরবাতি গোলাপজল আর আতর। আর যেহেতু কাফনের কাপড়ের কোন ব্র্যালন্ড হয়না তাই এত ঝামেলাও নাই। শুধু মাঝে মাঝে কিছু খদ্দের আসে কাবার মানে মক্কা শরিফের কাফনের খোঁজে। যেহেতু তার কাছে এটা নেই তাই সে লোক ঠকায় না। কিন্তু শেষ দিন ষ্টোরের মালিকের দোকানে কাবা শরিফের কাফনের কাপড় পাওয়া যেত। একদিন কৌতুহল বশে সে সেই দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করলো সে কিভাবে এই কাপড়টা পায়। সৌদিতে কারো সাথে চেনা জানা আছে কিনা। উত্তরে সে বলে - আরে ধুর মিয়া আমার বাপ দাদার কেউ সৌদি গেছেনি। ইচ্ছা থাকলে সৌদির কাফনের কাপড় এইখানেই বানানো যায়। একটা বড় বালতিতে পানি নিয়া ঐখানে যম যমের পানি মিশাইবেন আর দিবেন আসল মেস্কেম্বার আতরের দুই ফোঁটা। এরপর ঐ পানিতে কয়েক পিস দেশি কাফনের কাপড় ভিজায়া রাখবেন দুই তিন ঘণ্টা। এরপর রোদে শুকায়া ভাজ কইরা একটা বিদেশী প্লাস্টিক যেইটাতে আরবীতে লেখা কাফনের কাপড় ঐ মোড়কে ঢুকায়া দিবেন ব্যাস হয়া গেল কাবা শরিফের কাফনের কাপড়। শুধু এই বিষয় না আরো অনেক ব্যাপারে এই লোক অনেক দুই নম্বরী করতো। তাই তার ব্যবসাও বেশিদিন টিকলোনা। ২০১৪ এর দিকে একদিন সকালে পুলিশের রেইড পড়লো। সেইদিন সেই দোকানের ভিতর থেকে তিন হাজার বোতল ফেন্সিডিল পাওয়া গেলো। এইজন্যই তো দরাজ আলি ভেবে কুল পেতোনা, ঐ দোকানে সবসময় ইয়াং পোলাপানের এত ভিড় কেন? দোকান বন্ধ হবার দিন টের পেলো।
এই একটা ব্যবসা যার কোন সিজন নাই। সারা বছর একই মাপের বিক্রি বাট্টা। বিষয়টা তো আর ভালুক জ্বর না যে মৌসুম বদলের সময় বেশী হবে বা সর্দি কাশিও না যে শীতের সময় বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে। আবার সে তো ঠাণ্ডা আইসক্রিমও বিক্রি করেনা যে শীতের কালে কাটতি কম। বিষয়টা মৃত্যু। সারা বছর একই রকম বেচা কেনা। তবে দেশে জনসংখ্যা বাড়তি হবার কারণে আর গ্রাম গঞ্জ থেকে যে হারে মানুষ প্রতিদিন ঢাকা শহরে আসছে সেই কারণে আগের থেকে বিক্রি বেশী হয়। দরাজ আলি এই জীবনে কোনদিন নিজের বিক্রি বেশি হবার জন্য অন্য মানুষের মরণ কামনা করেনি। তবে আল্লাহর হিসাব দেখে দরাজ আলি তাজ্জব বনে যায়। জীবনে কোনদিন ভাবেনাই তার ব্যবসাও একদিন বাম্পার হবে। করোনা মহামারী হওয়ার কারণে তার ব্যবসায় যে জোয়ার বইতে শুরু করলো তা আর থামার নাম নেই।
আজ ঈদ। ঈদ মানেই খুশী, ঈদ মানেই আনন্দ। আর আজ দরাজ আলি ওরফে বিদায় আলির মনে খুশীর কমতি নেই। আজ সে তার স্ত্রী, বড় ছেলের পরিবার, ছোট মেয়ের পরিবার, ছোট ছেলে আর নাতী নাতকরদেরকে সাথে নিয়ে তার নতুন কেনা ফ্ল্যাটে একসাথে ঈদ করছে। এই ফ্ল্যাট কিনেছে সাত রোজায়। এই শহরে তার নিজের একটা মাথা গুজার ঠাঁই। এই জীবনে দরাজ আলি নিজেকে সফল মনে করেন। নিজের বুদ্ধি বিবেচনা সততা কাজে লাগিয়ে তার দোকানের দুটা নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছেন, একটা বনানী কবরস্থানের পাশে আর আরেকটা মিরপুর কবরস্থানের পাশে। বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওকালতি পাশ করেছে, নিজের চেষ্টা চরিত্রে ছেলেটা একটা পি.এইচ.ডি স্কলারশিপ যোগাড় করেছে। করোনা পরিস্থিতি বাগে আসলেই সে উড়াল দেবে। ছোট বেলা থেকে ছোট ছেলের একটাই কথা ব্যবসা করবে। আর সেই উদ্দেশ্যে সে পয়সা জমিয়ে আসছে, তার মেট্রিকের পর থেকে গত নয় বছরে তার টিউশনির প্রতিটা টাকা সে জমিয়েছে ব্যবসার জন্য। সে এখন একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। সেই বেতনের সব টাকাই জমাচ্ছে। আর ঐদিকে ওর দুই বন্ধুর সাথে মিলে ব্যবসার প্ল্যান করছে। সবার ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর আগে। মেয়ের জামাই ইঞ্জিনিয়ার। বেশ বড় কোম্পানিতে ম্যানেজার পদে আছে। বেশ ভারি মাইনে তার।
সফলতার ষোল কলা দরাজ আলির জীবনে কোনভাবেই পূর্ণ হচ্ছিল না। কারণ এই এক ফ্ল্যাট কেনার জন্য সে পয়সা জড়ো করছে প্রায় বিশ বছর ধরে। একটু একটু করে জমায় আর ওদিকে ফ্ল্যাটের দামও অল্প অল্প করে বাড়ে। গত চার বছর ধরে নিজের মনের মত একটা ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সাধ্যের সাথে সাধের সমন্বয় হচ্ছিল না। একমাত্র করোনার কারণে ব্যবসায় জমজমাট ভাব আসে আর সেই সুবাদে হুহু করে টাকা কামাতে থকেন দরাজ আলি। চোখের নিমিষে এক বছরের মধ্যে হাতে অনেকগুলো টাকা চলে আসে। আর সেই টাকাগুলো একসাথে করেই এই রোজায় এই ফ্ল্যাট কিনলেন দরাজ আলি।
ঈদের দুপুরের লম্বা ঘুম শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে নতুন ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে বসলেন দরাজ আলি। ঘরের ভেতরে হুলুস্থুল অবস্থা। সবাই মিলে বিকালের নাস্তা বানাচ্ছে। আজ রাতে সবাই মিলে বাইরে যাবে খেতে, সেটাই প্ল্যান। একটু পরেই তার মেয়ে বারান্দায় এসে এক কাপ চা রেখে গেলো। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দরাজ আলি তার দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন ঐ অবারিত খোলা নীল আকাশের দিকে। নিজের মনের অজান্তেই তার দু’চোখ ভিজে আসলো আর তিনি মনে মনে বললেন - ধন্যবাদ ইয়া আল্লাহ আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি আছেন আর আপনি যে সবার দিকেই নজর দেন সেই বিশ্বাস আজ আরো সুদৃঢ় হলো।
 এম এস আরেফীন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|