অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ ড. অনিতা জাহিদ
নানা রং, রূপ এবং গন্ধের ফুলের সমারোহে যেমন গড়ে ওঠে মনোমুগ্ধকর বাগান, তেমনি নানা ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের মানুষের নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থানেই গড়ে ওঠে একটি সুষম সমাজ। এই বৈচিত্র্যের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমেই একটি সমাজ তথা একটি দেশ বা জাতির প্রকৃত উন্নতি ও প্রগতি সাধন সম্ভব। নানা বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য।সাহিত্যিক লিও টলস্টয় বহু বছর আগে বলেছিলেন, একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে সে দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মের নামে লড়াই লাগিয়ে দিলেই চলবে। আর তাই সাম্প্রদায়িকতার দুষ্ট প্রবণতা থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়া এবং সবাই কে এব্যাপারে সচেতন করে তোলাটা অত্যন্ত জরুরী। তবে, এই কাজটির দায়ভার শুধু সরকারের উপর ছেড়ে দিলেই চলবে না, এক্ষেত্রে দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে সকল সচেতন মানুষকেও।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া (RUAAA – রুয়া) একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘রুয়া’ অস্ট্রেলিয়া-কেন্দ্রিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সফলতার সাথে পরিচালনা করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যার আওতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে 'আসুন আমরা আবর্জনা এবং সাম্প্রদায়িকতা দুটোই এখানে ফেলি' এই স্লোগান সম্বলিত ডাস্টবিন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মূলত দুইটি ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে রুয়া এই উদ্যোগটি গ্রহণ করে।এক- যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলে পরিবেশ রক্ষার্থে নির্দিষ্ট স্থানে আবর্জনাসমুহ ফেলতে ছাত্রছাত্রীর উদ্বুদ্ধ করা এবং দুই- মনের সাম্প্রদায়িক আবর্জনাকেও কাল্পনিক ডাস্টবিনে বিসর্জন দেওয়া।
সংগঠনটির সভাপতি জুলফিকার আহমেদ জানান , “সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে দেশের আপামর জনগণের ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে একটা গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প ছড়াচ্ছে। তাই আমাদের উদাত্ত আহবান, আসুন আমরা ধর্ম, বর্ণ, জাতি এবং রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে সবাই মিলে আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করি।”
রুয়ার সাধারণ সম্পাদক তারিক জামান বলেন , “বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশ আমাদের অনেক দিয়েছে। এখন আমাদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের ঋণ কিছুটা হলেও ফেরত দেওয়া। তাই এই উদ্যোগ নেওয়া।”
এই উদ্যোগের আওতায় গত ১৯শে এপ্রিল ২০২২ এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে রুয়ার দেওয়া আটটি ডাস্টবিনের স্থাপন করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার এবং উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম আনুষ্ঠানিক ভাবে এই ডাস্টবিনের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মোঃ. জাকারিয়া, প্রকটর অধ্যাপক আসাবুল হক প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বক্তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করেন। তাদের মতে - আবর্জনা যেমন ক্যাম্পাস ময়লা করে, তেমনই সাম্প্রদায়িকতা মানুষ ও সমাজ দূষিত করে। বক্তারা সাম্প্রদায়িকতাকে মন থেকে আবর্জনার মতো করে ছুঁড়ে ফেলার কথা উল্লেখ করার মাধ্যমে ময়লা এবং সাম্প্রদায়িকতা দুটোকেই আবর্জনা হিসেবে আবর্জনার পাত্রে ফেলে দেয়ার আহবানও জানান।
উদ্বোধনের পর উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার উল্লেখ করেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলামানাই অ্যাসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, “আবর্জনা যেমন আমাদের ক্যাম্পাসকে ময়লা করছে, তেমনই সাম্প্রদায়িকতা মানুষকে এবং সমাজকে দূষিত করছে। তাই এই দুটোকে যদি এখানে ফেলতে পারি তাহলে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবো। বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন সেটা গড়ে উঠবে। তাহলে বাংলাদেশ সকল মানুষের হবে, মানবিক হবে এবং জনতার হবে।”
রুয়ার এই উদ্যোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সাম্প্রদায়িকতা একটি অশুভ প্রবণতা যা সামাজিক সহনশীলতাকে নষ্ট করে ফেলে। ভিন্ন ধর্ম বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিষোদগার, বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ, অশ্রদ্ধা কখনো নিজ ধর্মের মাহাত্ম্য বাড়ায় না। বরং এর মাধ্যমে আপন ধর্মেরই সম্মানহানি হয়। একজন প্রকৃত ধার্মিক কখনো ভিন্ন ধর্মকে অশ্রদ্ধা করতে পারেন না। উপরন্তু বলা হয়ে থাকে যে, একজন ব্যক্তি নিজ ধর্মের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল তা পরিমাপের সবচেয়ে সহজ মানদণ্ড হলো তিনি পরধর্মের প্রতি কতটা উদার মানসিকতা-সম্পন্ন। বর্তমান সময়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাম্প্রদায়িকতা থেকে দূরে রাখার জন্য রুয়ার এই উদ্যোগ সকলকে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে আরও বেশী সচেতন করে তুলবে এবং আরও নতুন উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী করে তুলবে বলে আশা করা যায়।
ড. অনিতা জাহিদ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া |