ফেইসবুক, বাংলাদেশ সরকার এবং রাজার ঘণ্টা আনিসুর রহমান
অনেকেই ফেইসবুক পছন্দ করেন না। এখানে নিজের ছবি প্রচারের বাহুল্য দেখে আমার নিজেরও এটাকে নারসিসিজম এর আখড়া মনে হতো। তবে বেশ কিছুদিন থেকে ধীরে ধীরে সে ধারনা পাল্টাতে শুরু করেছে। তার একটি প্রধান কারণ ফেইসবুকের "Public Service Innovation Bangladesh" নামে একটা গ্রুপ। আমার ছোট ভাই বাংলাদেশের একজন সরকারী কর্মকর্তা। সেই সুবাদে এই গ্রুপের সাথে পরিচয়। মাঝে মাঝে চোখ বুলাই। ফেইসবুকে "Public Service Innovation Bangladesh" সার্চ করলে দু'টো লিংক পাবেন। যেটাতে সদস্য ১১ হাজারের ওপরে সেটি দেখুন। এটি বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মুক্ত আলোচনার একটি মজার প্লাটফরম! এখানে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সাধারণ মানুষের দেয়া স্ট্যাটাসের নিচে প্রায়ই ডিসি, কমিশনার, সচিব এবং মন্ত্রী প্রতি-মন্ত্রীদের কমেন্ট দেখা যায়। এর ফলে আগে যে সমস্যা সচিবের নজরে আসতে ৩ মাস লাগতো তা এখন ৩ সেকেন্ডেই সম্ভব! ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি! একটা উদাহরণ দেই -
রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্রীদের হোস্টেল সমস্যার করুণ কাহিনী নিয়ে এখানে একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল গত জানুয়ারিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা স্বাস্থ্য সচিব সিরাজুল ইসলাম এর নজরে আসে। মজার ব্যাপার হলো তিনি তখন ছিলেন জেনেভায়। এক ঘণ্টা পরে তিনি কমেন্ট করলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের সাথে তার কথা হয়েছে এবং তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। অধ্যক্ষ তাকে জানিয়েছেন ২ দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান করা হবে। সমস্যা সমাধান হতে অবশ্য ২ দিন লাগেনি। পরদিনই অধ্যক্ষের কমেন্টে জানা গেল সমস্যা সমাধানের জন্য ৩টা জরুরী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
দ্রুততা ছাড়াও এখানে যে বিষয়টা অভূতপূর্ব সেটা হলো এই পুরো ব্যাপারটা ঘটছে দেশের কোটি মানুষের চোখের সামনে। কে কি বলছে আর কে কি করছে তা সবাই জেনে যাচ্ছে। লিখিত দলিল হিসেবেও থেকে যাচ্ছে ভবিষ্যতের নজির হয়ে।
বিষয়টা দেখে অনেক দিন আগে পড়া একটা গল্প মনে পরে গেল -
এক দেশে ছিল এক রাজা। তিনি জানতে পারলেন তার প্রজারা তাদের সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসতে চাইলে প্রাসাদের প্রহরীরা তাদের ঢুকতে বাধা দেয়। তিনি তখন তার খাস দরবারে একটা ঘণ্টা লাগালেন। ঘণ্টার সাথে একটা লম্বা দড়ি লাগিয়ে সেটা নগর-প্রাচীরের বাইরে ঝুলিয়ে দিলেন। এতে প্রজারা খুব খুশি হলো। তাদের কোনো সমস্যা হলে তারা সেই দড়ি ধরে টান দিলেই রাজার দেহ রক্ষীরা এসে তাদের প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে যেত। রাজা মনোযোগ দিয়ে তাদের সমস্যার কথা শুনতেন এবং দ্রুত সমস্যার সমাধান করে দিতেন। একদিন রাজা দরবারে বসে আছেন এমন সময় ঘণ্টা বেজে উঠলো। রাজা তার দেহ রক্ষীদের পাঠালেন। কিছুক্ষণ পরে তারা ফিরে এলো সাথে একটা জীর্ণশীর্ণ ঘোড়া নিয়ে। রাজা অবাক হয়ে কি ব্যাপার জানতে চাইলেন। দেহ রক্ষীরা বললো হুজুর প্রাচীরের বাইরে ঘণ্টার দড়িটাকে পেঁচিয়ে একটা লতানো গাছ উঠেছিলো। ঘোড়াটা সেই গাছের পাতা খাওয়ার সময় দড়িতে টান পড়েছে। সভাসদদের একজন বললো এই ঘোড়ার মালিককে আমি চিনি। সে একজন কাঠুরিয়া। পাশের গ্রামেই থাকে। সে বনে বাদাড়ে গিয়ে শুকনো কাঠ কেটে এই ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে হাটে হাটে বিক্রি করতো। ঘোড়াটা বুড়ো হয়ে গিয়েছে, কাজ করতে পারে না তাই কাঠুরিয়া তাকে আর খেতে দেয় না। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। রাজা প্রহরীদের পাঠালেন ঘোড়ার মালিককে ধরে আনার জন্য। সে এসে রাজার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললো জাঁহাপনা আমার কোন দোষ নেই। ঘোড়াটা বুড়ো হয়ে গেছে। মাল টানতে পারে না তাই আমারও আয় উপার্জন কমে গেছে। আমি নিজেই খেতে পাই না ঘোড়াকে কি খাওয়াবো। রাজা সব শুনে কাঠুরিয়াকে আরেকটা ঘোড়া কেনার পয়সা দিয়ে বললেন তোমার এই বুড়ো ঘোড়াটা এখন থেকে আমার আস্তাবলেই থাকবে যতদিন বাঁচে। রাজার সমাধানে সবাই খুশি হয়ে ধন্য ধন্য করে বলতে লাগলো জাঁহাপনা আপনি শুধু আমাদেরই রাজা নন। আপনি অসহায় পশু পাখীদের ও রাজা।
আমাদের দেশে কোন কাজই সহজে হয় না। তার কারণ আমরা খারাপ মানুষ তা না। আমাদের সিস্টেমটা খারাপ। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ, জবাবদিহিতা খারাপ। ICT, a2i আর সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের জং ধরা সিস্টেমগুলো খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। ফলে যে কাজ ১০ মাসে হতো কিনা সন্দেহ তা ১০ মিনিটে করা যাচ্ছে! ফেইসবুক এখন রাজার ঘণ্টা হয়ে উঠেছে। "Public Service Innovation Bangladesh" এর মাধ্যমে সেই ঘণ্টার দড়ি এখন দেশের প্রতিটি মানুষের পকেটে। রংপুর মেডিকেল কলেজের অসহায় মেয়েরা, চুয়াডাঙ্গার জামজামী বাজারের ক্রেতারা, বরিশালের জেল খাল রক্ষাকারীরা সবাই এই দড়িতে টান দিয়ে সুফল পেয়েছে। ঢাকা বিমান বন্দরে যাত্রী-সেবার মান উন্নয়ন করার দাবিতে আমিও একদিন দড়িটা ধরে টান দেব ভাবছি।
আনিসুর রহমান, সিডনি
|