"এর পর সৌম্যজিত দাস শুরু করলেন একটি গুজরাটি ভজন। সমস্যাটি দেখা দিল তখনি।"
আমার মা ছিলেন উত্তর বঙ্গের গ্রামের মেয়ে। বাংলা গানের জগতে তিনি আব্বাস উদ্দিন, ফেরদৌসি রহমান, আব্দুল লতিফ আর আব্দুল আলিম অতিক্রম করতে পারেন নি। রবীন্দ্র সঙ্গীত মোটেই পছন্দ করতেন না তিনি। তার ছেলে হয়ে আমি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে রাজশাহী শহর ছেড়ে পালাবার সময় এক দরিদ্র কৃষকের ভাঙ্গা গোয়াল ঘরে বসে আকাশবাণী কোলকাতা রেডিওতে "এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে" গানটা শুনে কেঁদেছিলাম। মনে হলো রবীন্দ্রনাথ আমাদের কথাই বলছেন। কতইবা বয়স তখন! কি হচ্ছে ভাল করে বুঝতে পারছিনা। কি হবে জানি না। সারাদিন পেটে দানা-পানি পড়েনি। দলে দলে মানুষ মাঠ-ঘাট পেরিয়ে কোথায় চলেছে তারো কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। এটা কি গান শোনার সময়! সেদিন সংবাদের পরপরই আকাশবাণী এই গানটা কেন বাজিয়েছিল কে জানে! এর পর রবীন্দ্রনাথের যে গানটা আবিষ্কার করেছিলাম সেটা হলো, "ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা"। সদ্য স্বাধীন দেশ। চারিদিকে বিজয়ের উল্লাস আর দেশ প্রেমের আর্তি। তার মধ্যে এমন একটি গান! আমি ধীরে ধীরে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত হয়ে উঠলাম। দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সাদি মোহম্মদ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সিরাজুস সালেকিন কত কত শিল্পীরা দিনে দিনে প্রিয় হয়ে উঠেছে আমার। শ্রাবণী সেন এই প্রিয় শিল্পীদের তালিকায় একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি সিডনি আসছেন শুনেই দিন গুনছিলাম। কবে আসবে সেই প্রতীক্ষিত দিন! কিন্তু স্ত্রী বাদ সাধলেন, "ঐ দিন তো অনুষ্ঠানে যাওয়া হবে না, মেয়ের শশুড়-বাড়ীতে দাওয়াত আছে, না গেলে চলবে না"। মেয়ের শশুড় বাড়ি বলে কথা । "আমি যেতে পারবোনা, তুমি একা যাও"। পারিবারিক দায়িত্ব স্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে ছুটতে ছুটতে হাজির হলাম পেনেন্টহিল কমিউনিটি সেন্টারে। ৬ টার সময় অনুষ্ঠান। রোববার সন্ধ্যা। পরদিন অফিস আছে। অনুষ্ঠান সময় মত শুরু হবে। প্রায় সাড়ে ৬ টার দিকে হলে পৌঁছে দেখি অনুষ্ঠান তখনো শুরু হয় নি। বুঝলাম অনুষ্ঠান দেড়িতে শুরু হবার কিছু সুবিধাও আছে।
হল ভর্তি মানুষ। একদম সামনের সাড়িতে একটা সিট পেয়ে গেলাম। সৌভাগ্য আর বলে কাকে! আরাম করে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, কখন শুরু হবে অনুষ্ঠান। প্রথমেই আয়োজক সংগঠন "সিডনি উৎসব" এর একজন প্রধান কর্মকর্তা, আশীষ বাবলু মঞ্চে এসে শ্রাবণী সেন এবং তার সাথে অন্য যারা এসেছেন, সৌম্যজিত দাস, সৌরেন্দ্র মল্লিক, মহুল চক্রবর্তী এবং বিশ্বজিত রায় সম্পর্কে অনেক কিছু বললেন। গান শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি বলে মাথায় বেশী কিছু ঢোকেনি। ইন্টারনেট ঘেঁটে আবার দেখে নিতে হবে। শিল্পীরা একে একে মঞ্চে এলেন, মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে। সবার শেষে এলেন শ্রাবণী সেন।
"শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে" গানটি দিয়ে শ্রবণী সেন শুরু করলেন অনুষ্ঠান। আহা - গানের কথা, সুর, কণ্ঠ সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল! এর পর সৌম্যজিত দাস শুরু করলেন একটি গুজরাটি ভজন। সমস্যাটি দেখা দিল তখনি। গানের জগতে আমার বিচরণ কখনো উচ্চমার্গে পৌঁছোয় নি। ছোটবেলায় গান বলতে বুঝতাম, "তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়" জাতীয় ঢাকার বাংলা সিনেমার গান। তারপর কোলকাতার আধুনিক গান হয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত। এরপর আর এগুতে পারি নি। এগুতে চাইও নি মনে হয়। "তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা" ভেবে এখানেই পড়ে রয়েছি এতকাল। বৈষ্ণব পদাবলী, ভজন, ঠুমরী, খেয়াল, ভোজপুরি, বন্দিশ কোনটা কি তা ভাল করে বুঝে উঠতে পারিনি এখনো। এসব গান যদি আবার অন্য ভাষায় হয় তাহলে তো আরেক বিপদ। সৌম্যজিত হাত নেড়ে নেড়ে মাথা দুলিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় ভজন শোনাতে লাগলেন। আমার পাশের শ্রোতাকে দেখলাম চোখ বুজে গানের তালে তালে মাথা নাড়ছেন। ছাত্র-জীবনে ABBA আর Bony M এর গানের কথা না বুঝে শুধু মিউজিক আর বিটের সাথে হাত পা ছুড়ে ছুড়ে নাচতাম। ভাবলাম অসুবিধা কি। আমিও ভজনের সাথে ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগলাম। একে তো ভাষা বুঝিনা, তারপর আবার সৌম্যজিত মাঝে মাঝে দ্রুত লয়ে সা গা রে মা, মা পা ধা নি জাতীয় কিছু গাইতে লাগলেন।
ছোটবেলায় খেয়াল টেয়াল শুরু হলেই তাড়াতাড়ি রেডিও বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু হলের মধ্যে তো তা করা যায় না। ভাবলাম শ্রাবণী সেন সাথে করে এনেছেন, পাশে বসিয়ে গাইতে বলছেন। নিশ্চয় ভাল কিছু হবে। আমি একটু মনোযোগ দিয়ে সৌম্যজিতের ভজন শুনতে লাগলাম। হঠাৎ কি যেন ঘটে গেল! গানের সুর আর ভক্তি ভাষাকে অতিক্রম করে গেল। মনে হলো আমি যেন গানের কথাগুলো বুঝতে পারছি! সুরের সার্বজনীন আবেদন সত্যিই বিস্ময়কর! গুজরাটি ভজন ভাল লাগতে শুরু করলো আমার!
এরপর শ্রাবণী সেন গাইলেন, "মধুর ধ্বনি বাজে", "একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ", সৌম্যজিত গাইলেন একটি রাগ ভিত্তিক গান। এভাবেই কখনো শ্রাবণী সেনের কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত কখনো সৌম্যজিতের কণ্ঠে ভজন, গজল, ঠুমরী। বাংলার সাথে সম্ভবত: ভোজপুরি মিশিয়ে নতুন ভাবে গাইলেন তারা আমাদের অতি পরিচিত সেই "খর বায়ু বয় বেগে" গানটি।
এভাবে গানে গানে কিভাবে গড়িয়ে গেল সময় কেউ বুঝতে পারিনি - তাই শ্রাবণী সেন যখন অনুষ্ঠানের শেষ গানের কথা বললেন তখন হল ভর্তি মানুষ না না করে উঠেছিল। আমরা আরো শুনতে চাই।
শেষ হলোনা অনুষ্ঠান - আরো বেশ কয়েকটি গান শোনালেন গুণী শিল্পী-দ্বয়। শ্রাবণী সেন গাইলেন, "তুমি রবে নীরবে", "চরণ ধরিতে দিও গো আমায়"। সৌম্যজিত গাইলেন একটি হিন্দি ঠুমরী, আওগে জব তুম শাজনা"
অনুষ্ঠানের শেষ উপস্থাপনাটি ছিল সত্যিই চমৎকার। রাগ ভৈরবী'র উৎপত্তি ইরানে। সেখান থেকে কিভাবে এই রাগ ভারতবর্ষে এলো, ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে এই রাগের রূপ কেমন তা নিয়ে সৌম্যজিতের গবেষণা মূলক কাজটি সঙ্গীতের প্রতি তার গভীর অনুরাগ এবং তার শিল্প সাধনার পরিচয় বহন করে। ভারতের সঙ্গীত গুরুরা এই রাগটিকে প্রথমে বর্জন করেছিলেন। তখন এটি স্থান পায় উত্তর ভারতের বাইজী সমাজের কোঠার গানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই রাগ কে সেখান থেকে তুলে এনে বসান পূজার আসনে। এই বিষয়গুলি খুব সুন্দর ভাবে তুলে এনেছেন সৌম্যজিত তার বক্তব্যে এবং পরিবেশনায়।
ভৈরবী রাগে সৌম্যজিতের গান শুনতে শুনতে শৌনক চট্টোপাধ্যায় এর কথা মনে পড়ে গেল। গত বছর মে মাসে এই হলে বসেই তিনি ভোজপুরি বন্দিশ এর সাথে বেশ কিছু রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের রাগ-আশ্রয়ী গান শুনিয়েছিলেন। গানের ভুবনে নতুন কিছুর আভাস পেয়েছিলাম সেদিন। আজ আবার নতুন করে তা পেলাম। বলতে লজ্জা নেই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বংশধর প্রখ্যাত সরোদ বাদক তানিম হায়াত খান স্থায়ী ভাবে সিডনি আসার আগে উপমহাদেশের রাগ ভিত্তিক যন্ত্র-সঙ্গীত সামনা-সামনি বসে শোনার সুযোগ কখনো হয়নি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জগতে খুব ঢুকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু জ্ঞানের অভাবে আরষ্ঠ হয়ে থাকি। দুই বাংলার অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এখন সিডনিতে আছেন তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ - মাঝে মাঝে শ্রোতার আসরের আয়োজন করুন। যেখানে রাগ-রাগিণী নিয়ে কথা হবে। কীর্তন, ভজন আর বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে পার্থক্য কি তা নিয়ে আলাপ হবে। খেয়াল হবে। গজল হবে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন শ্রোতা।
সিডনি উৎসবকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই সুন্দর একটি সন্ধ্যা উপহার দেবার জন্য।
আনিসুর রহমান, সিডনি
Share on Facebook               Home Page             Published on: 30-Mar-2017