পদার্থ বিজ্ঞানী বঙ্গ ললনা আনিসুর রহমান
সম্প্রতি পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেলেন একজন মহিলা। কানাডার নাগরিক ডনা স্ট্রিকল্যান্ড। লেজার রশ্মি নিয়ে তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ এই পুরস্কার পেলেন তিনি। লেজার রশ্মির আলো ঝলমল প্রদর্শনী আমরা অনেকেই দেখেছি। কিন্তু এই রশ্মিকে শিল্প এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হলে এর প্রখরতা অনেক বৃদ্ধি করতে হয়। সেখানেই অবদান রেখেছেন ডনা স্টিকল্যান্ড। তার অবদানের কারণেই আজ লেজার আই সার্জারি সম্ভব হয়েছে। অনেক দিন পরে হলেও স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। গত ১১৫ বছরে মাত্র ৩ জন মহিলা এই দুর্লভ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, মেরি কুরি (১৯০৩), মারিয়া গোয়েপার্ট মায়ার (১৯৬৩) এবং ডনা স্টিকল্যান্ড নিজে (২০১৮)।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মেয়েরা এত পিছিয়ে আছে কেন এটাও এখন একটা গবেষণার বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের মাত্র এক তৃতীয়াংশ মহিলা। এবং মজার বিষয় হলো উন্নত বিশ্বেও এই হারটি প্রায় একই রকম।
বিশ্বজুড়ে এই এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীদের একজন হলেন বাংলাদেশের মেয়ে ড. ফেরদৌসি জাহান। পরিবারের অনেকের পরামর্শের বিপরীতে গিয়ে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে বিলেত যান পিএইচডি করতে। স্বামী ড. হেদায়েতুল ইসলাম এবং ৩ কন্যা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন দীর্ঘ দিন। কাজ করেন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান, অস্ট্রেলিয়ান মেজারমেন্ট ইন্সটিটিউটে।
ধর্ম নিয়ে যেমন সবার মনেই কিছু না কিছু প্রশ্ন থাকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। তাই কোন বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয় হলেই আমি তাদের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করি। পদার্থ বিজ্ঞানী হলে তো কথাই নেই। এভাবেই আলাপ হয়েছিল হেদায়েত ভাই এবং বনবন আপার সাথে। বনবন ড. ফেরদৌসি জাহানের ডাক নাম। পরিচিত মহলে আমরা এই চুপচাপ সাদাসিধে বিনয়ী বিজ্ঞানীকে বনবন আপা বলেই ডাকি।
দৈনিন্দন কাজে কর্মে আমরা মাপ-ঝোক তো সবসময় করছি। ফিতা দিয়ে কাপড় মাপছি, দোকানে ঝোলানো নিক্তি দিয়ে শাক-সবজি মেপে কিনছি, কাপ দিয়ে আটা মাপছি আর থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর। এসব এমন কি জিনিস যার জন্য একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান দরকার! আমার প্রশ্ন শুনে বনবন আপা স্বভাব সুলভ নরম গলায় বলেন, এসব কাজে মাপ-ঝোক সামান্য এদিক ওদিক হলে খুব একটা সমস্যা নেই। কিন্তু শিল্প কারখানায় অনেক ক্ষেত্রে খুব সূক্ষ্ম মাপ-ঝোকের প্রয়োজন হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই উৎপাদিত বস্তু তার গুণগত মান হারাবে। রান্না ঘরের ওভেন ১৮০ ডিগ্রীতে সেট করলে আসলে কি তা ১৮০ তে থাকে! সেটা হয়তো ১৭০ থেকে ১৯০ র মধ্যে ওঠা নামা করে কিন্তু তাতে খাবারের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু কারখানায় যেখানে বিভিন্ন ধাতব জিনিস মিশিয়ে ধাতব সংকর তৈরি করা হয় সেখানে ৮০০ ডিগ্রী মানে কিন্তু ৮০১ ডিগ্রী নয়। বড়জোর ৮০০.০১ হতে পারে। যে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে এই সব সূক্ষ্ম মাপ-ঝোক করা হয় সে সব যন্ত্রপাতি ঠিক মত কাজ করছে কিনা তার দেখভালের দায়িত্ব পালন করে অস্ট্রেলিয়ান মেজারমেন্ট ইন্সটিটিউট। মাপ-ঝোক অনেক ধরণের আছে, ওজন, দৈর্ঘ্য, ভর, আয়তন, ঘনত্ব, তাপ, চাপ এবং আরো অনেক কিছু। বনবন আপা যে দুটি বিভাগের দায়িত্বে আছেন তা হলো তাপ এবং হিউমিডিটি।
তার কাছে অস্ট্রেলিয়ান মেজারমেন্ট ইন্সটিটিউট এর গল্প শুনে শুনে খুব আগ্রহ হলো একদিন তার অফিস এবং ল্যাব দেখতে যাবো। আমি বলতেই তিনি রাজী হয়ে গেলেন। কিন্তু যাই যাই করে বছর গড়িয়ে গেছে কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত যেদিন গেলাম ঘটনা চক্রে সেদিনই ডনা স্ট্রিকল্যান্ডের পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পাবার খবর এলো! সিডনির লেনকোভ এর সবুজ বনানী ঘেরা অস্ট্রেলিয়ান মেজারমেন্ট ইন্সটিটিউট এর বিশাল ভবন। এর ভেতরে কি আছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। ভেতরে যেতেই চোখে পড়লো অসংখ্য করিডোর, যার দুই পাশে সুক্ষাতি-সূক্ষ্ম মাপ-ঝোকের অত্যাধুনিক ল্যাব এবং বিজ্ঞানীদের নিজস্ব কক্ষ। সে রকম একটা দরজা ঠেলে আমরা বনবন আপার অফিসে ঢুকলাম। দরজায় নামের আগে ডক্টর লেখা নেই বিষয়টা চোখে পড়লো। এদেশে এসবের চল নেই। আমাদের মাঝে এই চলনটা কোথা থেকে এসেছে জানিনা।
কিছুক্ষণ অফিসে বসে গল্প করে বনবন আপার ল্যাব দেখতে গেলাম। নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে ঠাসা ল্যাব। তার নিজের ভুবন। আমার কৌতূহলের করণে তিনি অনেক কথা বললেন যার কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। যখন বুঝি তখন নানা প্রশ্ন করে তাকে ব্যতিব্যস্ত করি আর যখন বুঝি না তখন চুপ করে থাকি। মাথা নাড়াই।
নিজের উদ্ভাবিত সোনা এবং প্লাটিনাম নির্মিত থার্মোমিটার (Thermocouple device) হাতে বনবন আপা বনবন আপা অনেক আগ্রহ ভরে প্রায় ১ মিটার লম্বা একটা থার্মোমিটার দেখালেন। অনেক কিছু বললেন যন্ত্রটার নির্মাণ এবং ক্যালিব্রেশন সম্পর্কে। কিন্তু এটা যে তার নিজের উদ্ভাবিত জিনিস এবং এটা যে ১,০০০ ডিগ্রী পর্যন্ত অতি সূক্ষ্ম তাপ পরিমাপের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভুল থার্মোমিটার সেটা এই স্বল্পভাষী নিরহঙ্কার বিজ্ঞানীর কথা থেকে বুঝতে অনেক সময় লেগে গেল! আরো অবাক হয়ে জানলাম এই থার্মোমিটারে তিনি ব্যাবহার করেছেন গোল্ড এবং প্লাটিনামের তার। মোটামুটি পুরু এবং মিটার খানেক লম্বা মূল্যবান তারগুলি তিনি নিজ হাতে পেঁচিয়ে ঝালাই করেন। ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপে দেখেছি গলিত লোহাগুলো মাঝে মাঝে ছিটকে ছিটকে মাটিতে পড়ে। বনবন আপার ল্যাবের টেবিলেও দেখলাম অনেকগুলো গলিত ধাতব টুকরা পড়ে আছে। পার্থক্য একটাই, ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপের টুকরোগুলো লোহার, বনবন আপার টেবিলের টুকরোগুলো সোনা এবং প্লাটিনামের, যার প্রতি আউন্সের দাম প্রায় ১,৭০০ ডলার। আমি বললাম এগুলো দিয়ে তো আপনি অনেক অরনামেন্ট বানাতে পারবেন। বনবন আপা শুধু মিষ্টি করে একটু হাসলেন!
সামান্য তাপ আর হিউমিডিটি মাপতে এত যন্ত্রপাতি লাগে সেটা বনবন আপার ল্যাব না দেখলে কল্পনাও করতে পারতাম না!
আনিসুর রহমান, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|