নার্সিং হোম আনিসুর রহমান
বন্ধু জিয়া আহমেদ এর বাবা তালুকদার সাহেবের বয়স ৯২। দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় ছেলে-মেয়ের কাছে আছেন। এতদিন বাড়িতেই থাকতেন, কখনো ছেলের বাড়ি কখনো মেয়ের বাড়ি। তার শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে সম্প্রতি তাকে একটা নার্সিং হোমে নিতে হয়েছে।
আজ তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। অস্ট্রেলিয়ায় আছি প্রায় ২৮ বছর; কোন নার্সিং হোমে কাউকে দেখতে যাওয়া এই প্রথম। ছেলেকে বললাম তুমিও চল, দেখে আসবে।
প্যারাম্যাটার পশ্চিমে পেন্ডেল হিল এর একটি নার্সিং হোম, নাম মেলরোজ ভিলেজ। বিশাল গেটের সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই তা আপনা-আপনি খুলে যেতে লাগলো। ভেতরের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আর সাজানো বাগান দেখে মনের গুমোট ভাবটা কেটে গেল নিমিষেই! মনে হলো - মন্দ নয়।
আমরা পরিপাটি বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে নার্সিং হোমের রিসেপশন এরিয়ায় ঢুকলাম। মনে হলো একটা ফাইভ স্টার হোটেলের রিসেপশনে ঢুকে পড়েছি। এ কোথায় এলাম! ঠিকানা ভুল হয়নিতো! এক কোনে জিয়া ভাইকে বসে থাকতে দেখে বুঝলাম ঠিক জায়গাতেই এসেছি।
তাকে সাথে নিয়ে আমরা তার বাবাকে দেখতে গেলাম। রুমের বাইরে তালুকদার সাহেবের শুধু নাম নয় ছবিও লাগানো আছে। কোনো পাবলিক বা প্রাইভেট হাসপাতালে এ ব্যবস্থা কখনো দেখিনি। হয়তো আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার জন্য বিষয়টি প্রয়োজনীয়। ভেতরটা হোটেল রুমের মত। বিশেষ ব্যবস্থা সম্বলিত এটাচড বাথ। এক পাশে কাচের স্লাইডিং ডোর; সেটা ঠেলে বাইরে গেলেই রৌদ্র-উজ্জ্বল সাজানো বাগান। পরিবেশটাই এমন - মনটা ফুর-ফুরে হয়ে যায়। দেখলাম তালুকদার সাহেব একটা হুইল-চেয়েরে মাথা নিচু করে বসে আছেন। জিয়া ভাই পাশে গিয়ে বসতেই ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকালেন!
ওনার সাথে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা পুরো নার্সিং হোমটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ডাইনিং রুম, টিভি রুম, টি এরিয়া সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। টি এরিয়াটা সত্যি চমৎকার। মুগ্ধ হয়েছি দেখে।
সবকিছু দেখে খরচের ব্যাপারটা মাথায় এলো। এ ব্যাপারে জিয়া ভাই এর সাথে সামান্য আলাপে যা বুঝেছি তাতে অবাক নয়া হয়ে পারিনি। সরকারী বয়স্ক-ভাতার একটা অংশ এখানে থাকার খরচ চালিয়ে নেবার জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ যার বিষয়-সম্পত্তি কিছুই নেই তিনিও অনায়াসে এখানে থাকতে পারেন - প্রফেশনাল কেয়ারে, স'সম্মানে। যাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি আছে তাদের জন্য ব্যাপারটা আরো সহজ।
নার্সিং হোম সম্পর্কে এতদিন একটা নেতি-বাচক ধারনা ছিল মনে। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের অবহেলা আর অযত্নের প্রতীক মনে হতো এগুলোকে। আমার সে ধারনা আজ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অবহেলা যে হয় না তা হলফ করে বলতে পারবো না কিন্তু সেটা যে নিয়ম নয় কিছু কিছু অনাকাংক্ষিত ব্যতিক্রম তা নিশ্চিত।
"জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে"
প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতেই হবে। জীবনের শেষ দিনগুলি কোথায় কিভাবে কাটবে আজকাল প্রায়ই সে চিন্তাগুলো মাথায় আসে। মেলরোজ ভিলেজ এর টি রুম টি আমার পছন্দ হয়েছে। এমনি একটা ঘরে জীবন পাত্রের শেষ পেয়ালায় চুমুক দিয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে চাই। চির-নিদ্রায়!
|