অন্য সূর্যের সখি আনিসুর রহমান
জেমিনাই | মহাবিশ্বের কোনো কিছুই স্থির নয়, তবুও আমরা আকাশের তারাগুলিকে স্থির দেখি। এর কারণ দূরত্ব। গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় রাস্তার পাশের গাছগুলি সাই সাই করে পেছনে চলে যায় কিন্তু দূরের পাহাড় মনে হয় নড়ছেই না। পাহাড়ের চেয়ে আকাশের তারাগুলি এত বেশি দূরে যে হাজার হাজার বছর পরেও তাদের নড়াচড়া আমাদের চোখে পড়ে না। গ্রিক দার্শনিকরা আকাশের তারাগুলিকে কাল্পনিক রেখা দিয়ে যুক্ত করে বিভিন্ন পশু-পাখি এবং মানুষের ছবি কল্পনা করতেন, আঁকতেন। আড়াই হাজার বছর পরেও সেই ছবিগুলি তেমনই আছে। তারাদের নড়াচড়ার কারণে ছবিগুলি পাল্টে যায়নি। “কন্সটেলেশন জেমিনাই”কে এত হাজার বছর পরেও দুই যমজ ভাইয়ের মতোই লাগে দেখতে। তবে এই আকাশ ভরা তারার মাঝে মানুষ পাঁচটি তারা খুঁজে পেয়েছিল যেগুলো স্থির নয়। এরা ঘুরে বেড়ায়। এই ঘুরে বেড়ানো স্বভাবের কারণে এদের নাম হয়েছে প্ল্যানেট। গ্রিক ভাষায় প্ল্যানেট মানে ভবঘুরে। এই ভবঘুরেদের নাম হল মেরকুরি, ভেনাস, মার্স, জুপিটার এবং স্যাটার্ন। রোমানদের বিভিন্ন দেবদেবীর নামে নামকরণ করা হয়েছিল এদের। ব্যবসা-বাণিজ্যের দেবতার নাম মেরকুরি। ভেনাস হলো ভালোবাসার দেবী; মার্স যুদ্ধের দেবতা; স্যাটার্ন কৃষি-কাজ আর জুপিটার সবার ওপরে, সব দেবতাদের রাজা। বাংলায় আমরা এদের চিনি বুধ, শুক্র, মঙ্গল, শনি এবং বৃহস্পতি নামে। বাকি প্ল্যানেটগুলি খালি চোখে দেখা যায় না। এগুলো পাওয়া গেছে টেলিস্কোপ আবিষ্কার হবার পরে।
আমাদের ছায়াপথ | প্রাচীন কালের মানুষের হৃদয়ে পৃথিবীর একটা কেন্দ্রীয় অবস্থান ছিল। পৃথিবীকে ঘিরেই ছিল সমস্ত কর্মকাণ্ড। চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, তারা সবকিছুর কেন্দ্র ভাবা হত পৃথিবীকে। কিন্তু পৃথিবীও যে একটা প্ল্যানেট সেটা বুঝতে মানুষের আরো দেড় হাজার বছর লেগেছে। মানুষের জ্ঞান যত বেড়েছে আমরা তত ছোট হয়ে গেছি। দার্শনিকরা পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে একটা ছোটখাটো প্ল্যানেট বানিয়ে দিয়েছেন এবং মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসিয়েছেন সূর্যকে।
এরপর থেকে আমাদের অবস্থান দিন দিন আরো ছোট হতে লাগলো। আমরা এখন জানি সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্র তো নয়ই বরং ছায়াপথের সহস্র কোটি ছোট-বড় তারার ভিড়ে একটা মাঝারি গোছের নক্ষত্র। সহস্র কোটি কথাটা কোন ছুড়ে দেওয়া সংখ্যা নয়, বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে এক থেকে চার সহস্র কোটি তারকা নিয়ে গঠিত আমাদের ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি। আমাদের অধঃপতন এখানেই শেষ নয়; প্রথমে মনে করা হতো মিল্কিওয়েটাই বুঝি একমাত্র গ্যালাক্সি কিন্তু মোটেও তা নয়। মিল্কিওয়ে ছাড়াও লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা!
প্ল্যানেটের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সূর্যের চারপাশে যদি আটটা প্ল্যানেট থাকে তাহলে ছায়াপথের অন্যান্য তারারা কি দোষ করল! সেসব তারার চারপাশেও নিশ্চয়ই প্ল্যানেট থাকবে। ১৯৯২ সালে প্রথম সৌরজগতের বাইরে দুটি প্ল্যানেটের সন্ধান পাওয়া যায়। সৌরজগতের বাইরে হলেও এরা আমাদের ছায়াপথেরই অংশ। সৌরজগৎ থেকে আলাদা করার জন্য এই প্ল্যানেট গুলোর নাম দেওয়া হয় এক্সোপ্ল্যানেট (Exoplanet). এরা সূর্য-কন্যা নয়, এরা অন্য সূর্যের সখি! আমাদের ছায়াপথে এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার এক্সোপ্ল্যানেট এর সন্ধান পাওয়া গেছে! মানুষের জিজ্ঞাসার শেষ নেই! আমাদের গ্যালাক্সিতে যদি এত এক্সোপ্ল্যানেট থেকে থাকে তাহলে অন্য গ্যালাক্সিতে কেন থাকবে না?
Whirlpool galaxy | সম্প্রতি এ প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া গেছে। আমাদের ছায়াপথ থেকে তিন কোটি আলোকবর্ষ দূরে একটি গ্যালাক্সির নাম ঘূর্ণিজল (Whirlpool). এর অসংখ্য তারার একটিকে ঘিরে সম্প্রতি প্ল্যানেটের অস্তিত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দূরত্বের কারণে সৌরজগৎ এর বাইরে প্ল্যানেট খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ। খড়ের পালায় সুই খোঁজার মতো। এখন খড়ের পালাটি যদি অন্য দেশে হয়? নিজের গাঁয়ে বসে অন্য দেশের খড়ের পালায় সুই খোঁজা যত কঠিন ছায়াপথের বাইরে গ্রহের খোঁজ করা কি সেরকম কঠিন? এই সুদূর-সূর্য-পিয়াসী গ্রহদের নামই বা কি হবে?
আনিসুর রহমান, সিডনি
|