গল্প সাধ আনিসুর রহমান
চাঁদে যেতে কত টাকা লাগে বলতে পারো? বাসর ঘরে নতুন বউকে জিজ্ঞাসা করেছিল শাকিল। রিনা না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছিল। ওকে জড়িয়ে ধরে শাকিল বলেছিল, আমি জানি, ৮০ হাজার কোটি টাকা। ধীরে ধীরে জড়তা ভাঙ্গার পর রিনা বলেছিল, টাকা হলে বাঘের চোখ পাওয়া যায় শুনেছি কিন্তু ৮০ হাজার কোটি টাকা হলেই কিন্তু চাঁদে যাওয়া যাবে না। রিনার সন্দেহ দেখে শাকিল আরো উৎসাহী হয়ে বললো, আমি খোঁজ-খবর নিয়েই বলছি। আশি হাজার কোটি টাকা হলেই চলবে। কিন্তু রিনার সন্দেহ দূর হল না। ও শাকিলের দিকে তাকিয়ে বললো, ঢাকা চট্রগ্রামের মত পৃথিবী আর চাঁদের মধ্যে তো কোনো নিয়মিত ফ্লাইট নেই যে টাকা থাকলেই টিকিট কেটে যখন ইচ্ছা যাওয়া যাবে! অন্যদের মত পাশ কাটিয়ে না গিয়ে রিনা এমন একটা বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে তাতেই আনন্দ পাচ্ছে শাকিল। এমন একটা বউই তো কামনা করেছিল সে মনে মনে। যার সাথে সারা জীবন কথা বললেও কথা ফুরবে না। চাঁদে যাওয়ার ফ্লাইট থাকলে তো এত টাকা লাগতো না। ফ্লাইট নেই বলেই এত টাকা দরকার। ফ্লাইট না থাকলে যাবে কি ভাবে? ফ্লাইট না থাকলে কি হবে, চাঁদে যাবার পথ তো চেনা আছে। আমি নাসার মহাপরিচালকের সাথে আলাপ করেছি, মানে, ঠিক আমি না- আমার এক বন্ধু আছে, ওর নাম জামিল, ভীষণ ইনটেলিজেন্ট, রকেট ইঞ্জিনিয়ার, নাসায় কাজ করে, ও আলাপ করেছে। ৮০ হাজার কোটি টাকা হলে ওরা নতুন করে মুন মিশন চালু করবে। এ টাকায় এ্যাপোলো-১১ এর মত স্যাটার্ন রকেট, জ্বালানী, ট্রেনিং আর মিশন কন্ট্রোলের খরচ উঠে যাবে। বাদবাকি খরচ ওদের। অবশ্য টাকাটা ডলারে দিতে হবে, প্রায় সতেরো বিলিয়ন ডলার। বিলিয়ন মানে জানতো- প্রশ্ন করে শাকিল। রিনা মাথা নাড়ে, না জানি না। এক বিলিয়ন মানে একের পরে নয়টা শূন্য। নাসার হাতেও বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা জমা হয়ে আছে। কেউ নিজের খরচে চাঁদে গেলে ওদের গবেষণার কাজগুলিও সেরে নেয়া যাবে। সে কারণেই বাকি পয়সাটা দিতে রাজি আছে ওরা। শাকিলের কথা শুনতে শুনতে একটা ভবিষ্যৎ বানীর কথা মনে পড়তেই ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলো রিনা। অনেক দিন আগে এক জ্যোতিষ ওর হাত দেখে বলেছিল, একটা পাগলের সাথে তার বিয়ে হবে কিংবা বিয়ের পর তার স্বামী পাগল হয়ে যাবে। শাকিলের কথা শুনতে এতক্ষণ ভালই লাগছিলো, কিন্তু ভবিষ্যৎ বানীর কথা মনে পড়ার পর আর ভাল লাগছে না। এমন একটা মজার বিষয়ে রিনা হঠাৎ করে আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় মনটা খারাপ হয়ে গেল শাকিলের। আরো কত কথা বলার ছিল!
এই পাগলামোর শুরু ষাট দশকের প্রথম দিকে। শাকিলের বয়স তখন পাঁচ বৎসর। এপ্রিল মাসের প্রথম দিক। বেশ গরম পড়েছে ঢাকায়। ছুটির দিন বিকালে বাড়ির পেছনে লনে বসে চা খাওয়া হামিদ সাহেবের পুরানো অভ্যাস। হামিদ সাহেব শাকিলের বাবা। দৈনিক কাগজের পাতায় ইউরি গ্যাগারিনের ছবি সহ একটা খবর খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন তিনি। পাশের চেয়ারে বসে তার স্ত্রী রেশমা শাকিলকে ছবি আঁকা শেখাচ্ছিলেন। কাগজ থেকে মুখ তুলে হামিদ সাহেব বললেন, রাশিয়া মহাশূন্যে মানুষ পাঠিয়েছে। কাগজটা রেশমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই দেখ। অনেকক্ষণ আলাপ হলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। মহাশূন্যে যখন মানুষ পাঠানো সম্ভব হয়েছে তখন নেক্সট টার্গেট চাঁদ, দেখো আর কয়েক বৎসরের মধ্যে মানুষ চাঁদে পা রাখবে। এতক্ষণ শাকিল খুব মনোযোগ দিয়ে বাবা মার কথা শুনছিল। চাঁদে যাবার কথা শুনে সে ধীরে ধীরে বাবার কাছে এসে বলল, বাবা আমিও চাঁদে যাবো। হামিদ সাহেব ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বললেন অবশ্যই যাবে বাবা- আগে বড় হও। পাঁচ বছর বয়সের শিশুর হঠাৎ জাগা সাধ বেশীক্ষণ মনে থাকার কথা নয়। শাকিলেরও থাকেনি। বাবার কোল থেকে নামার পর এ নিয়ে আর কোনো কথা বলেন নি সে।
চাঁদে যাবার ব্যাপারে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা ওর মনে প্রথম উঁকি দিয়েছিল ১৯৬৯ সালে ২০শে জুলাই। নীল আর্মস্ট্রং যেদিন চাঁদের মাটিতে পা রাখলেন, সেই দিন। ছোট্ট একটা পদক্ষেপ কিন্তু সমগ্র মানব জাতির জন্য কি বিশাল একটা মাইল ফলক হয়ে রইল তাঁর পদচিহ্ন। চন্দ্র অভিযান নিয়ে সে সময় শাকিলের আগ্রহটা পাগলামির পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল। ইউ এস আই এস লাইব্রেরীতে মেরকুরি, জেমিনাই এবং অ্যাপোলো মিশেনের ওপর যত তথ্য ছিল সব শাকিলের ঠোঁটস্থ হয়ে গিয়েছিল। স্কুলের পড়াশুনা বাদ দিয়ে সারাদিন শুধু এসব নিয়েই সময় কাটাতো শাকিল। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল মানুষ যেমন প্লেনে চড়ে লন্ডন আমেরিকা যায় আর কিছুদিনের মধ্যে সেভাবে চাঁদে বেড়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চাঁদে যাবার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিল শাকিল। এটা কি কল্পনা প্রবণ কিশোর মনের স্বপ্ন না পাঁচ বছরের শিশুর বিস্মৃত অভিলাষ তা বলা কঠিন।
স্কুলে এর মধ্যে ওর নাম হয়ে গেছে নভোচারী। ছাত্রদের ছাড়িয়ে শিক্ষকরাও জেনে গেছেন ওর নতুন নাম। শাকিল খেয়াল করেছে, ক্লাসে পড়া না পারলে কিংবা হোম ওয়ার্ক আনতে ভুলে গেলে শিক্ষকরা এই নামটা বেশী ব্যবহার করেন, মাটিতে ফিরে আসতে আহবান জানান। তাদের দোষ দিত না শাকিল। এমন একটা বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া কঠিন, ব্যাঙ্গ করাটা সহজ।
অনেকের সাথে মহাকাশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ও অল্পদিনেই বুঝে গিয়েছিল বেশীর ভাগ মানুষ আসলে পৃথিবী নিয়েই সন্তুষ্ট। এর বাইরে কি হচ্ছে তা নিয়ে তাদের কৌতূহল হয়তো কিছু আছে তবে তা মোটেই গভীর নয়। কত কিছু জানতে ইচ্ছা করে ওর, কথা বলতে ইচ্ছা করে কিন্তু শোনার মানুষ নেই। সবাই হয় ব্যস্ত নয়তো নিরুৎসাহী। তবে জামিল ছেলেটা একটু অন্য রকম। ওর আগ্রহ আছে। ও প্রশ্ন করে, জানতে চায়, কল্পনা করতে ভালবাসে। জামিল স্বপ্ন দেখে। অল্প দিনের মধ্যেই ওরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলো।
এইচএসসি পাশ করার পর জামিলের বাবা ওকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিলেন। জামিল সিনসিনটি ইউনিভার্সিটিতে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভর্তি হল। সিনসিনটি ইউনিভার্সিটি বেছে নেবার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল। নীল আর্মস্ট্রং তখন সিনসিনটি ইউনিভার্সিটির এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। চাঁদের টানে পৃথিবীতে জোয়ার ভাটা হয়। নীল আর্মস্ট্রং নামটার মধ্যেও তেমন কোনো আকর্ষণ ছিলো হয়তো। হাজার হাজার মাইল দূরে এক তরুণ বিদ্যার্থীকে তা আকর্ষণ করেছিল প্রবল ভাবে।
দেশ ছাড়ার আগে শাকিল আর জামিল অনেক সময় কাটিয়েছে একসাথে আড্ডা দিয়ে। জামিল অনেক সাধাসাধি করেছিল শাকিলকে ওর সাথে সিনসিনটি যাবার জন্য। হামিদ সাহেবও শাকিলকে আমেরিকা যাবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন অনেক বার কিন্তু শাকিল রাজী হয়নি। দেশের বাইরে ওর একদম ভাল লাগে না। জামিল ঠাট্টা করে বলেছিল বিদেশ যেতে ইচ্ছা করে না তাহলে চাঁদে যাবি কিভাবে? জামিল হেসে বলেছিল চাঁদ কি বিদেশ! আমার ঘরের জানালা দিয়ে যা দেখা যায় তা আমার দেশেরই অংশ।
জামিল চলে যাবার পর খুব একা হয়ে গিয়েছিল শাকিল। মাঠের মধ্যে একটা গাছকে যেমন একা মনে হয় অনেকটা তেমন। জামিল ছাড়া আসলেই আর কোনো বন্ধু নেই ওর। মাস খানেক পর জামিলের চিঠি এলো। অনেক কথা লিখেছে চিঠিতে। ভাল ভাবে পৌঁছানোর খবর, ভর্তি হবার খবর, হোস্টেলের গল্প, লিন্ডা নামের একটা মেয়ের কথা, নীল আর্মস্ট্রং এর সাথে দেখা করার কথা- অনেক কিছু। জামিল লিখেছে, “নীল আর্মস্ট্রং এর সাথে হ্যান্ড শেক করার সময় খুব ইচ্ছা হচ্ছিল বলি, গুরুদেব তোমার পায়ে চাঁদের মাটি লেগে আছে, আমায় একটু পদ ধূলি দেবে। কিন্তু তিনি বাংলা বোঝেন না, তাই আর বলা হল না। এ সব কথা কি আর ইংরেজিতে বলা যায়!” প্রথম প্রথম বেশ ঘন ঘন চিঠি লিখতো জামিল। যেদিন চিঠি পাওয়া সেদিনই উত্তর লিখতে বসে যেত শাকিল। কিন্তু লেখাপড়ার চাপ অথবা দূরত্ব জনিত কারণে চিঠি আদান প্রদান কমতে লাগলো। পাঁচ বছরের মাথায় তা বছরে একটায় গিয়ে ঠেকলো।
জামিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে চাকরী পেয়ে একটা লম্বা চিঠি লিখেছিল। শাকিল এর মধ্যে অনার্স শেষ করে বাবার ব্যবসায় দেখাশুনার কাজে ব্যস্ত। মাস্টার্স করা আর হয়ে ওঠেনি ওর। শাকিল সব সময় একা থাকতে পছন্দ করতো। একাকী স্বভাব দার্শনিকদের মানায় ব্যবসায়ীদের নয়। তাদের কাজ মানুষ নিয়ে। হামিদ সাহেব অল্পদিনেই বুঝতে পারলেন শাকিলকে দিয়ে ব্যবসা হবে না। কিন্তু শাকিল তাদের একমাত্র সন্তান। সে বাবার ব্যবসা দেখাশুনার ভার না নিলে চলবে কেন! হামিদ সাহেবের এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন, ছেলে কে বিয়ে দিয়ে দিন। বউ যদি মিশুক হয় তাহলে দেখবেন অল্প দিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে। হামিদ সাহেব হেসে বলেছিলেন, সংসারে মন বসানোর জন্য এক সুন্দরী রাজকন্যার সাথে বুদ্ধদেবের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। বুদ্ধদেব ঘর ছেড়ে বনে চলে গিয়েছিলেন। সে রকম কিছু যদি হয়? শাকিলের মার সাথে আলাপের সময় তাকেও এ কথা বলেছিলেন হামিদ সাহেব। উত্তরে রেশমা বলেছিল, আজকাল বন কোথায়, যে যাবে! তুমি কোনো চিন্তা না করে ওর বিয়ের ব্যবস্থা কর।
যেমন কথা তেমন কাজ। তিন মাসের মধ্যে রিনা আর শাকিলের বিয়ে হয়ে গেল। মেয়েরা যদি মিশুক হয় তাহলে তাদের বন্ধু বান্ধবের অভাব হয় না কখনো। রিনা সুন্দরী এবং মিশুক। ফলে শাকিলের একা একা থাকার স্বভাবটা দূর হতে খুব বেশী দিন লাগেনি। যে ছেলেটি ছুটির দিন সারা বেলা শুধু ঘরে বসে বই পড়ে কাটাতো, বিয়ের পর তাকে ঘরে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়লো। রিনা একদম ঘরে বসে থাকতে পারে না। ছুটির দিনে তাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতেই হবে। রিনাকে শাকিলের খুব ভাল লেগেছিল। রিনারও খুব পছন্দ হয়েছিল শাকিলকে। পারস্পরিক ভালোলাগা ধীরে ধীরে পরিণত হল গভীর মমত্ববোধ আর ভালবাসায় যা মানুষকে পাল্টে দেয়, এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
শাকিল এখন পুরোপুরি ব্যবসায়ী মানুষ। বিয়ের পর রিনার মনে স্বামীর পাগলামি নিয়ে যে ভয়টা জন্মেছিল তা এখন সম্পূর্ণ কেটে গেছে। ঘুরে বেড়াতে এখনও খুব ভাল লাগে রিনার কিন্তু এখন সে এক ছেলের মা। দায়িত্ব বেড়েছে অনেক। হামিদ সাহেব ব্যবসার প্রায় সব দায়িত্ব শাকিলের হাতে ছেড়ে দিয়ে এখন এক ধরনের অবসর জীবন যাপন করছেন। বিশেষ প্রয়োজন না হলে আর অপিসে যান না। শাকিলের ব্যস্ততা বেড়েছে অনেক। চাঁদে যেতে কত টাকা লাগে সে সব ছেলেমানুষি হিসাব করার সময় নেই তার। ব্যবসার হিসাব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় দিন রাত।
দুপুর থেকে মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে শাকিলের। সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে রিনা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে! রিনার কথার কোনো জবাব দিল না শাকিল। ব্রিফ কেসটা ওর হাতে দিয়ে ভেতরের বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে গিয়ে বসলো। একটু পরেই উঠে গিয়ে বাগানে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে বাগানের এক কোনে রাখা ধ্যান মগ্ন বুদ্ধদেবের মূর্তির কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর পাশে রাখা বড় পাথরগুলোর একটায় গিয়ে বসে রইল চুপচাপ। দূর থেকে ওকে লক্ষ্য করছিল রিনা । মনের মধ্যে উথাল পাথাল করছে ওর। কিছু একটা হয়েছে। কিছুক্ষণ ওকে একা থাকতে দিয়ে ধীরে ধীরে কাছে এলো রিনা। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে নরম স্বরে বললো, কি হয়েছে তোমার আজ? আমাকে বলবে না? শাকিল পকেট থেকে একটা খাম বের করে রিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, জামিলের চিঠি, পড়ে দেখ।
প্রিয় শাকিল,
অনেক দিন পর তোকে চিঠি লিখছি। তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস? আমি একজন মৃত্যু পথ যাত্রী মানুষ। আমার উপর রাগ করিস না দোস্ত। আমার প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ফাইনাল স্টেজ। আমি মরে যাচ্ছি। কেন এমন হল বলতে পারিস? আমারতো এখনও সময় হয়নি! হাতে কত কাজ! কিন্তু কে যেন ভুল করে ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। আমাকে চলে যেতেই হবে। তুইকি এখনো চাঁদে যাবার স্বপ্ন দেখিস? আমি এখনো দেখি। ভুল বললাম। এতদিন দেখেছি। এখন আর দেখিনা। আমার আর স্বপ্ন দেখার সময় কোথায়! তুই জানিস কিনা জানি না চাঁদের মেরু অঞ্চলে মাটির নিচে প্রচুর জমাট বাঁধা পানি আছে বলে মনে হচ্ছে। পানির অপর নাম জীবন। পানিকে ভেঙ্গে সহজেই অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন পাওয়া যায়। অক্সিজেন আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে লাগবে আর তুইতো জানিস হাইড্রোজেন রকেটের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পানি থাকলে সেচের ব্যবস্থা করে চাঁদে মাটিতে গাছ লাগানো যাবে। চাঁদের গাছে একদিন আপেল ধরবে, কল্পনা করতে পারিস! যদি সত্যি হয় তাহলে মুন মিশন আবার চালু হবে। চাঁদে তৈরি হবে নাসার বিশাল ল্যাবরেটরি, তৈরি হবে টুরিস্ট সেন্টার। কিন্তু আমার যে সময় শেষ হয়ে গেল। কেনেডি স্পেস সেন্টারের কাছেই আমি অল্প একটু জায়গা কিনেছি কবরের জন্য। এখান থেকে কেপ কেনাভ্রালের লঞ্চিং প্যাডগুলো দেখা যায়। সেখান থেকে প্রচণ্ড শব্দে দশ দিক কাঁপিয়ে বিশাল বিশাল রকেট কত মানুষ নিয়ে আবার চাঁদের পানে যাত্রা করবে। আমি তাদের দেখতে পাবো না! মাটিতে শুয়ে শুয়ে তার কম্পন যদি একটু অনুভব করতে পারি, শুধু এইটুকু আশা....
জামিলের মৃত্যুর মাস তিনেক পর, এক সন্ধ্যায় বাগানে বসে শাকিল ওর পাঁচ বছরের ছেলে আরিফকে গল্প শোনাচ্ছিলো। আরিফ আকাশে চকচকে পূর্ণিমার চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বললো, বাবা আমি যখন হাঁটি তখন চাঁদটা আমার সাথে সাথে আসে কেন? আরিফের প্রশ্ন শুনে অবাক হলো শাকিল। এভাবে কথাটা ভেবে দেখা হয় নি কখনো। তাইতো - চাঁদ কেন আমাদের পিছু পিছু আসে? কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না শাকিল। আরিফ উত্তর শোনার জন্য ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে শাকিল বললো, আমার মনে হয় পিছু পিছু এসে চাঁদ আমাদের সবাইকে তার কাছে যাবার জন্য ডাকে। আরিফ বাবার কাছ ঘেঁসে বসে বললো বাবা আমিও চাঁদে যাবো। শাকিল ছেলেকে গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, অবশ্যই যাবে বাবা, আগে বড় হও।
আনিসুর রহমান, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|