সড়ক দুর্ঘটনায় প্রয়াত ছোট ভাইয়ের কাছে লেখা চিঠি আনিসুর রহমান
প্রিয় সাবু,
১৯৭৯ সালের ১৬ মে, একটা বাস রাজশাহী’র সিএন্ডবি মোড়ের কাছে তোমার প্রিয় সাইকেলটিকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে নিভিয়ে দিয়েছিলো তোমার জীবন প্রদীপ। আমি তখন বিদেশে। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে তাই আমাকে জানানো হয়নি তোমার চলে যাবার খবর। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে আমি তোমাকে আর পাইনি। রোমানিয়ায় পাঁচ বছর কাটানোর সময় ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। জেব্রা-ক্রসিংয়ে একজন মানুষ এসে দাঁড়ালে বিশাল বাস, ট্রাক, লরিগুলো কিভাবে গর্জন করতে করতে কাছে এসে থেমে যায় তা তুমি দেখনি; কিন্তু আমি দেখেছি। আশির দশকে ঢাকায় ফিরে সবার মধ্যে ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রতিযোগিতা দেখে খুব ব্যথিত হতাম। এখন তো অবস্থা আরো খারাপ।
গত ২৯ জুলাই ২০১৮, তোমার কাছাকাছি বয়সের দিয়া আর রাজীব এর জীবন ঝড়ে গেল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে। ওরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিল। শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া (১৬) আর একই কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রাজীব (১৭) । প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাস যাত্রী ওঠানোর জন্য রেষারেষি করছিল। এ সময় একটি বাস আরেকটি বাসকে দ্রুত পাশ কাটিয়ে আবার বাঁয়ে চাপানোর চেষ্টা করে। এতে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওদের চাপা দেয়। তোমার মতই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ওরা। তোমার মৃত্যুর সময় আমি পাশে ছিলাম না কিন্তু তোমার রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সহপাঠীরা বাস ভর্তি করে আমাদের বাড়িতে এসেছিলো বাবা-মা কে সান্ত্বনা দেবার জন্য। ওদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ সেই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর জন্য। রাজীব আর দিয়া’র সহপাঠীরা কিন্তু শুধু সমবেদনা জানিয়ে বসে থাকেনি। মৃত্যু দেখে দেখে ওরা ক্লান্ত! এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কোনকিছু না ভেবেই ওরা পরদিন ৩০শে জুলাই, ক্লাস বর্জন করে রাজপথে নেমে এসেছিল।
বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! শহরের অন্য প্রান্তে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে অবস্থান নেয় সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ আর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। টানা এক সপ্তাহ ধরে চলেছে এই অবরোধ। এর প্রভাব পড়েছে সারা দেশে, প্রবাসী বাঙালি-বাংলাদেশীদের মধ্যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় মাধ্যমে এসেছে তার খবর। একে কেউ বলছে “নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন”, সাঁওতাল বিদ্রোহ আর সিপাহী বিদ্রোহের সাথে মিলিয়ে কেউ একে বলেছে “কিশোর বিদ্রোহ” আবার কেউ কেউ বলেছে “সরকার পতনের ষড়যন্ত্র”। তবে যে যাই বলুক এটি ছিল একটি অভূতপূর্ব আন্দোলন! তোমার বয়সী ছাত্র ছাত্রীরা সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দোষ শুধু বাস আর ট্রাক চালকদের নয়। এদেশের মন্ত্রী, নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ আর্মি এমনকি হাই কোর্টের জাজ পর্যন্ত কেউই সড়ক বিধি মেনে চলেন না।
এ দেশের আইন প্রণেতা এবং আইন প্রয়োগকারীরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবেন। এ বিষয়টা এর আগে কেউ এমন সুন্দর এবং প্রকট ভাবে জাতীর সামনে তুলে ধরতে পারেনি। গাড়ি চালাতে পুলিশেরও যে লাইসেন্স লাগে সেটা দেশের মানুষ তো দূরের কথা অনেক পুলিশ ভাই ও জানতেন না!
ছাত্রলীগ যদি পাশে দাঁড়াতো, বিএনপি যদি প্রকৃত সমর্থন দিতো আর পুলিশ যদি নমনীয় হতো তাহলে এই আন্দোলনের ফলে দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো যেত। উন্নত দেশের মত না হলেও সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার মত অন্তত হতে পারতো কিন্তু তা হলো না। শোনা যায় আন্দোলনকারীদের ওপরে ছাত্রলীগ ধাওয়া করেছে, বিএনপি সরকার পতনের কথা ভেবেছে। সরকার যদিও ছাত্রদের দাবী-দাওয়া মেনে নিয়ে নতুন “সড়ক পরিবহন আইন” তৈরি করছে কিন্তু “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন এ আইনে ছাত্র-আন্দোলনের দাবি প্রতিফলিত হয়নি। ১৯৯৩ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর রাখা হলেও সর্বনিম্ন শাস্তির কোন বিধান নেই তাই গুরুতর অপরাধ করেও অনেকে নাম মাত্র সাজা পাবে। আইনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড কিন্তু সেটার তদন্ত হবে ৩০২ ধারায়। তাতে ন্যায্য বিচার সাধারণ মানুষের আওতার বাইরেই থেকে যাবে।
ইতি -
তোমার বড়ভাই আনিস
আনিসুর রহমান, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|