bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













সিডনিতে যাত্রা দেখার অনুভূতি
আনিসুর রহমান


ছোটবেলায় শেষবার যাত্রা দেখেছিলাম খুলনায়, ৬০ দশকের শেষদিকে। আমার বয়স তখন ১২ কি ১৩। উজ্জ্বল হ্যাজাক লাইটের আলোয় মঞ্চের চারপাশে গোল হয়ে মাটিতে বসে রাজ-রাজড়ার জাঁকজমকপূর্ণ কাহিনী! সে যে কী অনুভূতি তা এযুগের ছেলেমেয়েরা অনুমানও করতে পারবে না।

এ বছর জুন মাসে খবর পেলাম রাহুল গাঙ্গুলির নাট্য সংগঠন আঙ্গিক থিয়েটার সিডনিতে যাত্রা মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে। খুব ভাল লেগেছিলো খবরটা পেয়ে। দিন গুনছিলাম অধীর আগ্রহে। অবশেষে ১২ ই নভেম্বরে এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। কিন্তু কোথায় কি! কোথায় সেই যাত্রার পরিবেশ! আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কে সারি সারি গাড়ি। লিফটের বোতাম চেপে ক্যাসল হিলের পায়োনিয়ার থিয়েটার, অত্যাধুনিক হল! নেই হ্যাজাক বাতি, খরের ওপর ত্রিপল বিছিয়ে গোল হয়ে বসা! ২০১৯ সালে আঙ্গিক থিয়েটার “দেবী সর্পমস্তা” পালা-গানের আয়োজন করেছিল বেলা ভিস্তা ফার্মের একটা শেডে। সেখানে মঞ্চের চারপাশে গোল হয়ে চেয়ারে বসার ব্যবস্থা ছিল। সে কারণেই হয়তো তৈরি হয়েছিল এই প্রত্যাশা। একটু মন খারাপ করেই বসে রইলাম যাত্রা “সুখের কথা বলো শুধু” দেখার অপেক্ষায়।


যথাসময়ে সামান্য পরেই ধীরে ধীরে সরে গেল মঞ্চের ভারী কালো পর্দা। আলো-আধারিতে দেখলাম মঞ্চের দুপাশে সার ধরে বসেছেন গানের শিল্পী এবং যন্ত্রীরা। হ্যাজাক বাতির পরিবর্তে জ্বলে উঠলো LED ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলো। উপর থেকে ঝোলানো ১০ টা মাইক্রোফোনের নিচে এসে দাঁড়ালো হেমন্ত আর রাতি। কী নাটকীয় অভিনয়! আমি এক নিমিষে ফিরে গেলাম আমার ফেলে আসা শৈশবে!

পরশপুরের ক্ষমতালিপ্সু হেমন্তের চোখ পড়েছে বনলতার দিকে। যেকোনো মূল্যেই তাকে পেতে চায়। তাই ছলে-বলে-কৌশলে বনলতার ভালোবাসার মানুষ অরণ্যের নামে অপবাদ দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় সে। কোনভাবেই যখন সে পেরে উঠছে না তখন বনলতা কে ধর্ষণ এবং অপহরণ করে পাঠিয়ে দেয় কলকাতার এক বাইজি বাড়িতে। আর অপহরণের দায় চাপিয়ে জেলে পাঠায় অরণ্যকে। যাত্রার আলো, লাইভ মিউজিক আর নাটকীয় ডায়লগ এর ভেতর দিয়ে গড়িয়ে চলে কাহিনী। আমরা হলভর্তি মানুষ সিডনিতে বসে দেখছি গ্রাম বাংলার বিলুপ্ত প্রায় প্রাচীন সংস্কৃতি। যে রাতি একদিন হেমন্তের প্ররোচনায় বনলতা কে সরিয়ে দিয়েছিলো অরণ্যের জীবন থেকে দু'বছর পরে সেই একদিন কলকাতার অন্ধকার পল্লীতে খুঁজে পায় বনলতাকে। পরশপুরের এক সমাজসেবক ডাক্তার তার উকিল বন্ধুর সাহায্যে জেল থেকে মুক্ত করে আনে অরণ্যকে। পরাজয় হয় অপশক্তির। জয় হয় বনলতা আর অরণ্যের ভালোবাসার। মোটামুটি এই হল যাত্রার কাহিনী তবে এর মধ্যে আছে আরো অনেক ঘটনা, অনেক পাত্র-পাত্রী, সব মিলিয়ে ১৭ জন।


প্রধান চরিত্রে বনলতার ভূমিকায় অমৃতা পাল চৌধুরী এবং অরণ্যের ভূমিকায় রাহুল গাঙ্গুলি অসাধারণ অভিনয় করেছেন। দুর্ধর্ষ খলনায়ক হেমন্তের ভূমিকায় শাকিল চৌধুরী এবং তার সহযোগী দামোদর এর ভূমিকায় সন্দীপ কাঞ্জিলাল এর অভিনয় ছিল দেখার মতো। অরণ্যের বড় ভাই অনল (শান্তনু লোধ) এবং বৌদি প্রতিমার ভূমিকায় রিনি হালদার চক্রবর্তীর অভিনয় ভালো লেগেছে। জয় নারায়ণ এর ভূমিকায় আসিফ আহমেদ শুভকে চমৎকার মানিয়েছিল। মনেই হচ্ছিল না তিনি অভিনয় করছেন। এছাড়াও অন্যান্যদের অভিনয় ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। এমন দীর্ঘ সব সংলাপ কোন প্রম্পট ছাড়া এমন অবলীলায় বলে যাচ্ছিলেন সবাই! আমার পেছনের সারিতে বলাবলিও করছিলেন দু’জন বয়স্ক মহিলা। “কেমন করে মনে রাখে এত লম্বা ডায়লগ!”


শুরুতে আমার মধ্যে যে হতাশা কাজ করেছিল পাত্র-পাত্রীদের শক্তিশালী অভিনয় দেখে সেই অনুভূতি কখন যে উবে গেছে বুঝতে পারিনি। যাত্রা দেখে ফেরার পথে ভাবছিলাম - তাইতো, কোন কিছু কি চিরকাল একরকম থাকে! বৈদিক যুগ থেকে আবহমান বাংলায় যে যাত্রার ধারা যুগে যুগে বিবর্তিত হয়ে চলে আসছে - আমি তার দেখা পেয়েছি ৬০ দশকে, একটা বিশেষ রূপে। কিন্তু আমরা তো আর ৬০ দশকে আটকে নেই। সেই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছি বিশ্বের আনাচে-কানাচে। পরিবর্তন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না এবং সেটা উচিতও নয়। কিন্তু পরিবর্তনের মাঝেও যেটুকু অপরিবর্তিত থাকে সেটাই ধ্রুব এবং কালজয়ী। সেই সত্যকেই সফলভাবে তুলে ধরেছেন রাহুল গাঙ্গুলি এবং তার আঙ্গিক থিয়েটার। শুরুতে যাত্রার পরিবেশ ভিন্ন মনে হলেও ফেরার পথে মনে হলো যাত্রা দেখার আমেজটা পুরোপুরি খাঁটি।

২০০৪ থেকে আজ অবধি সিডনিতে ২২টি নাটক এবং যাত্রা-পালা মঞ্চস্থ করেছেন রাহুল গাঙ্গুলি। কী অসাধারণ প্রাণশক্তি এবং সাংগঠনিক দক্ষতা থাকলে প্রবাসের মাটিতে এতটা করা সম্ভব তাই ভাবি আর অবাক হই।


যারা অভিনয় করেছেনঃ
হেমন্ত - শাকিল চৌধুরী
রাতি বাগদি - স্বাগতা দাস
ভোলা - শুভদীপ বর্মণ
জয় নারায়ণ- ওয়াসিফ আহমেদ শুভ
মোহিনী - অপর্ণা মিত্র
বিনয় - অপু সাহা
বিজয় - রুমি মুখার্জি
বনলতা - অমৃতা পাল চৌধুরী
অনল - শান্তনু লোধ
নন্দ - মহম্মদ খান তুষার
কনস্টেবল - শৌণক মিত্র
দামোদর - সন্দীপ কাঞ্জিলাল
প্রতিমা - রিনি হালদার চক্রবর্তী
অরণ্য - রাহুল গাঙ্গুলি
ডা. সান্যাল - সন্দীপ ভট্টাচার্য
মদন - সোমাভ ভট্টাচার্য
নাড়ুগোপাল - সাইমন পাল

গানঃ
সেতু গুপ্তা ও নাবিলা আফ্রীদা স্রোতস্বিনী

যন্ত্রসংগীতঃ
হারমোনিয়াম - রথীন্দ্র নাথ ঢালী
তবলা - শান্তনু কর
কিবোর্ড - নীলাদ্রি চক্রবর্তী
বাঁশি - বিপ্রজ্যোতি দত্ত
বেহালা - ঋষি দত্ত
পার্কাশন - বিজয় সাহা

অন্যান্যঃ
আলোকসম্পাত - প্রমিত চৌধুরী
শব্দ - অরিন্দম কাঞ্জিলাল
মঞ্চ ব্যবস্থাপনা - প্রমথ চৌধুরী
প্রচার - অমৃতা পাল চৌধুরী





আনিসুর রহমান, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 14-Nov-2022

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot